X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নরমাল, নিউ নরমাল, ‘অ্যাবনরমাল’

আমীন আল রশীদ
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:১৪আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:১৫

আমীন আল রশীদ করোনাপূর্ব পৃথিবীতে মানুষ মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা করতো। সেটিই ছিল নরমাল বা স্বাভাবিক। করোনাকালে মাস্ক পরে চলাফেরা। কিন্তু কতদিন? একটি ভাইরাসের কারণে পৃথিবী কতদিনই বা স্থবির হয়ে থাকবে? তাতে যত মানুষ করোনায়, তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হবে না খেয়ে—এমন বক্তব্যেও দ্বিমতের সুযোগ কম। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে করোনার সঙ্গে কী করে বাঁচা যায়, অর্থাৎ কী করে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়—বিশ্বব্যাপী এখন সেই চেষ্টা।
এই শতাব্দীর শুরুর দিকে যেমন ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কথাটি বেশ প্রচলিত হয়েছিল—এখন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও সেই অ্যাডাপটেশনের প্রসঙ্গ আসছে। যে কারণে করোনার প্রকোপ পুরোপুরি না কমলেও বা কোথাও কোথাও শনাক্ত এবং মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও, এই বিপদের ভেতরেই ধীরে ধীরে জীবন-যাপন স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া চলছে। অর্থাৎ মানুষ ঘরের বাইরে বের হবে, কাজে যাবে, গণপরিবহনে উঠবে, ফুটপাতে হাঁটার সময় আরেকজনের গায়ে ধাক্কা লাগবে, বাজারে যাবে, এমনকি বেড়াতেও যাবে—কিন্তু যতক্ষণ না করোনার শঙ্কা পুরোপুরি কেটে যাচ্ছে, ততক্ষণ বাইরে বের হলেই মুখে মাস্ক থাকবে। পকেটে স্যানিটাইজার। যতটা সম্ভব জনদূরত্ব বজায় রেখে চলাচল। এমনকি সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্রেও সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলার সময় কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখা এবং মুখে মাস্ক পরে থাকা। এটি দেখতে যতই খারাপ লাগুক আর যতই অস্বস্তি বোধ হোক কিংবা যতই অস্বাভাবিক ঠেকুক না কেন—এটিকেই এখন বলা হচ্ছে ‘নিউ নরমাল’ বা নতুন স্বাভাবিক। 

কিন্তু নরমাল উত্তর পৃথিবীর এই নিউ নরমাল যুগে এখন মানুষের জীবন-যাপন এবং আচার-আচরণে আরেক ধরনের নরমালের দেখা মিলছে—সেটি হলো ‘অ্যাবনরমাল’। অনেক মানুষ বাইরে বের হলে মাস্ক পরছেন, কিন্তু সেই মাস্ক থুতনির নিচে ঝুলে থাকে। মাস্ক থাকে কারও কারও পকেটে। অনেকে মাস্ক আদৌ পরেন না। এমনকি বাজারে বা জনসমাগমস্থলেও না। 

এসব বিবেচনায় এই তিন ধরনের নরমালের একটি সংজ্ঞা দেওয়া যায় এরকম যে, মাস্ক ছাড়া চলাফেরা—নরমাল; মাস্ক পরে দৈনন্দিন কাজ—নিউ নরমাল; থুতনির নিচে মাস্ক—অ্যাবনরমাল। অর্থাৎ, যারা বাইরে বের হলে মাস্ক পরছেন না বা পরলেও সেটি থুতনির নিচে ঝুলে থাকছে; মাস্ক পকেটে নিয়ে ঘুরছেন অথবা বাসের ভেতরে তিরিশজন যাত্রীর মধ্যে কিছু লোক মুখে মাস্ক পরে আছেন আবার কিছু লোকের মুখে মাস্ক নেই—এটিই অ্যাবনরমাল বা অস্বাভাবিক। তার মানে হলো, যারা থুতনির নিচে মাস্ক ঝুলিয়ে রাখছেন—তিনি করোনাকে ভয় পাচ্ছেন না; ভয় পাচ্ছেন মানুষের কথা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধমক আর সামাজিক অস্বস্তিকে। আর যারা মাস্ক আদৌ পরছেন না, তারা কোনও কিছুকেই ভয় পাচ্ছেন না।

প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কি এই অ্যাবনরমালিটিকে উৎসাহিত করছে বা যারা এই নিউ নরমালের যুগে অ্যাবনরমালিটির চর্চা করছেন এবং যেটি আসলে ক্রমবর্ধিষ্ণু—রাষ্ট্র কি সেটি প্রতিহত করতে চায়, নাকি যে যেভাবে পারে চলুক—করোনায় যার যা হবার হোক—এই নীতিতে চলছে? অথবা এ মুহূর্তে করোনা নিয়ে রাষ্ট্রের আর কী-ই বা করার রয়েছে? 

আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও শুরু থেকেই করোনা মোকাবিলায় হার্ড ইমিউনিটির পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ; বিশেষত সরকার। ১৭ কোটি মানুষের দেশ, চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল, মানুষের অসচেতনতা এবং সাহস—সব মিলিয়ে একটানা দুই তিন সপ্তাহ কারফিউ বা কারফিউ ধরনের লকডাউনও বাস্তবসম্মত ছিল না। যদিও অনেক ফোরাম থেকেই এ ধরনের দাবি উঠেছিল। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিরা তৃণমূলের খবর জানেন। যে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী দিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল—তাদের কাছে সরকারের তরফে একটানা কতদিন খাদ্য পৌঁছানো সম্ভব? খাদ্যের পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটি, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে বহু মানুষ যে এই সহায়তার বাইরে থেকে যাবে—সে কথা নীতিনির্ধারকদেরও অজানা নয়। আবার সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের চিকিৎসার যে বেহাল দশা—এবং করোনার কারণে পুরো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থার যে কঙ্কালটি বেরিয়ে গেলো, তাতে সব মানুষকে পরীক্ষা, আইসোলেশন ও চিকিৎসার আওতায় আনাও সম্ভব নয়। সুতরাং এই যখন পরিস্থিতি; চারিদিকে যখন এত সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ—সেখানে অফিসিয়াল অথবা আনঅফিসিয়াল হার্ড ইমিউনিটির বিকল্পই বা কী ছিল? 

আবার দিনের পর দিন, মাসের পর মাস যেহেতু কল-কারখানার চাকা বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়; অফিস-আদালতও স্থবির হয়ে থাকতে পারে না; অনির্দিষ্টকালের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম কিংবা অনলাইন অফিসও যেহেতু আখেরে খুব একটা ফলদায়ক নয়—অতএব করোনায় আক্রান্ত আর মৃত্যুর ভেতরেই জীবন-যাপন স্বাভাবিক করার যে উদ্যোগ, যে প্রক্রিয়া, যে সিদ্ধান্ত—সেটিই বরং যৌক্তিক। 

এই কঠিন বাস্তবতার ভেতরে নিউ নরমাল লাইফে অভ্যস্ত হওয়ার কোনও বিকল্প ছিল না। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অ্যাবনরমালিটি। অর্থাৎ সচেতন মানুষেরা যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে দৈনন্দিন কাজকর্ম করছেন, এমনকি সামাজিক নানা অনুষ্ঠানেও যাচ্ছেন—তার পাশাপাশি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষ, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের অধিকাংশ মানুষ এখন আর করোনাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। রাজধানীতে অনেকের থুতনির নিচে মাস্ক থাকলেও ঢাকার বাইরে এখন মাস্ক পরে বাইরে বেরোনো মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এমনকি বাজার ও জনসমাগমস্থলেও মাস্কবিহীন মানুষের সংখ্যাই বেশি। 

তার মানে কি করোনা শেষ হয়ে গেছে? হয়নি। ভেতরে ভেতরে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। সবাই পরীক্ষা করাচ্ছেন না এবং পরীক্ষার ত্রুটির কারণে অনেকের করোনা শনাক্ত হচ্ছে না। অনেকে একাধিক উপসর্গ থাকলেও বিড়ম্বনা এড়াতে করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। অনেকেই এক বা একাধিক উপসর্গ দেখা দিলে বাসার পাশের ফার্মেসি থেকে প্রাথমিক ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। এটি এক অর্থে ইতিবাচক যে, মানুষ অন্তত গণহারে আতঙ্কিত হচ্ছে না। যদি সত্যি সত্যিই কারও শরীরে করোনাভাইরাস ঢুকেও যায় এবং তিনি যদি এটাকে পাত্তা না দিয়ে থাকতে পারেন এবং তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বলে যদি টিকে যান—তার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। 

কিন্তু এই সাহস এবং পাত্তা না দেওয়ার বিপদ হলো, যে হারে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা এবং আক্রান্তের হার কমার কথা ছিল, বাস্তব চিত্র ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। এখনও প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে। 

অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে যেসব কারণে করোনায় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়নি বা হওয়ার শঙ্কাও কম, তার অন্যতম প্রধান কারণ মানুষের সাহস। কিন্তু তারপরও যেহেতু করোনা পুরোপুরি নির্মূল হয়নি এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নিউ নরমাল যুগে আমরা প্রবেশ করেছি—সেক্ষেত্রে যতক্ষণ না করোনাকে পুরোপুরি বিদায় বলা যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনেই দৈনন্দিন সব কাজে অভ্যস্ত হওয়া প্রয়োজন। 

অসুখকে পাত্তা না দিয়ে থাকতে পারলে ভালো। কিন্তু একজনের পাত্তা না দেওয়ায় আর দশজন আক্রান্ত হবে, সেটি কাঙ্ক্ষিত নয়। অতএব এখন সরকারের উচিত হবে, মানুষকে নিউ নরমালে উৎসাহিত করা এবং ‘ডান্ডার বাড়ি’ দিয়ে নয়, বরং জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে এই কাজটি হওয়া দরকার। মানুষকে বোঝানো দরকার যে, তিনি দৈনন্দিন সব কাজই করবেন—এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানেও হয়তো যাবেন, কিন্তু মুখে মাস্কটা যেন থাকে। যতটা সম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে যেন চলেন। এটুকু মেনে চলা খুব কঠিন নয়। সমস্যা হলো, সব দেশেই জনগণের একটি বড় অংশ নরমাল বা নিউ নরমালের চেয়ে অ্যাবনরমালকেই বেশি পছন্দ করে। সেটি শুধু স্বাস্থ্যের বেলায় নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও।

প্রশ্ন হলো, এই নিউ নরমাল ও অ্যাবরনমাল সময়ের অবসান কবে হবে? মানুষ কবে আবার মাস্ক ছাড়াই মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেবে? কবে বন্ধুর গলা জড়িয়ে ধরবে? সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে হ্যান্ডশেক করবে? মানুষ কবে আবার কোনও ধরনের জনদূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই পরস্পরের সাথে মিশবে, কথা বলবে, আড্ডা দেবে? করোনাপূর্ব সেই স্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রত্যাশা এখন প্রতিটি মানুষের। কিন্তু কেউ কি জানেন, সেই দিনটি কবে আসবে? বিজ্ঞানীদের কাছেও কি কোনও পূর্বাভাস রয়েছে? জীবন ও প্রকৃতিতে সবকিছুর কি পূর্বাভাস থাকে?

লেখক: সাংবাদিক। 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ