কালীগঙ্গার পাড়ে আমরা দুজন যখন এসে বসতাম তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। রথের মেলা দেখতে একবার ওই নদীর পাড়ের শহরে গিয়েছিলাম সপ্তাহখানেকের জন্য। তখনই রাজুর সঙ্গে পরিচয়। পড়ালেখার আলাপ হতো না মোটেও। শহর যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সড়ক ধরে হেঁটে বেড়াতে কেমন লাগে। বারান্দায় রাতজাগা মানুষের একা জেগে থাকা। মধুমঞ্জুরির আলোতে কোন বালিকার মুখ দেখা। কালীগঙ্গার কোন গোধূলি বেলায় বিশ্রামে যায়? এমন সব গল্প চলেছে বছর দুই। তারপর রাজুর সঙ্গে আর দেখা নেই। তিন দশক পেরিয়ে গেলো। লাবণ্য হারিয়েছে কালীগঙ্গা। নদী পাড়ের শহর পরেছে মেগাসিটির খোলস। রাজুর এই তিন দশকে মনে হানা দিয়েছে সহস্রবার। খবর নিয়ে শুনেছিলাম, রাজু নদী পাড়ের শহর ছেড়েছে। মহানগরে অপেক্ষায় থেকেছি কখন চলতিপথে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হয়নি, হলো কাল সেই কালীগঙ্গা পাড়েই। নদীতে ডুব দিয়ে থাকা কিছু মানুষের জলকেলি দেখে দাঁড়িয়েছিলাম। মুঠোফোনের ক্যামেরায় তাদের ধরার চেষ্টা। চিৎকার করে বললাম—একটা ছবি নিতে পারি? জল থেকে ভেসে ওঠা একটা মুখ ফিরতি চিৎকারে বলল—‘দোস্ত, নে ছবি নে’। আমি মুঠোফোনের লেন্সে ওই মুখ দেখেই চমকে উঠলাম। এ যে আমার সেই হারানো বন্ধু রাজু! ভেজা শরীরে পথে দাঁড়িয়েই কথা বলতে থাকে রাজু। অনেক অভিমান নিয়ে এই শহর ছেড়ে চলে গেছিল মহানগরে। ফিরে আসতে হলো কাজ হারিয়ে। রাজু ফিরিস্তি দিয়ে গেলো, তিন দশকে কতবার কত চাকরি পেয়েছে আর হারিয়েছে। তবে এবার আর ভরসা পাচ্ছিল না নতুন চাকরি কুড়িয়ে নেওয়ার, তাই ফিরে এসেছে। ওর ভাষায়-নির্দয়, বেহিসাবি ছাঁটাইয়ের ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না।
চাকরি হারানো বন্ধু, স্বজনদের ফোন, অবয়বপত্রের অন্দরে বার্তা পাই নিয়মিতই। করনোকালে এ ধরনের অস্বস্তিকর খবরের পরিমাণ বেড়েছে। ঈর্ষণীয় পদ ও বেতনে চাকরি করা মানুষটাও যখন কাজ হারান, তখন তার চেয়েও নিজেই বেশি অসহায় বোধ করি। গণমাধ্যমে নিয়মিতই দেখছি বড় বড় শিল্প গোষ্ঠী এমনকি সচ্ছল ব্যাংকও মিতব্যয়ী হওয়ার অজুহাতে লোক ছাঁটাই করছে, বেতন কমাচ্ছে, তখন আতঙ্কিত না হয়ে উপায় কী?
আতঙ্কিত আমি আগেও ছিলাম। আমার মতো আরও কাউকে কাউকে আতঙ্কিত হতে দেখেছি অবয়বপত্রে বা গণমাধ্যমের নানা লেখা ও বচনে। শিল্পগোষ্ঠী ও ব্যাংকগুলো বাজারে নিজেদের আগ্রাসী প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে, দৃশ্যমান অধিক সচ্ছলতা দেখিয়ে ফেলেছিল। করোনাকালে বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়া বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অর্থনীতির মন্দা চক্রের ঝাপটা লেগেছে এখন তাদের শরীরেও। এনজিও ও অন্যান্য সেবা খাতও এর বাইরে নেই। যেমন—বাইরে নেই দেশের সকল মাধ্যমের গণমাধ্যম। বাজার যাচাই না করে গণমাধ্যমের অস্বাভাবিক বিস্ফোরণ এখন সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তার করার নিয়ত নিয়ে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন ওয়েব পোর্টাল, ইউটিউব চ্যানেল। জাতীয় পত্রিকার বেশিরভাগের আত্মপ্রকাশ শিল্পগোষ্ঠীর ঢাল হিসেবে। টেলিভিশন চ্যানেলের বেলায়ও একথা বলা যায়। কারণ দর্শক, গ্রাহক ধরতে না পারলেও অনেক চ্যানেলের সম্প্রচার চলছে। পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে। পাঠক, দর্শকপ্রিয় পত্রিকা, চ্যানেলের সঙ্গে এধরনের গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের হারেরও প্রায় আকাশ পাতাল তফাৎ। ফলে রোজগার কম এধরনের গণমাধ্যমের। তাই গোষ্ঠী, ব্যক্তি ফায়দা পূরণ হলেই প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে বা সংকোচন করা হচ্ছে। যার ফলে তথাকথিত চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া কর্মীরা ছাঁটাই বা কাজহারা হচ্ছেন। বরাবর সচ্ছল ছিল যারা, তাদের রোজগারেও ভাটা পড়েছে অনেকটা। তাই উচ্চবেতনের বা নিজেদের ইচ্ছে খুশিমতো অপ্রয়োজনীয় তালিকা তৈরি করে চলছে ছাঁটাই অভিযান। অনেক কর্মী প্রশ্ন তুলেছেন—মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছিল আমাদের ঘামে। সেই মুনাফা গেলো কোথায়? আজ লোকসানের দিনে ওই টাকায়তো মন্দাকাল পাড়ি দেওয়া যেতো। প্রমাণিত সত্য, মুনাফাকালে চোখে সর্ষে ফুল দেখার মতো করে অপচয় করতে থাকেন অনেক মালিকপক্ষ। মন্দ সময়ের কথা তখন ভাবনায় আসে না। আর ভিনদেশে টাকা উড়িয়ে পাঠানোর সত্য গল্পতো সবার জানা।
পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে, মালিকপক্ষের সঙ্গে দর কষাকষি করার সুযোগ কমই পাওয়া যায়। দুয়েকটি সাফল্যের উদাহরণ থাকলেও বেশিরভাগ গল্প আপস এবং পরাজয়ের। কিন্তু শ্রমিক তো কাজ কুড়িয়ে যাবেই। কাজ ছাড়া নিজের আর পরিবারের অন্ন জুটবে কী করে? শ্রমিক মালিকের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারে একটি শক্তি দিয়েই, তা হলো যোগ্যতা। দক্ষ কর্মীকে বিদায় করতে হলে নির্দয় মালিককেও এক দুইবার হিসাব কষে নিতে হয়। হিসাব কষায় বাধ্য করাতেই শ্রমিকের জয়। অনেকক্ষেত্রেই এই জুয়াতে শ্রমিক জিতে যায়। তারপরও নিশ্চয়তা নেই কাজ ধরে রাখার। তবে কাজ পাওয়ার কিংবা নিজেকে বাজারে টিকিয়ে রাখার নিশ্চিয়তা শতভাগ।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি