X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে যা করা দরকার

ড. খুরশিদ আলম
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:৫৮আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:৩০

ড. খুরশিদ আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখন শতবর্ষে পা দিয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা পায় এবং দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আজ তা শতবর্ষে উন্নীত হয়েছে। এ শতবর্ষে এসে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মনে হতে পারে ক্লান্ত-শ্রান্ত। আবার কিছু কিছু বিভাগীয় ভবন, প্রশাসনিক ভবন এবং আবাসিক ভবন দেখে বুঝা যায়, এটির ঔজ্জ্বল্য আরও বাড়ছে। মানের দিক থেকে এক সময় লোকেরা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলতো এ কারণে যে, এখানে সত্যেন বোসের মতো বিজ্ঞানী, জেসি দেবের মতো দার্শনিক, আর সি মজুমদারের মতো ইতিহাসবিদ, নাজমুল করিমের মতো সমাজবিজ্ঞানীরা শিক্ষকতা করেছেন। সেকালে বিজ্ঞান এবং কলা এ দুই অনুষদের সাফল্য ছিল মোটামুটি উল্লেখ করার মতো। আবার এদিকে আধুনিককালের বিশ্ব র‌্যাংকিং চালু হওয়ার পর দেখা যায়, এর অবস্থান বলতে গেলে একেবারে প্রায় তলানিতে পৌঁছে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর মান উন্নত করা সম্ভব কিনা এবং হলে কীভাবে? এ নিবন্ধে অতি সংক্ষেপে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে সেটি আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি পক্ষ থাকে—একটি প্রশাসন, আরেকটি শিক্ষার্থী এবং অন্য আরেকটি হচ্ছে শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন কাজ পরিচালনার জন্য প্রশাসনের যোগ্যতার তেমন ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না। আবার বিশ্ববিদ্যালয়টি যে শিক্ষার্থী পায় তাদের মেধার ঘাটতি আছে বলে কোনও লোককে কখনও বলতে শুনিনি। বরং বলা যেতে পারে, দক্ষিণ এশিয়ার যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে বেশি মেধাবী শিক্ষার্থী পেয়ে থাকে, তন্মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট করেনি, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথম স্থান বা দ্বিতীয় স্থান কিংবা রেকর্ড নম্বর পেয়েছে। 

তৃতীয় যে পক্ষ তা হচ্ছে শিক্ষক। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি কি যথেষ্ট মেধাসম্পন্ন শিক্ষক পায় না? বলা যায়, অবশ্যই পায়, তবে তাদের বেশিরভাগ বৃত্তি নিয়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায় এবং পরবর্তীতে সেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বিশ্বমানে উন্নীত করতে সাহায্য করে। আর যারা খুব ত্যাগ স্বীকার করার কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যান তারা এক শ্রেণি আর যারা পৃথিবীর কোথাও সুযোগ পান না বা তলানিতে থাকা তারা আরেক শ্রেণি—এ দুই শ্রেণির শিক্ষক এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন বলে অনুমান করা যায়।

শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো দুটো কাজ করে; তারা মেধাবী শিক্ষক এবং মেধাবী শিক্ষার্থীর অভাব বিভিন্ন পশ্চাৎপদ কিংবা উন্নত দেশ থেকে পূরণ করে। বোধ করি আমাদের সে ধরনের কোনও সংকট নেই, তাই আমরা অন্য দেশ থেকে শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কোনোটাই সংগ্রহ করি না। আমরা শুধু ব্যাপকভাবে বিভিন্ন শিল্প এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় পদের ম্যানেজার আমদানি করি।

বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগের যে পদ্ধতি তা কতটা মেধাবী বান্ধব এবং কতটা বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির জন্য সহায়ক তা আলোচনা করা যেতে পারে। তাই প্রথমে আমাদের পার্শ্ববর্তী আরেকটি অনুন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো। 

ভারতে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি পরিবর্তন আনা হয়েছে। একটি হচ্ছে তারা এখন প্রভাষক পদ তুলে দিয়েছে, অর্থাৎ শিক্ষক হবে সহকারী অধ্যাপক থেকে। এর কারণ সম্পর্কে জানা যায়, একজন ছাত্র বা ছাত্রী স্নাতকোত্তর শেষ করার কয়েক দিনের মধ্যে তাকে সে বিভাগে শিক্ষক করার ফলে সে জ্ঞান অর্জন করার আগে বিতরণে লেগে যায়, যা শিক্ষার মানকে দুর্বল করে। তাই এখন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নেওয়া হয় যার কমপক্ষে পিএইচডি ডিগ্রি থাকে এবং গবেষণা থেকে অনেক প্রকাশনা থাকে। ফলে কমপক্ষে তার ৫-৭ বছরের গবেষণা এবং কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকতা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকে।

ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এপিআই (একাডেমিক পারফরমেন্স ইনডিকেটর) ব্যবহার করা হয়। যেমন—ক) জার্নালে রিসার্চ পেপার =৩০; খ) বই = ২৫; গ) রিসার্চ প্রজেক্ট = ২০; ঘ) রিসার্চ তত্ত্বাবধান =১০; এবং ঙ) কনফারেন্স, সেমিনার, ট্রেনিং ইত্যাদি = ১৫, অর্থাৎ সর্বমোট ১০০ নম্বর। এরপর নিয়োগের সময় তার উপস্থাপনাসহ তার ব্যক্তিগত সামর্থ্য দেখা হয়। এভাবে মান স্থির করে একজন শিক্ষককে নিয়োগ দিয়ে থাকে। তাই সেখানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তেমন কোনও অভিযোগ শোনা যায় না। তবে একেবারে পছন্দের ব্যাপার থাকে না তা নয়, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক বিবেচনা থাকে না।

আবার ইউরোপ বা আমেরিকায় প্রভাষক হতে হলে কমপক্ষে পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে প্রকাশনা থাকতে হয়, মৌলিক চিন্তা এবং চিন্তার নতুনত্ব থাকতে হয়, আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় সহায়তা করার সক্ষমতা থাকতে হয়। আর অধ্যাপক হওয়ার প্রথম শর্ত হলো অসাধারণ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত হতে হবে, অত্যন্ত উঁচু মানের এবং শীর্ষস্থানীয় জার্নালে প্রকাশনা থাকতে হবে, গবেষণায় সক্রিয়, গবেষণার ক্ষেত্রে পরিষ্কার এবং উঁচু দরের পরিকল্পনা এবং তা থেকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো প্রকাশনার ক্ষমতা থাকতে হবে এবং বিভাগকে আরও বিভিন্ন বিষয়ে নেতৃত্বে প্রদানের যোগ্যতা থাকতে হবে। ইউরোপ বা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্প্রতি প্রকাশিত ২৮টি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে উপরিউক্ত শর্তগুলো পাওয়া যায়। আমাদের অনেক অধ্যাপকের এমনকি ওইসব দেশের লেকচারার পদের জন্য আবেদন করার যোগ্যতাও থাকে না, নির্বাচিত হওয়ার প্রশ্ন পরে আসবে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীরা অনেকে সুযোগ পান না, আর পেলেও তাদের অনেকে আবার দেশে থাকেন না। যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যারা শিক্ষক আছেন তাদের দু’ভাবে ভাগ করা যায়, যার একভাগ হচ্ছে সম্পদ (অ্যাসেট) এবং আরেকভাগ হচ্ছে বোঝা (লায়েবিলিটি)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যাসেটগুলো আমরা কী কাজে লাগাবো এবং লায়েবিলিটিগুলোকে আমরা কী করবো? তার আগে বলতে হবে, কে ঠিক করবে কারা অ্যাসেট আর কারা লায়েবিলিটি? মনে হয় এটি দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে পারে, অর্থাৎ ছাত্ররা মিলে করতে পারে তাদের ক্লাস অ্যাসেসমেন্ট-এর মাধ্যমে, আর দ্বিতীয়টি হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে। আবার যৌথভাবেও হতে পারে অর্থাৎ ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিলে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩০-৪০ ভাগ শিক্ষক বোঝা বা লায়েবিলিটির মধ্যে পড়বে। তাহলে তাদের কী করতে হবে? এদের কি অ্যাসেটে পরিণত করা সম্ভব এবং সম্ভব না হলে কী করা যাবে? 

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এ ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা হবে ৬০০-৭০০-এর মতো, যা অন্যান্য দেশের কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের সংখ্যার সমান। তাদের হয়তো ২৫ বছর বা ৩০ বছর পূর্ণ হলে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ডেপুটেশনে তাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর পরীক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবগুলোতে তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সহায়ক গবেষক হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার রুটিন কাজ পরিচালনার জন্য ডেপুটেশনে দেওয়া যেতে পারে। ইউজিসির কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রুটিন পরিদর্শনের কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। এভাবে তাদের বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাদের বিদায় করার আগে ভাবতে হবে কীভাবে শিক্ষা প্রদান ছাড়াও অন্যান্য কার্যক্রমে লাগানো যেতে পারে। আবার এদের অনেকে এ ধরনের প্রশাসনিক কাজে বেশি আগ্রহী হবেন বলে আমার ধারণা। 

দ্বিতীয়ত, যেসব অধ্যাপক অবসর গ্রহণ করবেন, তাদের জায়গায় আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে অধ্যাপকের পদ পূরণ না করে এখন থেকে সরাসরি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূরণ করা যেতে পারে, যাতে এ পদে যেতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশের বাইরে বাংলাদেশের যেসব কৃতী ব্যক্তি রয়েছেন তারা যেন আবেদন করতে ও যোগদান করতে পারেন, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। আপগ্রেডেশন কেবল সহযোগী অধ্যাপক পদ পর্যন্ত চালু রাখা যেতে পারে, কোনোভাবে অধ্যাপক পদের জন্য তা প্রযোজ্য হবে না।        

তৃতীয়ত, অন্তত ২০% নতুন সংরক্ষিত বা লেটারেল এন্ট্রি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে এসব পদের কোনও লেকচারার পদের এন্ট্রি থাকবে না। এ পদগুলো সরাসরি নিয়োগের জন্য ইউজিসি থেকে নির্দিষ্ট করা থাকবে এবং ইউজিসি তাদের নিয়োগটি তত্ত্বাবধান করবে। এদের জন্য আলাদা জব ডেসক্রিপশন থাকবে। এরা শিক্ষকের মোট সংখ্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে না। এদের ইউজিসি অধ্যাপক বা গবেষণা অধ্যাপক নামক পদ দেওয়া যেতে পারে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক প্রকাশনার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করবে। তাদের পদমর্যাদাও গ্রেড-১ থাকবে। 

চতুর্থত, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জার্নালগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পাদনা পরিষদ নিয়োগ করতে হবে, কারণ তা হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান ও মুখপাত্র। আর এসব জার্নাল আন্তর্জাতিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে প্রকাশের জন্য প্রদান করতে হবে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমবে। বর্তমানে এসব জার্নালে কিছু কিছু প্রবন্ধের মান ভালো হলেও তা মূলত অত্যন্ত নিম্নমানের প্রবন্ধে ভরা থাকে। শোনা যায়, এগুলো মূলত শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য প্রকাশ করা হয়। এবং সাধারণত এগুলোর কোনও আন্তর্জাতিক রিভিউয়ার থাকে না, ভাষাগত দুর্বলতাও লক্ষণীয়। আবার এসব জার্নালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হলে তার লেখাও জমা নেওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়টির জার্নালে কোনও বিদেশি শিক্ষক বা গবেষকের কোনও প্রবন্ধ কখনও প্রকাশ হয়েছে বলে জানা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বিশ্বমানের করার জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে কোনও চাহিদা আছে কিনা? শিক্ষকদের মুখে এ ধরনের কোনও কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না বরং এ প্রসঙ্গ এলে অনেকে খুব বিরক্ত হন। আর শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে যারা ছাত্র রাজনীতি করেন, তাদের মুখে তা শুনা যায় না। আর বর্তমানে সাধারণ ছাত্ররা কেবল বিসিএস গাইড পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বিশ্ব র‌্যাংক প্রকাশিত হলে সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে মৌসুমি বিষয়ের মতো দুয়েকদিন আলোচনা করেন। তাহলে যেখানে ছাত্র-শিক্ষক কারোরই তার মান বাড়ানোর মাথা ব্যথা নেই, স্বভাবতই, প্রশ্ন আসে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! তুমি কার?’

বিশ্ববিদ্যালয়টি মূলত এদেশের খেটে খাওয়া মানুষদের যাদের টাকায় এটি চলে। তাই কারও দাবি না থাকলেও সাধারণ মানুষের দাবি রয়েছে, যেন বিশ্ববিদ্যালয়টি যথাযথভাবে বিশ্বমান বজায় রেখে চলে। তাদের সন্তানেরা যেন বিশ্বমানের শিক্ষা পায় এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনও গবেষণা নীতিমালাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে কোনও বার্ষিক গবেষণা পরিকল্পনা বা প্রকাশনা পরিকল্পনা নেই। শিক্ষকদের কাছ থেকে এ ধরনের কোনও কিছু কর্তৃপক্ষ সংগ্রহ করে না। তাই এর জন্য সরকারের কাছ থেকে কোনও বরাদ্দ পাওয়ার আশা করে না। কার জন্য দেবে, কত টাকা দেবে, কোন খাতে দেবে, কেন দেবে? সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত থেকে তারা কোনও অর্থ সংগ্রহ করার চেষ্টা করে না, অ্যালামনাইদের থেকেও কোনও অর্থ সংগ্রহ করে না বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্টের ব্যবস্থা রাখে না। বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবসহ ভবনগুলো অনেক কোম্পানি তৈরি করে দেয়, কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তবে প্রতি বছর অভিযোগের জবাবে সম্মাননীয় শিক্ষকেরা কেবল অর্থ বরাদ্দ পান না বলে দাবি করেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিশ্বমানের করার জন্য দেশের মানুষ যেকোনও ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি হবে বলে আমার বিশ্বাস। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির এসব সমস্যার সমাধান করার জন্য যা করণীয় তা হচ্ছে—১) নিয়োগের মানদণ্ড পরিবর্তন করতে হবে যেমন, পিএইচডি ও যথেষ্ট মানসম্মত কয়েকটি প্রকাশনা ছাড়া লেকচারার পদে নিয়োগ প্রদান না করা; সম্ভব হলে সহকারী অধ্যাপক পদ থেকে নিয়োগ প্রদান শুরু করা; ২) একটি ত্রি-বার্ষিক লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে; ৩) প্রতি বছরের জন্য গবেষণা ও প্রকাশনা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে; ৪) সে পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে; ৫) অধ্যাপক পদে কোনও আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া যাবে না; ৬) অন্তত ২০% নতুন ইউজিসি অধ্যাপক বা গবেষণা অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করতে হবে; ৭) নতুন সৃষ্ট গবেষণা অধ্যাপকদের জন্য বিশেষ বেতন কাঠামো প্রদান করতে হবে এবং মর্যাদার দিক থেকে গ্রেড -১ মর্যাদা দিতে হবে; ৮) প্রকাশনা বিভাগে আন্তর্জাতিক মানের সম্পাদক নিয়োগ দিতে হবে যারা শিক্ষকদের তৈরিকৃত প্রবন্ধ বা বইয়ের ভাষাগত সম্পাদনা করে দেবেন, কারণ এর অভাবে অনেক ভালো গবেষণা বিদেশি ভালো জার্নালে প্রকাশিত হয় না; ৯) জুনিয়র শিক্ষকদের তৈরিকৃত প্রবন্ধ বিদেশি ভালো জার্নালে প্রকাশের জন্য সহায়তা প্রদান করা সিনিয়র শিক্ষকদের দায়িত্বের মধ্যে দিতে হবে; ১০) বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জার্নালগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পাদনা পরিষদ নিয়োগ করতে হবে এবং তা বিদেশি বিখ্যাত প্রকাশককে প্রকাশের জন্য দিতে হবে যাতে এর জন্য বাড়তি খরচ করার কোনও প্রয়োজন না পড়ে; ১১) প্রতি বছর বিদেশে সেমিনার/ কনফারেন্স-এ প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য একটি বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে; ১২) বিদেশের ওপর নির্ভর না করে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের উচ্চতর শিক্ষার বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে; ১৩) শিক্ষার্থীদের গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশের বিষয়ে সহায়তা দিতে হবে; ১৪) বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণের জন্য একটি কর্মসূচি থাকতে হবে, যাতে আগামী তিন বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ দেশের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে পারে; ১৫) প্রতি বছর অন্তত একজন করে প্রতি বিভাগে স্বল্পমেয়াদি (২-৩ মাস) ভিজিটিং প্রফেসর আনার বরাদ্দ দিতে হবে এবং একজন নোবেল লরিয়েট বা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত একজন পণ্ডিতকে প্রতি বছর সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। 

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট।

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ