X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমস্যা ও সম্ভাবনা

ড. বি এম মইনুল হোসেন
২৩ আগস্ট ২০২০, ১৬:৫০আপডেট : ১৩ জুন ২০২২, ১৭:৫৪

ড. বি এম মইনুল হোসেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সাম্প্রতিককালে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার সরব উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছে। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে, প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার যেখানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা করে ফেলেছে, সেখানে আমাদের দেশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তির প্রয়োগ হবে না, তেমনটি মনে করার কোনও কারণ নেই। সাধারণত, বুদ্ধিমান মানুষের মতো শিখতে শিখতে, অনেকটা মানুষের অনুকরণে কোনও একটা সমস্যার সমাধান বা কাজ সুসম্পন্ন করতে পারাটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তির কাছে প্রত্যাশিত।
বলা বাহুল্য, বুদ্ধিমান মানুষ অনেক ধরনের জটিল পরিস্থিতি বা অবস্থা সামলানোর সক্ষমতা রাখলেও, মানুষের অনুকরণ করার প্রচেষ্টায় তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু কাজে, সীমাবদ্ধতাসহ সাফল্য পেয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এআই প্রয়োগ করে নাগরিক সুবিধা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। বেসরকারি পর্যায়েও শুরু হয়েছে হরেক রকমের ব্যবহার। এআই কোথায় কোথায় প্রয়োগ হচ্ছে, সে তালিকা করতে গেলে তালিকা শুধু দীর্ঘই হতে থাকবে। ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য ডেলিভারি, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি থেকে শুরু করে কৃষিজমি থেকে ফুলকপি আহরণে পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তবে ব্যাপক হারে প্রয়োগের কথা বলতে গেলে, চ্যাটবট ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সেবা প্রদান এবং বিভিন্ন মেডিক্যাল ইমেজ (এক্সরে, এমআরআই, ইত্যাদি) প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে সঠিভাবে রোগ নির্ণয়ের কথা বলা যেতে পারে।         

অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর নজরদারি ব্যবস্থার প্রয়োগ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। হলিউড সিনেমায় যেমনটা দেখানো হয়, প্রযুক্তি হয়তো সে পর্যায়ে এখনও পৌঁছায়নি, তবে সেখান থেকে খুব যে বেশি দূরে সেটাও বলা যাবে না। এআই নির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা করে, আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে, কোনও জায়গায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং সে অনুযায়ী আগে থেকেই সেখানে পুলিশের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাচ্ছে। ফেস রিকগনিশনের (মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ) মতো প্রযুক্তির ব্যবহার শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষজনকে ট্যাগ করার মধ্যে থেমে নেই, বরং সেটি এখন ব্যবহার হচ্ছে সন্দেহভাজন কাউকে ভিড়ের মধ্য থেকে বের করা, কর্মীদের উপস্থিতি যাচাই করা কিংবা সংরক্ষিত কোনও স্থানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুধুমাত্র অনুমতিপ্রাপ্তদের প্রবেশ নিশ্চিত করার জন্য। 

তবে, অন্য আর সকল প্রযুক্তির মতো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তিরও অন্ধকার দিক রয়েছে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সমস্যাটা প্রযুক্তিতে নয়, সমস্যাটা প্রযুক্তির অগ্রহণযোগ্য প্রয়োগে। উদাহরণ হিসেবে ফেস রিকগনিশনের কথাই ধরা যাক। এই প্রযুক্তিটি যেমন অপরাধী শনাক্তকরণ, অথবা হারিয়ে যাওয়া শিশু বা বয়স্ক মানুষজনকে খুঁজে পাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার হতে পারে সুনির্দিষ্ট কোনও মানুষকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা লঙ্ঘন করে, তার গতিবিধি নজরদারিতে রাখতে; ব্যবহার হতে পারে একটি নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠী কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, সমস্ত কিছু দৃশ্যমান করে ফেলতে। এই ধরনের প্রযুক্তি বিভিন্ন উৎস, যেমন, সিসিটিভি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মিডিয়া ফুটেজ, অন্যান্য অনলাইন সাইট থেকে ডেটা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারে। উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন না করলে, এই সংরক্ষিত ডাটা চুরি হওয়ার মাধ্যমে হতে পারে আইডেন্টিটি থেপ্টের (পরিচয় নিশ্চিতকরণ তথ্য চুরি) মতো ভয়াবহ অপরাধ।     

অধিকন্তু, এই সমস্ত প্রযুক্তির বেশ কিছু দুর্বলতাও রয়েছে; যেগুলো ক্ষেত্রবিশেষে বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু প্রযুক্তির কার্যকারিতা নির্ভর করে কী ধরনের ডাটা দিয়ে সিস্টেমটিকে প্রস্তুত করা হয়েছে সেটির ওপর। যেমন, হতে পারে কোনও একটি ফেস রিকগনিশন সফটওয়্যার শুধুমাত্র ইউরোপ, আমেরিকার মানুষদের জন্য ভালো কাজ করে, এশিয়া বা আফ্রিকার মানুষদের জন্য ভালোভাবে কাজ করে না। কারণটাও খুব স্বাভাবিক; ওই সফটওয়্যার প্রস্তুত (ট্রেইন) করানো হয়েছিল ইউরোপ, আমেরিকার মানুষদের ছবি ব্যবহার করে। এখন সেটা কপি করে এনে, এশিয়া বা আফ্রিকায় ব্যবহার করা শুরু করলে সেটি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। 

এই সমস্ত দিক বিবেচনায়, আমাদের এরকমটা ভাবা উচিত হবে না যে, আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সহজভাবে গ্রহণ করবো না। বরং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা কী ধরনের নীতিমালা গ্রহণ করবো সেটি দ্রুত নির্ধারণ করা উচিত। রাষ্ট্রভেদে, সমাজ ও সংস্কৃতিভেদে বিভিন্ন দেশের জন্য এই নীতিমালা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা শহরে, ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তির কিছু নির্দিষ্ট ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আবার কিছু কিছু দেশে ব্যবহারবিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।         

এটি অনুমান করা কঠিন না যে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে থাকবে এবং ইতিমধ্যে সেসব নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির ব্যবহারের নৈতিক দিক এবং ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি এখনও আলোচনার বাইরেই রয়ে গেছে। এখনই সময় নীতিনির্ধারণ করার, মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে, মানুষের মঙ্গলের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিশ্চিত করার; এই প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের যেন উপকার হয় সেটি নিশ্চিত করার। 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Email: [email protected]

 

 

/এসএএস/এমএমজে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ