X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের জন্য ঋণ, উপহার কেন নয়?

উমর ফারুক
০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৫৫আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৫৬

উমর ফারুক করোনা সংকটে সারাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ বিপর্যস্ত। ধুলো জমেছে শ্রেণিকক্ষে। ধুলো জমেছে আমাদের পাঠ্যবইয়ের পাতায়। মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতি, দেশীয় অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি আমরা সবাই জানি। বেসরকারি খাতে অন্তত এক কোটি মানুষ কাজ হারাচ্ছে। প্রতিদিন দলে দলে মানুষ গ্রামে ফিরছে। করোনা, আম্পান, ৩৩ জেলায় একযোগে বন্যাসহ নানা কারণে সারাদেশের প্রান্তিক অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দৃশ্যমান সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হলো শিক্ষা।
বিপর্যস্ত শিক্ষা খাতকে তুলে আনতে সরকার চেষ্টা করছে। অনলাইন ক্লাসের দিকে এগোচ্ছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক, ভালো খবর। আমরা চাই না শিক্ষা কার্যক্রম আর একদিনও থেমে থাকুক। সরকারের সেই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন কিনতে ১০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউজিসি। বিষয়টি এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষমাণ। নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, সেপ্টেম্বর মাস থেকেই এই অর্থ বরাদ্দ শুরু হবে। সহজ শর্তের এই ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ঠিকমতো পরিশোধ না করলে আটকে দেওয়া হবে শিক্ষার্থীর সনদপত্র।

খবরটি পড়ে আমি লজ্জিত, ব্যথিত। শিক্ষা কোনও অবস্থাতেই পণ্য নয়। শিক্ষা আমাদের অধিকার। মৌলিক অধিকার। একথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য, আজকের এই শিক্ষা সংকটের জন্য আমরা দায়ী নই। সরকারও দায়ী নয়। এই সংকট বৈশ্বিক। নিশ্চিতভাবে সকলে মিলেই তা মোকাবিলা করতে হবে। হিসাব বলছে, স্মার্টফোন বঞ্চিতদের হাতে ফোন পৌঁছে দিতে ৫০-৬০ কোটি টাকা প্রয়োজন। করোনা সংকট মোকাবিলা করতে ব্যবসায়, শিল্প ও কৃষি খাতের জন্য সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে এই অল্প টাকা আমরা তাদের উপহার হিসেবে দিতে পারছি না! ঋণ হিসেবে দিচ্ছি? আমার রাষ্ট্রযন্ত্র কি তবে অন্যসব জায়গায় উদার, কেবল উচ্চশিক্ষায় দীনতা!

শিক্ষা কোনও ব্যয় নয়, বিনিয়োগ। রাষ্ট্রই এই বিনিয়োগের সুফল পায়। শিক্ষায় রাষ্ট্র প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে কেন রাষ্ট্র অধিকার বঞ্চিত এসব শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্মার্টফোন উপহার হিসেবে না দিয়ে ঋণ হিসেবে দিতে চাইছে? প্রতি বছর রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে, অনিয়ম হচ্ছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথাও শুনছি। কিন্তু মাত্র ৫০-৬০ কোটি টাকা আমাদের ঋণ হিসেবে দিতে হবে? তাও আবার যাদের সার্মথ্য নেই তাদের। আমাদের মনে রাখা দরকার মুঠোফোনে রঙ্গ-সিনেমা দেখার জন্য কেউ এই অর্থ গ্রহণ করবে না। গ্রহণ করবে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে। ফলে এটা কেন ঋণ? কেন উপহার নয়?

আমাদের দেশে অনেক এনজিও আছে যারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঘরের টিন খুলে নিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের জন্য স্মার্টফোনের এই প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে আটকে দেওয়া হবে সনদপত্র। চোখে জল চলে এলো। তাহলে এনজিও ও সরকারের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? রাষ্ট্র কি এতটা নিষ্ঠুর চিন্তা করতে পারে? একজন গরিব শিক্ষার্থী ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারবে না, আর আমরা তার সনদপত্র আটকে দেওয়ার চিন্তা করবো? এই চিন্তাই তো আমাদের লজ্জিত করে, অশ্রুসিক্ত করে। আমরা মানবতার কাছে, শিক্ষার কাছে অবনত হই। আমাদের মনে রাখা দরকার স্মার্টফোন শিক্ষার্থীর প্রয়োজন নয়, প্রয়োজন রাষ্ট্রের। শিক্ষার্থীর প্রয়োজন থাকলে ও সুযোগ থাকলে সে আগেই কিনতো। করোনা সংকটে রাষ্ট্রের শিক্ষা কার্যক্রম সফলভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্যই স্মার্টফোন দরকার। এটা কোনও বিলাসিতা নয়। এটা প্রয়োজন। পাঠদানের প্রয়োজনে প্রয়োজন। করোনা সংকটে পাঠদান তথা এই সংকট থেকে আমাদের তুলে আনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এজন্যই জনগণ সরকারকে নির্বাচিত করে এবং কর দেয়।

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই ধনীর সন্তান নয়। অধিকাংশই গরিবের সন্তান। চোখে রোদচশমা দিয়ে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে তাদের কষ্টগুলো বোঝা কঠিন। করোনা সংকটে অনেক অসহায় শিক্ষার্থীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ হয়। তাদের প্রকৃত অবস্থা বোঝানোর প্রয়োজনে নিম্নে কয়েকটি সংযুক্ত হলো।

‘হ্যালো, স্যার, আমার বাবা একজন চা বিক্রেতা। এখন দোকান ভালো চলছে না। ঘরে কোনও খাবার নেই। খুব কষ্টে আছি স্যার। স্যার আমাকে একটু বিভাগের তহবিল থেকে কোনও অর্থের ব্যবস্থা করা যাবে স্যার?’

‘স্যার আমার বাবা একজন দিনমজুর। এখন তেমন কোনও কাজ নেই। আমরা অনেক ভাইবোন স্যার। বড় খারাপ সময় পার করছি। স্যার বলতে খুব খারাপ লাগছে। বিভাগের তহবিল থেকে আমার জন্য যদি কিছু অর্থের ব্যবস্থা করা যেতো। খুব কষ্টে আছি স্যার।’ 

এই ঘটনাটা একটু পুরনো। একবার এক শীতের বিকেলে এক ছাত্রকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখলাম। কারণ জানতে চাইলেই বললো, ‘স্যার, বাবা খরচ জোগাতে পারছেন না। লেখাপড়াটা ছেড়ে দেবো ভাবছি।’ কথা না বাড়িয়ে ওর বাড়িতে রওনা হলাম। গঙ্গাচড়ার উদ্দেশে। যখন ওদের বাড়িতে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যে। ঘনসন্ধ্যে। ঘরের কিনারে দাঁড়িয়েই ছেলেটা মা বলে চিৎকার করে উঠলো। ঘর থেকে কুপি হাতে বেরিয়ে এলেন তার মা। চোখে ভালো দেখতে পান না। রাতকানা। হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে এলেন দরজার কাছে। অন্ধকার ঘরে বাবা শুয়ে আছেন। পঙ্গু। নিজে চলতে পারেন না। জমি বেশি নেই। কোনোরকম খেয়ে, না খেয়ে চলে ওদের জীবন।

এই ঘটনাটাও একটু পুরনো। শ্রেণিকক্ষে আমি বরাবরই গোলগলা-ওয়ালা গেঞ্জি নিরুৎসাহিত করি। কখনও কখনও অপছন্দও করি। একবার গোলগলা-ওয়ালা গেঞ্জি পরিহিত একজনকে দাঁড় করিয়ে কারণ জানতে চাইলাম। ও কিছুই বলছে না। চুপ করে রইলো। আমার স্বর যখন কর্কশ হতে শুরু করলো তখন বললো, ‘স্যার আমার একটিমাত্র শার্ট। কাল বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। শুকায়নি। সরি স্যার।’ বলেই চুপ করে রইলো। পুরো শ্রেণিকক্ষে তখন পিনপতন নীরবতা। একসময় আমিও নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম। তবে চোখের জল লুকাতে পেরেছিলাম কিনা ঠিক মনে নেই।

ওপরের চিত্রটি দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমাদের সমাজচিত্র রাতারাতি বদলায়নি। আজও একইরকম। বরং করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সংকট আরও ভয়াবহ হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কীভাবে একজন চা-বিক্রেতার ছেলের কাছ থেকে জবরদস্তি (সনদপত্র আটকে দিয়ে) ঋণের কিস্তি আদায় করবে? কীভাবে একজন অন্ধ বাবা-মায়ের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় করবে? কীভাবে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ মাত্র একটি শার্টওয়ালা ছাত্রের সনদপত্র আটকে দেবে? বিষয়টা আমার কাছে ঠিক বোধগম্য নয়। রাষ্ট্র কী এতটা অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

১৯৮৭ সালের কথা। তখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অমানবিক, নিষ্ঠুর। নিজের সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগানোর প্রয়োজনে আমার মা তার নিজের পরা শাড়ি বিক্রি করেছিলেন। রাষ্ট্রের কোষাগারে আমার মায়ের শাড়ি বেচা টাকা আজও জমা আছে। সময় বদলে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র আজ শিক্ষার জন্য অনেক বেশি মানবিক ও দায়িত্বশীল। কোনও অবস্থাতেই আমরা কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্বে, একজন শিক্ষার্থীর কাঁধে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারি না। সেই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার সনদপত্র আটকে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না। ক্ষতিগ্রস্ত, বাধাগ্রস্ত শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সরকারকেই পথ খুঁজতে হবে। আমাদের উচিত শিক্ষার জন্যও মোটা অঙ্কের প্রণোদনা ঘোষণা করা। ঋণ নয়, উপহার ঘোষণা করা। আর একটু সুযোগ করে খবর নিতে হবে যাদের জন্য ঋণ শব্দটি ব্যবহার করছি, তাদের ঘরে খাবার আছে তো! শিক্ষার্থীদের জন্য কোনও অবস্থাতেই ঋণ নয়, চাই উপহার। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এই ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

[email protected]



/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ