X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

খিচুড়ি গল্প, আমাদের সাংবাদিকতা ও জাতীয় মানসিকতা

ড. মো. নাদিরুজ্জামান
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:০৩আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:৩১

ড. মো. নাদিরুজ্জামান গতকাল ফেসবুকের কল্যাণে যখন খিচুড়ির গল্পটা প্রথমে দেখলাম, আমার কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। প্রথমে মনে হয়েছে যে কেউ হয়তো এটা এক রকম স্যাটায়ার হিসেবে লিখেছেন। খিচুড়ি রান্না শেখার জন্য কেউ দেশের বাইরে যেতে পারেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের কেউ, যে দেশে খিচুড়ি সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারগুলোর অন্যতম! এই খাবার আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। বৃষ্টি হলে খিচুড়ি, সঙ্গে ইলিশ ভাজা‌ বা গরুর ভুনা, তাও না হলে ডিম ভাজি অথবা পেঁয়াজ শুকনা মরিচ আর সরিষার তেলের মাখা, কার না প্রাণের খাবার? খিচুড়ি নিয়ে যে দেশের মানুষের এত আয়োজন, সে দেশের মানুষ খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশে যাবে, এটা চিন্তাই করা যায় না। যাই হোক, আমি অনাগ্রহী হলেও, ফেসবুকে যেসব নিউজফিড আসে সেগুলো একটু দেখার চেষ্টা করলাম এই খবরটা প্রথমে কোন উৎস থেকে প্রচার হয়েছে।
একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে যেটা বুঝতে পারলাম যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তারা স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে পুষ্টি ব্যবস্থাপনা বিষয়টা বোঝার জন্য বিদেশের স্কুলে ভ্রমণ করতে চান বা তার জন্য বাজেট ধরা আছে, যেটা প্ল্যানিং কমিশন এসেছে এবং একনেকে এখনও পাস হয়নি। আমাদের ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ সাংবাদিক এই ঘটনাটাই শুধুমাত্র খিচুড়ি রান্নার কেন্দ্রিক গল্প বানিয়ে তার বাজারজাতকরণ করেছে। ভালোই যে বাজারজাতকরণ হয়েছে তা ফেসবুকের ওয়ালে একবার চোখ বুলালেই বোঝা যায়। 

আর বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে সরকারি প্রকল্পগুলোতে বিদেশ যাওয়া বা অতি উচ্চ মূল্যে জিনিসপত্র কেনার গল্পগুলো এখন যেহেতু বাজারে সয়লাব, তাই আমরাও গল্পটিকে লুফে নিয়েছি। নিজের দায়িত্ব মনে করে ট্রল করছি সরকারি কর্মকর্তাদের বিষোদগার করছি। পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপরে আমাদের রাগ-ক্ষোভের পরত এতটা পুরু যে, আমরা এখন কোনও সংবাদ পেলে যাচাই করার প্রয়োজন মনে করি না। ক্ষমতাসীন মহলের যে কোনোরকম অবিশ্বাস্য অপকর্মকেও সহজ স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আমরা অর্জন করে ফেলেছি।

সাংবাদিকতার অর্থ যে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ তা আমরা ভুলতে শুরু করছি। সাংবাদিকতার প্রবাদ বাক্যই এখন যেন এমন– ভালো খবর কোনও খবরই না। অর্থাৎ যেকোনও খবরে খারাপ কিছু থাকতে হবে, চমক থাকতে হবে। এই সাংবাদিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সময় এসেছে। এই খিচুড়ি প্রসঙ্গে যদি সাংবাদিক এটাকে স্কুল ফিডিংয়ের প্রোগ্রাম হিসেবেই ব্যাখ্যা করতেন এবং বিদেশযাত্রার জন্য এই অর্থ খরচের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করতেন, তাহলে এই সংবাদের হয়তোবা একটা ভিন্ন আবেদন থাকতে পারতো। 

কথাটি এজন্য বলছি যে গত প্রায় এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম চলছে। আমাদের যেসব সরকারি কর্মকর্তা অতীতে প্রোগ্রামের আওতায় বিদেশে গিয়ে জ্ঞান নিয়ে এসেছেন, গত ১০ বছরে তাদের দক্ষতা কি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়নি যাতে তারা প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতে পারেন। কিংবা এ প্রোগ্রামের মান উন্নয়নের হাল ধরতে পারেন? অথবা গত দশ বছরে এই প্রকল্পের সাফল্যই কতটুকু? এ বিষয়গুলো আমরা কোনও আলোচনায় পাইনি, পেয়েছি খিচুড়ির গল্প, যা মূল প্রসঙ্গকে স্পর্শ করেনি।

আমাদের একটি স্বাভাবিক মানসিকতা হলো কোনও একটা বিষয়কে একটু গভীর পর্যালোচনা না করে, বরং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে খেলোভাবে উপস্থাপন করা। এই খিচুড়ি গল্প তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমি জানি না এই হুইসেল ব্লোয়ার সাংবাদিক কখনও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সরকারের নীতি নির্ধারণী কাজে জড়িত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যাদের অর্থের জোগান আসে করদাতাদের কাছ থেকে, তাদের বাজেটের বরাদ্দ এবং খরচের খাত নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, বা অনুসন্ধানী রিপোর্ট করবেন। কারণ, সে সাহস, সে মানসিকতা, সেই চেতনা, আমাদের কখনও তৈরি হয়নি, তৈরি হওয়ার কোনও সুযোগও তৈরি হয়নি।

বিদেশ শব্দটা এবং বিদেশ যাত্রাটা সাংস্কৃতিকভাবেই আমাদের কাছে একটা অনেক বড় আকাঙ্ক্ষার অংশ। আমি খুব বেশি মানুষ দেখিনি যে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে সেটাকে লুফে নেননি বা অখুশি হয়েছেন। আমি আমার প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে এনজিও আর একাডেমিয়াতে কাজ করেছি। দু’টো জায়গায়ই, আমরা যখন কোনও গবেষণা করেছি অথবা মাঠ পর্যায়ে কোনও কাজ করেছি, আমাদের সে কাজের অর্জনটা আমরা প্রকাশ বা প্রচার করতে চেয়েছি বিদেশের কোনও ওয়ার্কশপে বা সেমিনারে। এটা একটা অদ্ভুত সংস্কৃতি। আমার এক বন্ধু মজা করে এটাকে বলেছে দেশের সিনেমার আন্তর্জাতিক শুভমুক্তি। আশা করি আমরা এই অদ্ভুত সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো।

সবাই সুস্থ থাকুন। সুখী সমৃদ্ধ ও নিরাপদ হোক আমাদের জীবন। 

লেখক: সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, হামবুর্গ ইউনিভার্সিটি

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ