X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবৈধ যাপন এবং দগ্ধতা

তুষার আবদুল্লাহ
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:২৫আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:২৮

তুষার আবদুল্লাহ আমাদের যাপন জুড়ে মৃত্যুকূপ তৈরি করে রাখা হয়েছে। শত্রুপক্ষ কে? সত্য জবানবন্দি হচ্ছে—আমি, আমরা নিজেরাই। নিজেদের মৃত্যুকূপ সযত্নে তৈরি করে যাচ্ছি। কোনও ভুলত্রুটি ছাড়াই। তাই দগ্ধ হওয়া, পুড়ে যাওয়ায় বিরাম চিহ্ন পড়ছে না। শয়নকক্ষ থেকে, কারখানা, অফিস, প্রার্থনা ঘর বাকি থাকছে না কিছুই। দুর্নীতি, অনিয়ম, অসততার তাপে পুড়ে যাচ্ছে কত প্রিয় মুখ, পরিবার। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে মসজিদে নামাজ আদায় করতে গিয়ে জীবন গেলো ১৬ জনের। এই পরিসংখ্যানে আরও কিছু নাম যোগ হতে পারে। মৃত্যুর কাছ থেকে জীবন ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে আছে ২৫ জন। আমরা আসলে যোগ-বিয়োগ আর গুণিতকের অঙ্ক করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কোনও বীভৎসতাই আমাদের এখন আর আর্দ্র করে না।
কেউ দেখছে না, কেউ দেখবে না,এমনটা ভেবে বেপরোয়া আমরা। তাই বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির সংযোগ, ভবনের নকশায় অনিয়মকেই স্বাভাবিক বলে বিশ্বাস করি। সকলেই যার যার অবস্থান থেকে বোধ করি সমাজের ক্ষমতাবান মানুষ। কোনও কর্তৃপক্ষ,কোনও আইনের পরোয়া করি না আমরা। তাই এক অবৈধ যাপনে আমাদের অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। যার অনিবার্যতায় গৃহদাহ।

রাজধানীসহ দেশের যেখানেই গ্যাসের আবাসিক ও বাণিজ্যিক সরবরাহ পাইপলাইন আছে, সেখানেই রয়েছে হাজার হাজার অবৈধ সংযোগ। অসংখ্যবার প্রমাণিত হয়েছে এ ধরনের অবৈধ সংযোগের সঙ্গে সরবরাহ কর্তৃপক্ষের কর্মীরা জড়িত। কিন্তু এর কোনও প্রতিকার হয়নি। সংযোগ অবৈধ মানে, সরবরাহ পাইপলাইনে ক্ষত তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এমন অসংখ্য ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাস জমাট হচ্ছে মাটি বা মেঝের নিচে, দেয়ালের ফোকরে বা কোনও পাইপে। জমে থাকা এই গ্যাসের চাপ এক সময় শক্তিশালী বোমায় রূপ নেয়। ঘটে বিস্ফোরণ। স্মরণ সড়কে যতটুকু পেছনে যেতে পারছি দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালের ১৭ মার্চ গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণে বনানীতে একই পরিবারের ৪ জন দগ্ধ হয়ে মারা যান। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সাভারের জামগড়ায় মারা যান একই পরিবারের ৫ জন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণে সাতজন মারা যান। মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান আরও দীর্ঘ। গ্যাসের আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় পাইপলাইনেই ছিদ্র আছে। সেই ছিদ্রের সঠিক পরিসংখ্যান কোনও সরবরাহ কর্তৃপক্ষের কাছেই নেই। শুধু তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের যে ২৮ লাখ গ্রাহক আছে, তাদের কাছ থেকে শুধু নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আসা অভিযোগের ভিত্তিতে সরবরাহ লাইনের প্রায় ১২ হাজার ছিদ্রের কথা তাদের জানা। ১৯৯৭ সালে পুরান ঢাকায় গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণের পর গঠিত উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত দল তাদের সুপারিশে বলেছিল—অবৈধ সংযোগ ও ত্রুটি যুক্ত পাইপলাইন দ্রুত মেরামত করে নিতে হবে। না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু কোনও কর্তৃপক্ষই তদন্ত কমিটির সেই সুপারিশকে আমলে নেয়নি। উপরন্তু নিয়মিতভাবে কারিগরি যে তদারকির প্রয়োজন সেখানেও নিষ্ক্রিয় থেকেছে। 

কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমরা নিত্য দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। দমকল বাহিনীর দেওয়া তথ্য থেকে জানতে পারি, যে পরিমাণ অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, এর এক তৃতীয়াংশের জন্য গ্যাস পাইপলাইনের ছিদ্র দায়ী। একই সঙ্গে দায়ী করতে হয় ভবন মালিক বা নির্মাতাকে। বনানীর মতো অভিজাত এলাকার আবাসিক ভবনেও দেখা গেছে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করতে। নির্মাণকালে সামান্য কিছু খরচ সংকোচন করতে গিয়ে আমরা নিশ্চিত করছি মৃত্যু ঝুঁকি। পাইপলাইনে ছিদ্র আছে একথা জানার পরেও আমাদের সাহস হয় না যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে। কারণ সংযোগটি যে অবৈধ। নারায়ণগঞ্জ মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে যাওয়া গ্যাস পাইপলাইনের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। 

নারায়ণগঞ্জের গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণ ঘটনাতেও একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। সপ্তাহ, পক্ষকাল ওই কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন ও বৈঠকে ব্যস্ত থাকবে। হয়তো সবশেষে আবারও কিছু সুপারিশ জমা পড়বে। বলা যায় সুপারিশের স্তূপের উচ্চতা বাড়বে। ওজন কমবে শোকের মেঘের। আমরা আবারও ফিরে যাবো অবৈধ যাপনের অভ্যস্ততায়, যেখানে আছে মৃত্যুর পথ নির্দেশিকা।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ