X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তর-সাম্রাজ্যবাদী উদ্বেগ ও আখ্যানের আশ্রয়সংকট

অভিষেক সরকার
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৪২আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৪৫

অভিষেক সরকার এ কথা গোড়াতেই জানিয়ে রাখা জরুরি যে এই লেখার আমন্ত্রণের সঙ্গে যে পিডিএফ ফাইলটি হাতে এসে পৌঁছল-অর্থাৎ যে নাতিদীর্ঘ আখ্যানটি নিয়ে কিছু লেখার কথা-তার শুরুর পাতাগুলোতে চোখ বোলাতেই স্পষ্ট হয়ে গেল ‘চল্লিশ কদম’ শীর্ষক আখ্যানটি একটি মূল ইংরেজি আখ্যানের অনুবাদ। অনুবাদক বাঙালির বিশ্ববীক্ষার জানালা সদ্য প্রয়াত শ্রী মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এই লেখা কাজী আনিস আহমেদের মূল ইংরেজি আখ্যানটির ওপর আধারিত নয়। তবু লেখক ও অনুবাদকের সম্মতিক্রমে আখ্যানটি যখন ছাপা হয়েছে তখন ধরে নেয়া যেতে পারে কাহিনির মূল ভাব, ভাষার শৈলীগত প্রবণতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উভয়েই একমত হয়েছিলেন। এ কথা ধরে নিয়েই এই নিবন্ধের সূচনা করব।
খুশবন্ত সিং তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘Train to Pakistan’-এ বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদের অভিঘাত শুধু রাজনৈতিক নয়। নির্দিষ্ট সাল-তারিখের হিসাবে যে স্বাধীনতাকে দেখতে পাচ্ছি, যা সার্বভৌমত্বের ও জাতীয়তাবাদের জনপ্রিয় প্রতর্কে মহিমামণ্ডিত, তাকে একটি উল্লেখযোগ্য ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তন হিসেবে দেখতে ও বুঝতে পারা জরুরি হলেও সাম্রাজ্যবাদের মানসপ্রতিমা তাতে বিসর্জন হয় না। পেশাদার সৈনিক বান্টা সিং এবং মিত সিংয়ের সেই কথোপকথন প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায়। বান্টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সৈনিক হিসেবে বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন খোদ ইংরেজদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তাঁর জবানিতে শুনতে পাচ্ছি, বেশির ভাগ সেপাই ‘liked the English officers’; মিত সিং সায় দিচ্ছেন-‘sepoys are happier with English officers than with Indian’। এই হলো বিজিতের বরাবরের সংকট-সাম্রাজ্যের যে সাংস্কৃতিক প্রভাব স্মৃতি ও অভ্যাসের পথ ধরে মানসলোকে সেঁধিয়ে যায়, ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতায় তার মোচন ঘটে না। বান্টা সিংদের মধ্যে এই প্রভাব স্পষ্ট। অধীন জাতিতে নানান অত্যাচার ও নিষ্পেষণ সত্ত্বেও একধরনের আপাত-সাম্যের বিভ্রম থাকে-ব্রাহ্মণ হও বা শূদ্র, হিন্দু হও বা মুসলমান, আসলে উপনিবেশের সকলেই বিজিত-এক বিদেশের অধীন। এই অধীনত্ব অবশ্যই শ্রেণি ও বর্গনির্বিশেষে সমসত্ব নয়। তবু একই প্রভুর স্মরণে-একই বিদেশের নিরিখে সকলে মিলে একই দেশ, একই জাতি হয়ে ওঠা যায়। রাজনৈতিক স্বাধীনতা এই মায়ার পর্দা ছিঁড়ে দেয়। বিজিতের সামাজিক বৈষম্যের রূপটি প্রকট হয়ে ওঠে। বান্টা বা মিত সিংয়ের উদ্বেগকে বোঝা খুব শক্ত নয়। কিন্তু তলিয়ে না ভাবলে আরও এক প্রগাঢ় বিপন্নতা চট করে দৃষ্টিগোচর হয় না। সাম্রাজ্যের মানসবিস্তারের যে উল্লেখ একটু আগেই করা হলো, তার সবচেয়ে আপাত ও শক্তিশালী হাতিয়ার ইতিহাস। ‘After Amnesia’-তে গণেশ দেবী দেখাচ্ছেন কীভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাক-ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে সাম্রাজ্যবাদ লিখে ফেলে নিজের জবানিতে। দেশি ও মার্গপরম্পরাকে নাকচ করে প্রতীচ্যের নিজের প্রতিমার প্রতিলিপিতে এক নতুন দেশের নির্মাণ হয়। এনগুগি ও’য়া থিওং’ওর লেখায় আফ্রিকার জনজাতীয় ইতিহাসকে মুছে দেয়ার যে প্রয়াসের খোঁজ আমরা পেয়েছি, দেবীর পর্যবেক্ষণকে সেই আলোয় পড়ে নেয়া যায় অনায়াসেই। আশান্তি জাতির পবিত্র সোনার টুলকে ইংরেজ প্রভু তার বাসার আসবাব হিসেবে ব্যবহার করতে চান। জাতির ইতিহাসে, তার স্মৃতিতে উপ্ত মূল্যবোধ ও চিহ্ন-অর্থ সম্পর্ক বা signification-কে আমূল বদলে দিতে চায় সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যোত্তর সমাজের আত্মপরিচয়ের নির্মাণ তাই এক অত্যন্ত জটিল পদ্ধতি-সেবল্ডের উপন্যাসের (Austerlitz) স্মৃতিহীন নায়কের মতোই উত্তর-সাম্রাজ্যবাদী Subject-কে তাড়া করে ফেরে ফ্রয়েডীয় unheimlich। সাম্রাজ্যের বয়ানের বাইরে এক সাংস্কৃতিক স্মৃতির পুনর্নির্মাণ এক অসম্ভব প্রকল্প, কারণ তাঁর স্মৃতিকে সতত আড়াল করে রাখে সাম্রাজ্যের প্রেত। তাঁর শিক্ষা, সাংস্কৃতিক গঠন ও সামাজিক ব্যবস্থাকে ছেয়ে থাকে সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক প্রতর্ক-তাঁর আত্মবীক্ষণ সাম্রাজ্যের চোখ দিয়ে। এই মাধ্যমিক বাধাকে কাটিয়ে ওঠার লড়াই ব্যর্থ হতে বাধ্য, অথচ একে মেনে নিলে স্মৃতিহীনতার গ্রাস থেকে মুক্তি নেই, মুক্তি পাওয়া যায় না ঔপনিবেশিক পরিচয়ের হাত থেকে। তাই হৃত আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধারপ্রয়াসী উপনিবেশ মান্টোর আখ্যানের বিষণ সিংয়ের মতোই কোনো এক নোম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে দেশ খুঁজে চলে-এই অন্বেষণ জন্ম দেয় প্রগাঢ় এক উদ্বেগের। এই উত্তর-সাম্রাজ্যবাদী উদ্বেগই চল্লিশ কদমের পায়ে পায়ে জড়িয়ে আছে। এই উদ্বেগ থেকেই জন্ম নেয় একরকমের grounding crisis-শিকদার সাহেবের আশ্রয়সংকট। গ্রাউন্ডিং বলতে আমরা বুঝব কোনো ঘটনা বা সত্তার দেশিক ও কালিক স্থিতির বিশেষত্ব।

আখ্যান শুরুই হয় এই আশ্রয়সংকটের হাত ধরে। শিকদার সাহেব নিশ্চিত নন তিনি জীবিত না মৃত। যারা গোর দিয়েছেন, তারা নিঃসংশয় হলেও শিকদার সাহেব জানেন না এই দেশ ও কালে কীভাবে স্থিত তিনি। তার দেহ সপ্রাণ কি না, তা-ও তাকে জেনে নিতে হবে ফেরেশতা মুনকার আর নাকিরের থেকে। অব্যবহিত পরেই জানতে পারব সংজ্ঞাহীন হয়ে লুটিয়ে পড়ার আগে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন এক আলের ওপর। এই চিত্রকল্পই প্রতীকী হয়ে ছড়িয়ে থাকে গোটা আখ্যানের শরীরজুড়ে। আলের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে বিষণ সিং, শিকদার সাহেব-সাম্রাজ্যোত্তর যুগের সাবজেক্ট। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার সঙ্গে দেশীয় সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব শিকদার সাহেবের জীবনে মূলত আখ্যানের দ্বন্দ্ব হয়ে ওঠে। এই দ্বন্দ্বের প্রাথমিক উন্মোচন হয় তার শহরযাত্রায়। ইসলামের ধর্মীয় পাঠ ও শহরের যাপনের মধ্যে যে দ্বন্দ্বকে ধারণ করেন শিকদার সাহেব, তার রূপটি ধরা পড়ে ডসনের ছবিতে। দন্তচিকিৎসার বিদ্যায়তনিক পরিসরে শিকদার সাহেবের পরিচয় ঘটে যে চিত্ররূপের সঙ্গে, তার অভিজ্ঞতায় একই সঙ্গে মিশে থাকে অনভ্যাসের অস্বস্তি এবং অপরিচিতের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ। বিলিতি ডসন যেমন দেশি হয়ে উঠেছে তার তামাটে রং আর দীর্ঘকাল ধরে উপনিবেশেরই শহরে বেড়ে ওঠার, তার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে ক্রমশ পরিচয় খুঁজে নেয়ার মাধ্যমে, তেমনই জামশেদপুরের গ্রাম্য যাপনে অভ্যস্ত শিকদার সাহেব শহরকে আত্মস্থ করতে শুরু করেন ক্রমশ। ডসনও শিকদার সাহেবের মতোই ক্রেওল সংস্কৃতির আলের ওপর দাঁড়িয়ে। গোইয়া বা টিশিয়ানের কাজ শিকদার সাহেবের শিল্পসম্পর্কিত আগ্রহ জাগিয়ে দেয় বটে কিন্তু বিলিতি শিল্পীর তুলির আঁচড়ে নারীর যে চিত্র ভেসে ওঠে, তাকে তিনি দেখেন জামশেদপুরের দেশীয় সংস্কৃতির অক্ষিকাচ দিয়েই-‘আমি জানি যে এসব মহৎ শিল্পকর্ম কিন্তু এই শিল্পকর্মগুলো আমাদের জন্য নয়’, সে বলেছিল ডসনকে, ‘তাছাড়া তোমার জানা উচিত, ইসলামে কারও তসবির বা প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ।’ ডসন শুধু নরম স্বরে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি যে মুসলমান নই, তাতে আমার খুশিই লাগছে।’ তার ধর্মভীরু মনের সব সংশয় সত্ত্বেও শিকদার অবশ্য শিল্পকলায় তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেনি।’

এই দোটানা, এই সংঘাত আদতে শিকদার সাহেবের ভেতরে কোথাও দুটি অপ্রবেশ্য দেশ গড়ে দেয়। শিকদার সাহেব দাঁড়িয়ে থাকেন দুই সীমান্তের মাঝে। কাঁটাতারের বেড়া গলে গোপনে এদিক-ওদিক যাতায়াত সম্ভব হয় না তা নয়, তবু তিনি কোনো দেশের নন, কোনো দেশই তার হয়ে ওঠে না পাকাপাকিভাবে। এই অসম্পূর্ণতা, পরিণতিহীনতা তাকে তাড়া করে ফেরে আজীবন। বোহিমিয়ান যাপন বজায় রাখতে পারেন না তিনি, চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠও সম্পূর্ণ হয় না। আব্বার অতর্কিত ইন্তেকাল তাকে ফিরিয়ে আনে জামশেদপুরে। কিন্তু ফিরিয়ে আনে কি? শহরের জৌলুশদার জীবনের আখ্যান তিনি নিয়ে এলেন জামশেদপুরে। যেমন একদিন এক টুকরো জামশেদপুর এসে পড়েছিল শহরে। তিনি গল্প বলেন সিগারেট খাওয়ার, মদ খাওয়ার, বেপরোয়া হিন্দু মেয়েদের মঞ্চানুষ্ঠানের-‘যতই শ্রোতারা তাঁর এসব কেচ্ছাকাহিনি শুনে আঁতকে উঠত ততই সেসব আরও রংদার হয়ে উঠত।’ এমনকি তিনি এ-ও জাহির করতেন যে তিনি নিজেও এসবে যোগ দিতেন। কোথাও জামশেদপুরের স্থিতিশীল আত্মপরিচয়ে আঘাত করাই যেন তার উদ্দেশ্য। জামশেদপুরে শিকদার সাহেবের বৈভবের প্রদর্শন-বাড়ির চৌহদ্দিতে তোলা পাঁচিল আসলে প্রতীকী। ওই পাঁচিলের ওপারে জামশেদপুর, এপারে এক না-দেশ। এই দেশও আসলে এক আখ্যান-তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা গল্পমালায় যে জামশেদপুর মোগলদেরও আগের আমলের সমৃদ্ধ জনপদ তার বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়নও তাই সম্পূর্ণ হয় না। গাঁওবুড়োদের গালগল্পের সত্যতা যাচাই করতে পারতেন যে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাদের বাস্তবিক আবিষ্কারকে ঢেকে দেয় ফিসফিসে চালিয়ে যাওয়া গল্পই। গ্রামের মসজিদের জৌলুশ দেখে তারা শুধু বিস্মিতই হন না, জহুরির চোখ তার আনাচকানাচ পরখ করে অনুমান করে যে এই মসজিদ নিশ্চয়ই কোনো হিন্দু মন্দির ছিল। ‘আড়চোখে সন্তর্পণে তাকিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা দেখতে পেয়েছে থামের লাল বেলেপাথরের গায়ে নর্তকীদের মূর্তির ভগ্নাংশ।’ কিন্তু এই সাবুদ ‘তাদের পেশার যন্ত্রপাতি সহযোগে খোঁড়াখুঁড়ি করে জোগাড় করা হয়নি।’ এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ায় আর সেই সাবুদ কখনোই জোগাড় করা হয়ে ওঠে না। গোটা আখ্যানের মতোই, শিকদার সাহেবের জীবনের মতোই অসম্পূর্ণ থেকে যায় সত্যসন্ধান। দাঙ্গাকবলিত জামশেদপুর ছেড়ে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বিদায় নেন, শুধু থেকে যায় সে দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য-ডসন-শিকদার সাহেবের বন্ধু। 

প্রসঙ্গত কারও মনে পড়ে যেতে পারে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে দেশভাগের স্মৃতি। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে পলায়নতৎপর মানুষ কাউকে না কাউকে ফেলে যান। পরিচিত ভ‚মি অগম্য হয়ে ওঠে অতর্কিতে। অদৃশ্য পাঁচিল উঠে যায়, দৃশ্য কাঁটাতারের চেয়েও অনতিক্রম্য সেই দেয়াল। অমৃতা প্রীতম ‘রসিদি টিকিট’ লিখতে গিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিদীর্ণ পাঞ্জাব প্রদেশের কথা। কিন্তু আপাতত যা আরো বেশি করে চোখে পড়ছে তা হলো গোটা আখ্যানের দেশিক ও কালিক ঐক্য কোথাও বিপন্ন হয়ে পড়ে এই মুহূর্তে। শিকদার সাহেবের জামশেদপুর যেমন ঢুকে পড়েছিল শহরে, ঠিক তেমনই আবার তিনি সেই শহর সঙ্গে করে ফিরেছিলেন জামশেদপুর। ডসনের জামশেদপুরে এসে পড়ায় সেই বৃত্তই যেন সম্পূর্ণ হলো। আবার প্রত্নতাত্ত্বিকদের হাত ধরে জামশেদপুর যে অতীতে প্রবেশ করে-যে অতীতের রহস্যে আগ্রহী কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টি, সেই অতীতেরই প্রেত তাড়া করে ফেরে বর্তমানের জামশেদপুরকে-বহু বছর ধরে নিশ্চল মসজিদের থামের নর্তকীদের প্রলয় তছনছ করে দেয় চারপাশ। দেশে বা কালে, কোথাও থিতু হতে পারে না মানুষ। ঔপনিবেশিক জ্ঞানের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় স্থানিক স্মৃতি-হিস্ট্রি আর ইতিহাসের এই উত্তর-ঔপনিবেশিক সংঘাত বারবার ফিরে এসেছে আফ্রিকায়, ভারতীয় উপমহাদেশে, ইন্দোনেশিয়ায়...

অথচ দাঙ্গার মেঘ কেটে গেলে আপাত-স্থিতি ফিরে আসে। সোনালি চুলের ডসন বসত পেতে বসে জামশেদপুরে। চিত্রকলায় ইতি দিয়ে হাতের সূক্ষ্ম কারুকাজের দোকান খুলে বসে। যেমন একদিন উত্তর থেকে এসে এখানে থেকে যান জহির সাহেব-নূরজাহান বা বেগম শিকদারের আব্বা। জামশেদপুরে তিনি নিয়ে এসেছিলেন ইউরোপের আসবাবের নকল আর ইংরেজি সাহিত্য এবং অবশ্যই ডাকসাইটে সুন্দরী খোলামেলা মেয়েটিকে। জামশেদপুরের জীবনে এ এক rupture -বিস্ফোরণ। আর বিস্ফোরণ মাত্রেই হতবুদ্ধির গ্রস্ততা। আদতে জামশেদপুর নিজেই সেই আল-সেই মধ্যবর্তী ভূমি-নোম্যানস ল্যান্ড। কোনো নির্দিষ্ট দেশে বা কালে থিতু নয় সে নিজেও। অতীতের প্রেতচ্ছায়া, পাতাল খুঁড়ে তুলে আনা প্রত্নদাঙ্গার দৈত্য ঘুমিয়ে পড়তে না পড়তেই অত্যন্ত দ্রুত আখ্যান পৌঁছে যায় ভবিষ্যতের ধীর কিন্তু নিশ্চিত অনুপ্রবেশের সম্ভাবনায়। জামশেদপুরে বিজলি আসার সম্ভাবনা, শিক্ষার প্রসার বয়ে আনে আধুনিকতার সর্বাধিক চর্চিত প্রবণতাটিকে-উন্নয়ন। নিজের হেকিমি পেশাতেও থিতু হতে পারেন না শিকদার সাহেব। গরিবদের রং করা জল আর সম্পন্ন গৃহস্থকে অ্যাসপিরিন বেচে যেটুকু পসার তা-ও বিপন্ন হয়ে পড়ে। ওষুধের তাকে সাজানো শ্রেণি দুটির চরিত্রও ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে-সহজ হিসেবে have আর have not -এর তফাত করা যায় না আর। শ্রেণিবিন্যাস গুলিয়ে যায়। মানুষ ক্রমশ হাকিমি দাওয়াখানা থেকে শহুরে ডাক্তারির দিকে ঝুঁকতে থাকে। জমিজিরেতের কারবারে জড়িয়ে পড়েন শিকদার। 

এই দুঃস্থিতির অভিঘাতে একদিন তার না-দেশ ঘিরে গড়ে ওঠা প্রাচীরটিও দুর্লঙ্ঘ্য থাকে না আর।  রোগগ্রস্ত ডসন আশ্রয় নেয় শিকদার সাহেবের বাড়িতে। ঔপনিবেশিক রাজনীতির ঐতিহাসিক পর্যায়গুলো পরতে পরতে খুলে যেতে থাকে। নূরজাহানকে ইংরেজি শেখাতে শেখাতেই ঘনিষ্ঠ হন ডসন। ঔপনিবেশিক শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে-প্রলুব্ধ করা।  ক্রমশ উপনিবেশকে মোহাবিষ্ট করে ফেলা ঔপনিবেশিক রাজনীতির এক সুচতুর কৌশল।  এই মোহময়তা কখনো আসে আফিমের হাত ধরে, কখনো ধর্ম এবং অবশ্যই ভাষা। ডসনের সঙ্গে নূরজাহানের ঘনিষ্ঠতার কাহিনির আড়ালে এই ভাষিক রাজনীতিরও একটি ইঙ্গিত থেকে যায়। ডসন আর নূরজাহানের শারীরিক ও মানসিক ঘনিষ্ঠতা আসলে শিকদার সাহেবের না-দেশটিকেও আলের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। তার শেষ আশ্রয়-তার পরিবারেও ঢুকে পড়ে অনিশ্চয়তা। ইয়াকুব মোল্লার কারসাজিতে ডসন চলে যায়, কিন্তু কোনো প্রস্থান বা প্রবেশই সম্পূর্ণ নয় এ আখ্যানে। সোনালি চুলের এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় নূরজাহান। দেশে বা কালে, শরিয়তি মতে বা উদারনৈতিক পাশ্চাত্য শিল্পে-কোথাওই নিজের অবস্থান নির্দিষ্ট করতে পারেন না শিকদার সাহেব অথবা ডসন কিংবা জামশেদপুর। এমনকি পরিবারও নয়। এইখানেই ফ্রয়েডীয় unheimlich/unhomely হয়ে আখ্যান Fisher -এর hauntology মনে পড়িয়ে দেয়। শিকদার সাহেব যেন তাকে তাড়া করে ফেরা সময় ও দেশের সেই প্রেতগুলোরই অন্য রূপ। তিনি না অতীতের, না বর্তমানের; না জামশেদপুরের, না শহরের; না পিতা, না সন্তানহীন। এই আছে ও নেইয়ের মাঝে দোদুল্যমান শিকদার আখ্যানকেও আশ্রয়হীন করে তোলেন। আখ্যানও কোনো নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে যেতে পারে না আর। ফেরেশতার মুখ চেয়ে বসে থাকে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ