X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে তিনি গল্প লেখেন

মোস্তফা তারিকুল আহসান
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:২৭আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:৩৫

মোস্তফা তারিকুল আহসান এ কথা ঠিক যে কাজী আনিস আহমেদ যে গল্প লিখেছেন, তা তাঁকে একজন উঁচুমানের গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে; তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি, যুক্তি-তর্ক-ব্যাখ্যা, বিষয়বস্তুর নতুনত্ব, পরিবেশ ও সমকালের সংযুক্তি, নাটকীয়  উপস্থাপনা এবং সৃজনপ্রক্রিয়ার সূক্ষ্ম ও সংবেদী সংশ্লেষ তাঁর গল্পের চরিত্রকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। আবার এটাও ঠিক যে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের যে আলোচনা চক্র, সেখানে তিনি প্রায় অনুপস্থিত। ইংরেজি ভাষায় লেখা ও দেশের বাইরে, বিশেষত আমেরিকাতে প্রকাশিত গল্প বাংলাদেশের পাঠকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারেনি। এমনকি ডায়াসপোরা সাহিত্য নামে পরিচিত ভূগোলেও তাঁকে রাখার জন্য সমালোচককে কিঞ্চিত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয়। দশকওয়ারি আলোচনায়ও তাঁকে নব্বই বা আশি বা অন্য কোনো দশকে ফেলা মুশকিল। অনুবাদের হাত ধরে তিনি আমাদের কাছে পৌঁছেছেন বলে তাঁর সাহিত্যকে অনুবাদ সাহিত্য বলার কোনো কারণ নেই। কারণ, তিনি তো এদেশীয় লেখক এবং তাঁর লেখার অনুষঙ্গও বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির জীবনসংলগ্নতা নিয়ে। এইসব প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়তো আমাদের হাতে নেই, তবে তাই বলে তার রচিত কথাসাহিত্য বা গল্প তার গুরুত্ব হারায় না। শ্রেণীকরণ যারা করবেন বা যারা নৈয়ার্কিক শৃঙ্খলার দায়িত্ব নেবেন, তাঁদের দিকে একজন লেখক বা শিল্পীর তাকিয়ে থাকার তো কোনো প্রয়োজন নেই।

বিশ্বের ছোটগল্পের যে পরিসর, তা বিস্ময় জাগায় পাঠককে। রাশান গল্প থেকে আমেরিকান বা লাতিন গল্প বা আমাদের বাংলা গল্পের সমৃদ্ধ ভুবনের কথা মনে রাখলে দেখা যাবে নতুন গল্পকারের জন্য সত্যিকার অর্থে ভালো গল্প লেখা দুরূহ; তবু গল্প তৈরি হচ্ছে-চলমান জীবনের, অপস্রিয়মাণ জীবনের নানা টুকরো আর গভীর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাত লেখকেরা এগিয়ে যাচ্ছেন নতুন ফসলের ধারা বইয়ে দেবার জন্য। ন্যারেশনের নতুন পাঠ নিচ্ছেন লেখক-কখনো জনজীবনের নানা কিস্‌সা থেকে কখনো ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের নব অনুশীলনজাত অভিজ্ঞান থেকে। আনিস মার্কিন মুলুকে থাকার সময় সে দেশের এবং সমসাময়িক গল্পকারদের লেখা ব্যাপকভাবে পাঠ করার সুযোগ পেয়েছেন এবং নিজেকে লেখক হিসেবে তৈরি করার সময় সেসব লেখকের লেখাকে মান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। একই সঙ্গে পৃথিবীর সেরা লেখকদের সঙ্গে তার লেখা ছাপা হয়েছে। মিনেসোটা রিভিউ-এর স্প্রিং ২০০০ সংখ্যায় তাঁর প্রথম গল্প ‘ফোর্টি স্টেপস’ প্রকাশিত হয়। ওই সংখ্যায় কার্লোস ফুয়েন্তেস এবং উইলিয়াম গ্যাসের লেখাও ছাপা হয়। তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে নামী প্রকাশনী থেকে (র‌্যান্ডম হাউস/ভিনটেজ)। এসব তথ্য জানার পর মনে হতে পারে বাংলাদেশের পাঠকেরা কাজী আনিসের প্রতি একটু অবিচারই করেছেন।

নয়টি গল্পের অনুবাদ নিয়ে কাজী আনিসের গ্রন্থ ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার ও অন্যান্য গল্প’ ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে বের হয়। এর আগে বইটি ইউপিএল বের করেছিল ইংরেজিতে ২০১২ সালে এবং ২০১৪ সালে আমেরিকা থেকে বের করে দ্য আননেমড প্রেস। বাংলায় খুবই চমৎকার অনুবাদ করেছেন মুহম্মদ মুহসিন। বাংলাদেশেই বইটি প্রথম প্রকাশিত হলেও এটি খুব আলোচিত হয়নি। সেটা এ কারণে হতে পারে যে এ দেশে বাংলাদেশিদের ইংরেজিতে লেখা বই পড়ার বা গুরুত্ব দেবার চল নেই। তবু আমার ধারণা, যাঁরা প্রকৃত পাঠক তাঁরা হাতে গোনা হলেও বইটি পড়েছেন। আমার এটাও মনে হয় যে মুহম্মদ মুহসিন যে অনুবাদ করেছেন, তা গ্রন্থটিকে বাংলা গল্পের সংকলন হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। যাহোক, নয়টি গল্পের বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, আনিস বাংলাদেশ বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গল্পের বিষয়বস্তু করেছেন, যার কেন্দ্রে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আমেরিকার পটভ‚মিতে রচিত গল্পের বিষয়বস্তুও মূখ্যত বাংলাদেশ। এটা ঠিক যে বাংলা ক্ল্যাসিক গল্প বা সমসাময়িক বাংলা ছোটগল্পের উঁচুস্তরের যে শরীর, তা থেকে আনিসের গল্পের পার্থক্য চোখে পড়বে। আগেই বলেছি, তিনি শক্তিমান কথাকার। তবে তিনি ঠিক বাংলাদেশের বা পশ্চিম বাংলার বাংলা গল্পের লেখকদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেননি বা চাননি। তিনি চৌকস গল্প লিখেছেন; গল্পের কাছে পাঠকের যে দাবি তা সব মিটিয়েছেন, তবে একটা সূক্ষ্ম ভেদরেখা রয়ে গেছে। সেটি আমার ব্যক্তিগত মতও হতে পারে, অন্য পাঠক কী মনে করবেন আমি বলতে পারব না। তিনি যে ঢাকা শহরের বিষয় নিয়ে গল্প লিখেছেন, তাঁর সমসাময়িক কেউ এভাবে গল্প লেখেননি। তাঁর বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা আলাদা; তাঁর পর্যবেক্ষণও তাঁর মতো। মার্কিন মুলুকে দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে বাংলাদেশ বা ঢাকা সম্পর্কে তাঁর স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ হয়েছে বলে মনে হতে পারে। তবে তিনি যে অভিজ্ঞানসূত্র ব্যবহার করেছেন, তাতে কোনো খাদ নেই। গল্প বলার সময় তিনি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে প্রসঙ্গকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন।

কথক কাজী আনিস যে দৃঢ় স্বর নিয়ে, তথ্য যুক্তি-তর্ক-ব্যাখ্যা ও উইটের সমাহারে তার বয়ানপ্রক্রিয়া শুরু করেন, সেখানে মানবিক বিষয় গুরুত্ব পেলেও বাঙালির সাধারণ আবেগকে তিনি খুব বেশি পাত্তা দেননি। তাঁর দেখা জীবনযাপন ও সংস্কৃতি নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের ঠিক নয়, প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত অথবা উচ্চবিত্তের দিকে ধাবিত। ঢাকা শহরে স্বাধীনতার পর হঠাৎ ধনী হতে থাকা শ্রেণিকে তিনি বেশ গভীরভাবে স্পর্শ করতে পেরেছেন (আমার শত্রু বা ফেরার বছর)। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহের বিষয়টি চোখে পড়ে, যদিও তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধ সরাসরি দেখেননি। তবু তাঁর নিজস্ব অনুভব আর পঠিত জ্ঞান বা শ্রুতি থেকে নেয়া অভিজ্ঞতা এবং তাঁর নিজস্ব পক্ষপাত তাঁর রচনাকে ঋদ্ধ করেছে। ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার’ গল্পেও আমার দেশের প্রতি তাঁর গভীর আত্তির বিষয় লক্ষ করা যায়। তাঁর গল্পজুড়ে রয়েছে তাঁর নিজের পাঠজাত সাহিত্য ও শিল্পরুচির পরিচয় আর এর সঙ্গে তিনি প্রসঙ্গক্রমে জুড়ে দিয়েছেন তাঁর প্রিয় লেখকদের মত ও তাঁদের সাহিত্যপরিচয়। বিশ্বসাহিত্যের নিবিড় পাঠ ও পরিচয়সূত্র তাঁর সাহিত্যরুচিকে স্নাত করেছে। ‘রামকমলের উপহার’ গল্পে কাজী আনিস তাঁর নিজের স্থান, রুচি ও শক্তির পরিচয় দিতে পেরেছেন বলে আমাদের মনে হয়। ‘চামেলি’ ও ‘আয়েশাকে হারাবার পর’ মূলত দুটো প্রেমের গল্প। তবে কাজী আনিস খুব সচেতন লেখক বলেই বোধ করি প্রেমের গল্প স্রেফ প্রেমে সীমাবদ্ধ থাকেনি, যুক্ত হয়েছে সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গ। ‘চামেলি’ গল্পে একাত্তর সালের ভয়ংকর বাস্তবতা গভীরভাবে উপস্থাপিত; নানা প্রসঙ্গকে একসূত্রে গাঁথার ক্ষেত্রে যে মণ্ডনপ্রক্রিয়া তিনি ব্যবহার করেছেন, তা শিল্পের উত্তীর্ণ রসে রঞ্জিত হয়েছে।

ছোটগল্পের লেখকমাত্রই জানেন যে গল্পটা খুব সামান্য উপাদান এবং কম গুরুত্বপূর্ণ এমনকি ইদানীংকালে গল্পহীন ছোটগল্পও লেখা হচ্ছে। তবু কাহিনি বা গল্পের একটা রেখা প্রায় সব ছোটগল্পে থাকে। সেই অল্প কাহিনি বা গল্পকে বিস্তার করে দেবার নানান কৌশল রপ্ত করতে হয় লেখককে। সোজা কথায় বড় ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে হয়ে তাঁকে। আবার সেই ফাঁকা জায়গা আর্বজনা দিয়ে পূরণ করার সুযোগ নেই, নেই নানা ক্যারিকেচার জুড়ে দেবার। সেগুলো জুড়ে দিয়ে রচনাকে মাটিতে নামিয়ে আনার ভূরি ভূরি উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। আবার যে লেখক ঘটনা ছাড়া আগাতে পারেন না তিনি যে আদতে লেখক নন, সেটা স্বীকার্য। এই ক্ষেত্রে লেখকের শক্তি ও সৃজনক্ষমতার পরীক্ষা হয়ে থাকে এবং গল্পের মান বা ভালো-মন্দও নির্ভর করে এই শূন্যস্থান পূরণ করার মুনশিয়ানার ওপর। এখানেই লেখক তাঁর রচনাকৌশল কাজে লাগান আর যার জন্য তিনি স্বতন্ত্র লেখক হিসেবে আবির্ভূত হন। কাজী আনিস আহমেদের ছোটগল্পের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করব যে তিনি গল্প বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্ক থেকেছেন; সময়কে ব্যবহার করেছেন নিপুণভাবে এবং ঘটনাকে প্রাধান্য না দিয়ে চরিত্র, বিষয় ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ বা পটভূমিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। এর সঙ্গে মানবস্বভাবের নানা বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন; নানা সিকোয়েন্স বা প্রসঙ্গকে বিভিন্ন তল থেকে আলোকিত করার প্রয়াস নিয়েছেন। তিনি কাহিনি বর্ণনা করার মতো সহজ পথ কখনো গ্রহণ করেননি, এটা তার বড় শক্তির পরিচায়ক। তবে যেটুকু গল্প বলার দরকার সেটুকু বলেছেন পরিস্থিতির নানা রকম তাৎপর্যকে সমন্বিত করে। এটা করতে গিয়ে তাঁর প্রধান সহায়ক হয়েছে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ, তীর্যক মন্তব্য বা স্যাটায়ার এবং যুক্তি-তর্ক-মননের সমবায়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা।

গল্প লেখার সময় তাঁর প্রস্তুতি যে গভীর, সেটা বোঝা যায়। একটি সাদামাটা বিষয়কে তাৎপর্যময় করে তোলার জন্য যা যা প্রয়োজন তিনি করেছেন। গল্পের বিষয়বস্তুর একটা দার্শনিক ভিত্তি দেবার যে চেষ্টা তিনি করেছেন, সেটাই গল্পটিকে পাঠকের মননে স্থান করেছে। বিষয়কে চারপাশ থেকে দেখে এবং তাকে নানা আলোয় আলোকিত করে, মানবিক বা হার্দ্যকি বিবেচনায় যাথার্থতা দিতে পেরেছেন। ‘চামেলি’ মূলত কিশোর-কিশোরীর অচরিতার্থ একটি প্রেমের গল্প। গালিব নামের একটি ছেলের সঙ্গে তার পাশের বাড়ির পাঞ্জাবি মেয়ে চামেলির যে গভীর সম্পর্ক, সেটাই যদি লেখক একমাত্র অনুষঙ্গ মনে করতেন, তাহলে এটা নিছক একটি কিশোর প্রেমের গল্প হয়েই থাকত। কাজী আনিস বরং এটাকে নতুন সোপানে নিয়ে গেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি খুব সাবধানে কথা বলেছেন। কারণ, ভিন্ন প্রসঙ্গ ব্যবহারে মূল বিষয়ের গুরুত্ব হ্রাস পেতে পারে। বর্ণনার কৌশল নিয়ে লেখকের রচনা থেকে উদাহরণ দেয়া যেতে পারে : ‘গালিব দিনে দিনে চামেলিকে আবেগের চোখের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধির চোখেও দেখতে শিখেছে। তার চোখে চামেলি এখন পূর্ণরূপে প্রতিভাত। সে অনুভব করতে পারে, চামেলি এখন আর বর্ণচ্ছটার কোনো রূপ নয়। অবশ্য তারপরও চামেলির সৌন্দর্য এখনও তাকে অবাক করে। তার দুই অনুপম কর্ণলতিকা, উচ্চহাসির সময় তার কণ্ঠের কম্পমান সাংগীতিক মূর্ছনা, তার খোলা চুলে রোদের আলোর খেলা-সবই গালিবকে এখনো সমান আনন্দে অবাক করে। চামেলি এখন তার ভাবনায় এতটুকু কাছে পৌঁছেছে যে সে এখন কল্পনা করতে পারে সে চামেলিকে আদরে আবেগে কাছে টানছে এবং গভীর চুমু খাচ্ছে। এটি এখন আর তার কল্পনা নয়, বরং গভীর কামনা। তবে বয়সের প্রথম জোয়ারে  দিনে রাতে শরীরজাত যে প্রচণ্ড অন্ধকার ভাবনাগুলোকে তাড়া করে অন্ধকারের সে ভাবনার জগৎ থেকে গালিব এখনো চামেলিকে দূরে রাখে।’ (পৃ-১৫)

‘আয়েশাকে হারিয়ে’ একজন যুবকের দুর্দান্ত প্রেমের গল্প। যুবকের সঙ্গে আয়েশার গভীর প্রেম, শারীরিক সম্পর্ক  এবং একদিনের একটি দুর্ঘটনার কারণে তৈরি হয় দূরত্ব। আয়েশা চলে যায় লন্ডনে পড়াশোনা করতে। আয়েশাকে হারানোর পর যুবকের নতুন জীবন শুরু হয়। তার অর্থকড়ি হয়, আয়েশাদের যেখানে বাড়ি সেই বনানীতে সে নিজস্ব বড় এপার্টমেন্টে থাকে, সাত বছর আয়েশাহীন থাকার পর সে বহু নারীর সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেও কাউকে আর নিজের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারেনি। বাবার চাকরিতে ক্রমে অবনতিতে একসময় তারা বনানী ছেড়ে উত্তরায় চলে যায় : দারিদ্র্যের কষ্ট তাকে খুব ভাবিত করে না যখন সদ্য লন্ডন থেকে ফেরা বন্ধু রাজিবের বাড়ির পাশে আয়েশার সঙ্গে গভীর পাগল করা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। ছাদে আয়েশার ছোট ভাই নুমায়ের ঘুড়ি ওড়ায় আর আয়েশা ও যুবক প্রেমের পর্ব পরিপূর্ণ করে। একদিন তাদের চূড়ান্ত শারীরিক উত্তেজনার মুহূর্তে তারা নুমায়েরকে লক্ষ করতে না পারলে সে ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। আয়েশা তাকে বাঁচায়। সে বলে যে সে ছাদে ছিল না। তবে কথাবার্তা ও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এইটুকু গল্প। এই গল্প সাজানো থেকে শুরু করে মূল চরিত্রের মানসিক যন্ত্রণা, আয়েশার চরিত্রের বহুধা বৈচিত্র্যময় রূপ, ঢাকার জীবনযাত্রা এবং মানবজীবনের গভীর তাৎপর্যকে অনুপুঙ্খ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিনিপুণতা আনিস গ্রহণ করেছেন, তা এক কথায় অসামান্য। তিনি প্রেম, সংরাগ, বিরহ এবং যুবক-যুবতীর শারীরিক সম্পর্কের গভীরজাত এষণাকে যেভাবে ভাষ্যরূপ দিয়েছেন, সে হিসেবে লেখকের গভীর অনুধ্যানের প্রশংসা না করে উপায় নেই। সামান্য একটি ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ একটি গল্প তিনি লিখেছেন : সময়, ঘটনা, প্রেক্ষাপট, যুবকের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা কিংবা তার প্রতিটি মুহূর্তের চেতনাকে যুক্তি-দর্শন ও বিবেচনার আলোকে যে ব্যাখ্যা কাজী আনিস দিয়েছেন, তাতে পাঠক পরিপূর্ণ উপলব্ধির জগতে চলে যান। ঘটনা বা প্রসঙ্গগুলো তিনি শুধু আগে বা পেছনে নিয়ে গল্পের নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেননি; বরং প্রেমের গল্পটিকে মানবচরিত্রের সতত স্বভাবজাত প্রপঞ্চ মনে করে তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার যাবতীয় চেষ্টা করেছেন, যা সৃজনশীলতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন; উপযুক্ত প্রসঙ্গ ও উদাহরণ খুঁজে বের করেছেন। বোঝা যায় গল্পটি লেখার সময় একটি ভালো পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এগিয়েছেন, যাতে যুবক-যুবতীর প্রেম-সংসর্গের গল্পটি একটি চিরন্তন ও ক্ল্যাসিক গল্পের মর্যাদা পায় এবং একই সঙ্গে পাঠক গল্পের সমস্ত আয়োজনে নিজেকে আনন্দের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারে। প্রেমিক যুবক আয়েশাকে হারিয়ে নিজের জীবনের পরিস্থিতি নিয়ে এক গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছেছে; এটা নাটকের মতো মোক্ষাম বা ক্যাথারসিস ধরা যায়। লেখক এক জায়গায় দার্শনিক নিৎশের সাহায্যে তার চরিত্রের অবনমন বা বিচলিত হয়ে ওঠার অবস্থাকে বোঝাকে চেষ্টা করেছেন : ‘নিৎশের বইয়ের মধ্যে এটি আমার সবচয়ে প্রিয়। ভাববাদিতার ওপর এ বইয়ের সরাসরি এবং যন্ত্রণাকাতর আক্রমণটা আমি বেশ উপভোগ করি। এই আক্রমণের সামনে ভাববাদ এবং ভাববাদীদের খুব অসহায় মনে হয়। এই বইয়ের মানুষটির রাগের সঙ্গে আমার খুব মিল ছিল। তবে তার সমস্যার অনেকগুলোই আমার নয়, যেমন সিফিলিস, পাগল পরিচয়, অল্প বয়সে মৃত্যু ইত্যাদি। বেচারার তো ভীষণ দহন ও যন্ত্রণা যে ছিল! আমার ভালো লাগল তার বাক্যগুলোর অস্থিমজ্জায় মিশে যাওয়া অভিব্যক্তির প্রচণ্ডতা ও তীব্রতা।... ছোটবেলায় আমার খুব সাধ হতো আমি একজন দার্শনিক হব, নিদেনপক্ষে একজন লেখক। শেষ পর্যন্ত আমি লেখকের ধারেকাছেও পৌঁছাইনি। আমার আছে বড়জোর একখানা খাতা, যা দিয়ে আমার নিঃসঙ্গতার চড়াইটুকু আমি ধরে রাখি। তবে আমার মনে হয় সেই ধড়িবাজ লোকগুলো, যারা প্রতিবছর একেকখানা খাতাকে বই বানিয়ে লেখকের নাম বাগায়, তাদের চেয়ে আমার জীবনটা অনেক যোগ্যতরভাবে একজন লেখক জীবন। নিৎশের গালি খাওয়া ওই দার্শনিকদের চেয়ে তারা অনেক নিচের।’ মূলত আনিস যুবকের যাপিত জীবনে ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতাকে শিল্পের নিরিখে বিবেচনা করার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে অভিজ্ঞতাহীন শিল্পমানহীন সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। ইবিদ স্টোরে যুবকের পঠনপাঠনজাত যে অভিক্ষা তা তার সত্তাকে চিনতে সহায়তা করে, নিজেকে জানার, নিজের কর্মকাণ্ডকে বুদ্ধিবিবেচনার আলোকে চিনতে সহায়তা করে। শেষের দিকে যুবকের যে উপলব্ধি হয় সেটা আরও গভীর। আনিস এভাবে প্রেমের গল্পকে মানবজীবনের সারস্বত সত্তা ও বোধের দ্বারা উজ্জীবিত এক চিন্ময় উপলব্ধির দিকে নিয়ে যান। আর গল্পটি হয়ে ওঠে জীবনের এক দার্শনিক ব্যাখ্যার গভীর ও শাশ্বত পাঠ, যা ক্রমসম্প্রসারিত মানবসংবেদের এক অভাবনীয় পরিচয়কে ধারণ করে। এখানেই বোধ করি আনিস তার শিল্পবোধ ও শক্তির সর্বোচ্চ পরিচয় দিতে পেরেছেন।

কাজী আনিস আহমেদ নিঃসন্দেহে ‘রামকমলের উপহার’ এই গ্রন্থের সেরা গল্প। সেরা গল্প এই জন্য যে এখানে আনিস তাঁর লেখকসত্তাকে সবচেয়ে সার্থকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন এবং তাঁর নিজস্ব শিল্পবোধের পরিসর ও মাত্রাকে চিনিয়ে দিতে পেরেছেন। গল্পের কাঠামো  হয়তো এখানে বড় নয় তবে যে শিল্পদর্শন তিনি এখানে অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়েছেন, তা গল্পটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। একধরনের উদ্দীপনাকে অন্বিষ্ট করে তিনি গল্পটি শুরু করেছেন : ‘এখনো পৃথিবীর অলিখিত সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসটির গ্রন্থকার হওয়ার দাবিদার রামকমল নয় মাস হলো নিখোঁজ হয়ে গেছে। সে চিরতরে নিখোঁজ কি না, এ ব্যাপারে আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তবে নয় মাসের মতো দীর্ঘ সময় কেউ নিজেকে ইচ্ছে করলে লুকিয়ে রাখতে পারার কথা নয় বলেই নিখোঁজটা চিরতরে মনে হচ্ছে। নয় মাস ধরে তার সঙ্গে আমাদের কারও দেখা নেই। আমাদের কাছের দূরের কারও সঙ্গে নয়। তারপরও আমরা আশা ছাড়তে চাইলাম না। সম্ভবত এই আশা রামকমলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা থেকেই শুধু উদ্ভূত নয়। আমরা মরিয়া হয়ে আশা করেছিলাম, আমরা দেখব সেই রহস্যময়ী উপন্যাসটির পরিণতি কী ঘটে, যেটা লেখার যোগ্যতা রামকমলের পুরোপুরি ছিল বলে আমরা ভাবতাম।’ এভাবে প্রেক্ষণবিন্দু ব্যবহার করে আনিস এই গল্পটি শুরু করে পাঠককে যুক্ত করে ফেলেন এক রহস্যময় গল্পের সঙ্গে। ঢাকা শহর এবং এর মানুষদের নিয়ে একটি বিগ ন্যারেটিভ বা ম্যানুয়াল বা মহা-উপন্যাস লেখার যে পরিকল্পনা রামকমল করে, তা তার বন্ধুবান্ধবদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে লিখতে চায় সেই ধারণার মধ্যে এক রোমান্টিক চিন্তার যোগ আছে সত্য, তবে আনিস মূলত শিল্পের নন্দনতাত্তি¡ক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে রামকমলের মাধ্যমে তাঁর শিল্পীসত্তা প্রকাশ করেন। প্রচলিত সাহিত্যধারার অসারতাকে খানিকটা ভ্রুকুটি করেন তিনি। তবে রামকমলের জীবনধারার যে ব্যতিক্রম বা বৈচিত্র্য এবং তার যে বুদ্ধিবিবেচনা ও শিল্পসত্তার চমক তাকে লেখক যেভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, তা পাঠককে সব সময় সন্দিগ্ধ করে তোলে। এই কৌতূহলপ্রবণতার সঙ্গে আনিস যুক্ত করেছেন তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ও রসময় আলোচনা চক্র। রামকমলকে রহস্যময় করে তৈরি করার যুক্তি মেনে নিয়েই বলা যায় তাকে কিছুটা অন্ধকারে রেখে, তার জীবনযাপনকে অদৃশ্যমান রেখে আনিস গল্পের প্লটকে খানিকটা হয়তো রহস্যময় করতে চেয়েছেন, তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে রামকমলের মহা-উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা, তার বাস্তবতা নিয়ে কারও সন্দেহ জাগে না। টাকাপয়সা ধারদেনা, অগোছালো জীবনযাপন, পোশাক-আশাকের অস্বাভাবিকতা, অদ্ভুত আচরণ- এসবের বাইরে তার লেখাপড়ার গভীরতাকে সবাই বেশি আগ্রহের সঙ্গে দেখে। প্রচলিত সাহিত্যধারাকে রামকমল অপছন্দ করে; সে চায় বিশেষ ধরনের সাহিত্য, যা সব মাত্রাকে অতিক্রম করবে। সবাই মিলে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনায় সে  বন্ধুদের আকৃষ্ট করতে পারে এবং সে প্রতিদিন নতুন নতুন অধ্যায় লিখে তার ক্ষমতার প্রমাণ দেয়। যারা লিখতে পারবে না তারা মহাগ্রন্থের প্রকাশনা বা অর্থ বিষয়ে কাজ করবে। এটা ঠিক যে সাহিত্য সম্পর্কে রামকমল যা বলে সেটা লেখকের মতামত, তবে সেই মতামত যাতে চাপিয়ে দেয়া মনে না হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিত আনিস নিখুঁতভাবে তৈরি করেন। বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে রামকমলের যা বক্তব্য, সেটা দিয়ে আনিসকে আপাতভাবে মনে হবে তিনি এ দেশের সাহিত্যের চরম নিম্নগামী দশা সম্পর্কে বলতে চান। বোঝা যায় এটাই গল্পের বিষয়বস্তু, তবে সেটাকে তিনি প্রকাশ করেছেন একটা শৈল্পিক আড়ালের মাধ্যমে। কোনো ঘটনা ছাড়াই দীর্ঘ এই গল্প লেখার যে কৌশল, সেটা ভাবতে গেলেই আনিসের গল্প নির্মাণের নিপুণতা সহজে চোখে পড়ে। রামকমলের মুখে আনিস তাঁর বক্তব্য সহজে প্রকাশ করেন : ‘রামকমলের ভাবনাগুলো একেবারে নতুন কিছু নয়। তবে সে ভাবনার গুরুত্ব ও ঐকান্তিকতা ছিল উত্তেজনাকর। আমি সারা জীবনই সাহিত্যঘেঁষা। সাহিত্য আমার ভালোবাসার জায়গা। দশ বছর বয়স থেকে আমি বই পড়ি ও বই সংগ্রহ করি। আমি ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি পড়েছি। আমার ধারণা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণের মাঝে সাহিত্যের প্রতি এমনই ভালোবাসা থাকবে। দেখলাম, ধারণাটা ভুল। তাঁরা সেখানে উঁচু মেধাসম্পন্ন করণিক। তাঁরা ভালোবাসেন বেতন এবং তাঁদের নিজেদের প্রফেসরদের উদ্ধৃতিযোগ্য বাণী।’ এভাবে তাঁর নিজের কথা ও মতামত তিনি বলতে চেয়েছেন। অন্যত্র বলেছেন: ‘আজ সাহিত্যের যতগুলো আঙ্গিক আছে, সব সেকেলে। এই যুগটাকে সাহিত্যে উপস্থাপনের মতো আঙ্গিকই সাহিত্যিকদের হাতে এখনো তৈরি হয়নি। সে যেভাবে কথাগুলো বলত, তাতে সেগুলো গালগল্প ভাবার কোনো উপায় থাকত না। সে কোনো সাহিত্যকে সেই সাহিত্যের সনাতন রীতির মধ্যে আটকে রেখে আলোচনা করত না। সে মনে করত, আধুনিককালে, অর্থাৎ স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর থেকে কোনো সাহিত্যের পক্ষেই সম্ভব না ভৌগোলিক সীমা ভাঙার আন্তর্জাতিক রীতিকে উপেক্ষা করে চলা। এ  কারণেই ঠাকুরের উপন্যাসগুলো সে ক্ষমা করতে পারত না।’ এটা ঠিক যে আনিসের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে আমরা সব সময় একমত নই। যেমন রবিঠাকুরকে ঔপন্যাসিকের তালিকা থেকে বাদ দেবার যে যুক্তি, তা সত্য নয়। অন্তত ‘গোরা’ পড়লে এভাবে মন্তব্য করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে মন্তব্য নিয়ে কথা বলা যায়। তবে আনিস সৃজনশীল সাহিত্যে যে তর্ক-যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা শিল্পের নন্দনতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিরোধিতা করার কিছু নেই। আর রামকমলের গল্পের জন্য তা জরুরিও বটে। বিশেষত তার বিশ্বসাহিত্য বীক্ষা নিয়ে যে আলোচনা, তাতে বাংলাদেশের সাহিত্যের তুলনা খানিকটা সঠিক। রামকমলের তালিকায় কোনো বাঙালি লেখক নেই। তিনি কাফকা থেকে ভন ক্লিস্ট, বার্নহার্ড, দানিলো কিশ ও ইসমাইল কাদারের প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। বাঙালি লেখক পৃথিবীর সেরা লেখকের তালিকায় থাকতে পারে কি না, রামকমলের শিষ্যরা কেউ সে বিষয়ে বাতচিত করেনি। বোঝা যায় আনিসের সে বিষয়ে সায় আছে। তবে রামকমলের গল্পকে তিনি যেভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তা নিয়ে কোনো নঞর্থক মন্তব্য করা কঠিন। রামকমল শেষ পর্যন্ত হাওয়া হয়ে গেলে মহা-আখ্যান আর শেষ হয় না। বাস্তবতাও তা-ই, কোনো মহা-আখ্যানই শেষ হবার কথা নয়। ঢাকা শহর ও তার জনজীবন নিয়ে যে মহাগ্রন্থ তা এক মহাসম্ভবনার ইঙ্গিত দেয়, সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের মনে নতুন বোধের জন্ম দেয়। রামকমল নিয়ে বন্ধুরা দ্বিধাবিভক্ত হলেও মূল স্রোত তার পক্ষেই থাকে।

গ্রন্থের নামীয় গল্প ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার’ (এই জাতীয় নামে ফিলিপ রথে/সল বেলো একটি গল্প আছে) সম্ভবত লেখকের প্রিয় গল্প অথবা তার বিবেচনায় সেরা গল্প। এখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ বা স্বাধীন বাংলাদেশের তীব্র বিরোধিতা করা এবং কটূক্তি করা হেনরি কিসিঞ্জারকে একজন বাঙালি যুক্তরাষ্ট্রের একটি দামি হোটেলে সামনাসামনি পেয়ে প্রতিশোধ নেবার কথা ভাবে; যথারীতি তরুণ বাঙালি ওয়েটারকে দেখে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করে কিসিঞ্জার। তরুণ বাংলাদেশি জেমস যে একসময় ইংরেজির শিক্ষক ছিল, সে একজন ছাত্রকে পেটানোর পর (যে অন্যায় করেছিল গুরুতর) তার চাকরি চলে যায়। অন্যায়ভাবে তার চাকরি চলে যাবার পর সে আমেরিকায় পাড়ি দেয়, দেশ সম্পর্কে তার বিরূপ অভিজ্ঞতা থাকলেও কিসিঞ্জারের কটূক্তি সে সহ্য করতে পারে না। তার বাবাকে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করে, সে কারণে বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ বিষয়ে তার গভীর আবেগ ছিল বরাবরই। বাংলাদেশ বিষয়ে কিসিঞ্জারের আগের মন্তব্য বা গণহত্যা নিয়ে তার ভূমিকা তাকে তাতিয়ে রেখেছিল আর দেখা হওয়ার পর তার তীর্যক মন্তব্য তাকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। যদিও একজন সামান্য ওয়েটারের পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব নয় আর ছুরি দিয়ে তাকে আঘাত করার যে পরিকল্পনা সে মনে মনে করে, তা মনেই রাখতে হয় শাস্তির কথা ভেবে বা চাকরি হারালে কীভাবে চলবে তা ভেবে। দ্য সলিস্টিস হোটেলে তরুণ জেমসের সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয় কিসিঞ্জারের; তিনিও তাকে খোঁজ করেন ‘অসম্ভবের দেশ বাংলাদেশে’র এক ছেলেকে পেয়ে কিছু তীর্যক মন্তব্য করার জন্য বা তার কৌতূহল জারি রাখার জন্য। জেমসের সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম বা শিক্ষক হিসেবে তার চারিত্রিক দৃঢ়তাই তাকে কিসিঞ্জারের প্রতি এই-জাতীয় ব্যবহারে প্রলুব্ধ করে। আনিস জেমসের এই মানসিক অবস্থার কথা বলেছেন এভাবে : ‘কিসিঞ্জার দ্য সলিস্টিসে মাসে অন্তত একবার আসতেন এবং সাধারণত ডিনার করতেই আসতেন। যখনই আসতেন আমাকে একটু না খুঁচিয়ে যেতেন না। হয়তো সে খোঁচাখুঁচিকে তিনি দোস্তালির মতো করেই দেখতেন। আমাকে যদি সত্যিই তাকে আক্রমণ করতে হয়, তাহলে সামনের বার আসার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে-প্রতিবারই এমনটি আমার মনে হতো। আমি রেস্টুরেন্টের ব্রিজ থেকে সার্ভিস স্টেশন পর্যন্ত হাঁটার সময় দেখতাম, নিচের ঠোঁটটা নামিয়ে স্থির দৃষ্টিতে বসে আছেন মি. কিসিঞ্জার। পেটুক এক বৃদ্ধ রুপার কাঁটা চামচের মাথা দিয়ে একের পর এক দামি খাবারের গ্রাস মুখে তুলছেন আর গিলছেন, তুলছেন আর গিলছেন। আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল না সেই কাঁটা চামচটি ছিনিয়ে নিয়ে তার নিরাপত্তারক্ষীর “আহ” করে উঠতে পারার আগে তার চোখের কোটরে বসিয়ে দেয়া।’ মূলত প্রতিশোধপ্রবণতাই গল্পের মূল উপজীব্য। শেষ পর্যন্ত জেমস কিসিঞ্জারের কিছুই করতে পারে না, শুধু তাকে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। যদিও শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে কিসিঞ্জারের দেখা হয় আবার এবং কিসিঞ্জার তাকে আগের মতো বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে। তবে তাকে ধন্যবাদ জানায় এবং প্রত্যুত্তরে জেমসও তাকে গুডনাইট বলে। অন্য গল্পের মতো এখানেও আনিস চরিত্রের নানা পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন এবং নানা যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। বিশেষত জেমস চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি বিস্তৃত বলার সুযোগ নিয়েছেন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যাখ্যা করেছেন। গল্পটি শেষ পর্যন্ত কিসিঞ্জার-জেমসের মধ্যকার সম্পর্কজাত খুঁটিনাটি ঘটনা নিয়েই থাকে না; বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গ।

অন্য গল্প নিয়ে একই রকম আলোচনা করা যায়। তবে সব গল্পে রচনাশৈলীর শক্তি ও দক্ষতা থাকলে, তা সব সময় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। ‘ফেরার বছর’, ‘আমার শত্রু’, ‘এলিফ্যান্ট রোড’ বা ‘পরীক্ষা দিয়ে কবি হওয়া’র কথা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এ গল্পগুলোতে লেখক সপ্রতিভ এবং প্রগলভ। তিনি সাবলীল ভঙ্গিতে গল্প বর্ণনা করেছেন এবং বরাবরই গল্পের চেয়ে প্রসঙ্গ, পরিস্থিতি ও ব্যাখ্যাকে বড় করে তুলেছেন। গল্পগুলোর বড় অংশজুড়ে আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সামূহিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা, যা চরিত্রগুলোকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলতে সাহায্য করেছে। ‘আমার শত্রুরা’ গল্পটি উচ্চবিত্তের বিষয়কে কেন্দ্র করে যেখানে দুটি বড় শিল্পগ্রুপের মধ্যকার টানাপোড়েনই মূল বিষয়বস্তু। তবে গল্পকার উচ্চবিত্তের সংস্কৃতিকে খুব বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। ‘পরীক্ষা দিয়ে কবি হওয়া’ বাহরাম ও জামশেদ নামে দুই ভাইয়ের গল্প; বাহরাম সহজ-সরল আর জামশেদ ডানপিটে। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যকার বিবাদ ও বিরোধের একটা চিত্র তিনি বর্ণনা করেছেন, তবে তার চেয়ে বেশি করে উল্লেখ করেছেন জামশেদে ও তার বাবার খানদানি প্রসঙ্গে। মুসলিম পরিবারের আগেকার ধর্মীয় ও পারিবারিক ঐতিহ্য, যা তারা একান্নবর্তী পরিবারের আদর্শ হিসেবে পালন ও লালন করে। দুষ্টু জামশেদকে বাবা জোর করে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করান। তবে সে একদিন বাড়ি এসে বলে সে কবি হবে। বাহরাম বললে হয়তো কেউ আশ্চর্য হতো না। জামশেদের বাবা তাকে নানাভাবে বোঝান যে এ দেশে কবি হওয়া কত বুদ্ধিহীনতার কাজ বা অসম্মানের। তিনি তাকে তিরস্কার করেন। তিনি খুব বিদ্রুপের সঙ্গে তাচ্ছিল্যের সুরে কবি সম্পর্কে মন্তব্য করলেও জামশেদ অনড় থাকে। পরে বাবা বলেন যে মুরব্বি পরিষদের সামনে তাকে পরীক্ষা দিতে হবে। যদি সে পাস করে এবং পরিষদ সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে সে কবি হতে পারে। বাহরামের পরামর্শে তারা বোদলেয়ারের কবিতা অনুবাদ করে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। মান্নান দাদা পড়ে বলেন, ‘তোমার কবিতায় অনেক আবেগ কিন্তু আত্মা কই? এটা এত অন্তঃসারশূন্য কেন? এটা কি এ কারণে যে তুমি পশ্চিমাদের অনুকরণ করেছ? হতাশা ও শূন্যতা নিয়ে লেখা কেন? পশ্চিমাদের ইতিহাস তোমাদের ইতিহাস না।’ তিনি ওমর খৈয়ামের কবিতার বাংলা অনুবাদ শুনিয়ে সেই কবিতার শক্তি ও সম্ভাবনার কথা বলেন। বোঝা যায় মাওলানার লেখাপড়া খুব বিস্তৃত। তিনি সিদ্ধান্ত দেন যে চাকরি করতে হবে সেনাবাহিনীতে এবং কবিতা লিখতে পারবে। তবে শুধু কবি হওয়া যাবে না। এই গল্পে খানদানির প্রসঙ্গ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তবে পরীক্ষা দিয়ে কবি হওয়ার গল্পে পাঠকের আগ্রহ কতটা থাকবে, তা বলা শক্ত।

ইংরেজিতে লেখা গল্প বাংলায় অনূদিত হয়েছে; অনুবাদ নিয়ে আগেই বলেছি যে সেটা খুব মানসম্পন্ন ও সৃজনশীল হয়েছে। তবু অনুবাদে কিছু সমস্যা থেকেই যায়। অনুবাদ করতে গিয়ে ইংরেজি ভাষার বাক্যবলয়কে সঠিকভাবে বাংলায় রূপান্তর করা সব সময় সম্ভব হয় না। ফলে একটু আড়ষ্টতা তৈরি হয়। এখানেও মাঝে মাঝে সেটা লক্ষ করা গেছে। অনুবাদকের পছন্দের শব্দ বা শব্দবলয় ব্যবহারের ঝোঁক থাকতে পারে, যা মূল রচনার সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিতে পারে। সামান্য একটা উদাহরণ দেয়া যাক : ‘এই সংকট নিয়ে কাজে-অকাজে তখন গালিবদের মতো প্রতি ঘরেই নিত্যদিনের আলোচনা। এগুলো তার কানে আসত ঠিকই, কিন্তু কলবে খুব একটা পৌঁছাত না, কারণ তার কলবে তো অন্য জিকির।’

কাজী আনিস আহমেদ বাংলাদেশের লেখক। তিনি ইংরেজিতে লিখলেও তা সত্য। আর তিনি গল্প লেখার সময় যে রাইটিং অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করেছেন, তা এ দেশীয় ঠিক নয়, তা আমেরিকান বা ইংরেজি সাহিত্যের। তবে তাঁর সব অনুষঙ্গ ও পটভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে। আর বাংলাদেশ উপস্থিত হলেও বাংলাদেশের প্রকৃতি-নিসর্গ এখানে অনুপস্থিত, সেটা ইচ্ছাকৃত নিশ্চয়ই নয়। তবে তাঁর অভিজ্ঞতার জায়গাতে তিনি সিদ্ধহস্ত এবং দাপটের সঙ্গে শিল্পের দাবি তিনি মিটিয়েছেন। আর এভাবে তিনি রুচিশীল, প্রাজ্ঞ পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারবেন স্থায়ীরূপে।
লেখক: কবি ও কথাশিল্পী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ