X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনুবাদকের পাঠ ও ভাবনা

মুহম্মদ মুহসিন
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৫৬আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:০১

মুহম্মদ মুহসিন ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার ও অন্যান্য গল্প’ শীর্ষক গল্পগ্রন্থটি আমি ইংরেজিতে প্রথম পড়ি এবং এর প্রেমে পড়ে যাই। সে প্রেম থেকে এটি আমি অনুবাদ করি। আমি যেটুকু যা বাংলা গল্প পড়েছি, তা থেকে আমার মনে হয়েছিল এর বাংলা অনুবাদ পাঠকের কাছে খুব সমাদৃত হবে। আমি জানি না কতখানি সমাদৃত হয়েছে। তবে এর খুব একটা রিভিউ আমার চোখে পড়েনি। তখন আমার শহীদুল জহিরের কথা মনে হয়েছে। শহীদুল জহির বড় সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আমরা দেখেছি সরকারি কর্মকর্তা হলে মিডিয়া জগতে তাঁর লেখার আলাদা কদর হয়। কিন্তু শহীদুল জহিরের বেলায় তার উল্টোটা দেখলাম। সরকারি কর্মকর্তা লেখক হলে লেখক সমাজে তাঁর বিষয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় প্রেজুডিসের পাহাড় তৈরি হয়। যে কর্মকর্তা তাঁর সরকারি ক্ষমতার বুলডোজার দিয়ে সে পাহাড় গুঁড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করেন, তাঁর ভাগ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শহীদুল জহিরের মতো হয়। বেঁচে থাকতে কেউ চেনে না। বাংলা একাডেমি পুরস্কারটিও জোটে না। শহীদুল জহিরের এই বাস্তবতা আমার মনে হয়েছে মিডিয়াজগতে এবং উচ্চবিত্ত জগতেও সমানভাবে ক্রিয়াশীল। মিডিয়াজগতের ও উচ্চবিত্ত জগতের বড় নামগুলোর বিষয়েও সম্ভবত লেখকজগতে এমন একটি প্রেজুডিসের পাহাড় তৈরি হয়ে আছে। কাজী আনিস আহমেদ মিডিয়ার বুলডোজার দিয়ে সেই পাহাড় ভাঙার কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে তাঁর অবস্থাও হয়তো শহীদুল জহিরের অনুরূপ মনে হচ্ছে। বড় বোদ্ধাদের এই নিশ্চুপতার মাঝে আমি অনুবাদক হিসেবে ভাবলাম আমার অনুবাদকালীন ভাবনাগুলো একটু বলি। সেই থেকেই আমার এই প্রয়াস। 

এই বইয়ের প্রথম গল্পটির নাম ‘চামেলি’। গল্পটির বিষয়বস্তু এক কিশোর প্রেম আর পরিপ্রেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ। শুরুতে গল্পটি বেশ সাদামাটা মনে হয়। কিশোর-কিশোরীর প্রেম হিসেবে প্রেমটিতে যেমন আনাড়িপনার বিস্তার আছে, তেমনি গল্পের কথকতায়ও রয়েছে কাঁচা কথকের আবেগঋদ্ধ বয়ান। কিন্তু প্রেমের এই গল্পটির পরিপ্রেক্ষিতটি দৃষ্টিসীমায় আসার সঙ্গে সঙ্গে গল্পটি আর নেহাত প্রেমের গল্প থাকে না। এটি হয়ে ওঠে একটি সময়ের গল্প। সময়টি ধারণ করছে যে মন সেই কিশোর মনটি যুদ্ধ এবং যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষবিষয়ক সকল প্রভাববলয় থেকে মুক্ত। সে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ নিয়ে ভাবিত নয়। সে ছয় দফা জানে না, স্বাধীনতাও জানে না। ‘বঙ্গবন্ধু নামে একজন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার’ এক নেতার নাম সে জানে, যাঁকে তার পছন্দ ‘তাঁর অসাধারণ ধূমপানের পাইপটির জন্য’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড় করানো এমন আর একটি গল্প দেখা যায় না যেখানে গল্পের নায়ক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রাজনৈতিক বিষয়বস্তু থেকে এতখানি নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানে ও দূরত্বে দাঁড়ানো।

এই দূরত্ব গল্পটির আবেদন অসামান্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অধিকাংশ গল্প ও উপন্যাস সাহিত্য হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে; কারণ, সেগুলোতে কোনো চরিত্র সৃষ্টি হয়নি, যা নির্মিত হয়েছে, সব ‘টাইপ’। সেসব গল্প-উপন্যাসে মুক্তিযোদ্ধা একটি ‘টাইপ’, রাজাকার একটি ‘টাইপ’, হানাদার বাহিনী একটি ‘টাইপ’ এবং এমনকি নির্যাতিত ও নির্যাতিতা নারী-পুরুষও এক একটি ‘টাইপ’। এসব ‘টাইপ’-এর কিছু কিছু এখন টাইপের চেয়েও নিকৃষ্টরূপে ‘স্টক’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর কারণ চরিত্রগুলোকে লেখকেরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে ছককাটা এক অনুভূতি ও বিচারবোধের সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছেন। চরিত্ররা সেই ছকের বাইরে পা ফেলতে পারছে না। চরিত্রদেরকে ‘টাইপ’ থেকে মুক্ত করে মানুষ হতে দেয়ার সচেতনতা লেখকদের থাকছে না।

এই গল্পটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্যের এই ব্যর্থতা ও ‘টাইপ’ চরিত্রের দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন বলে প্রতীয়মান। এখানে গালিব চরিত্রটি যুদ্ধের পক্ষ বা বিপক্ষ থেকে এতখানি নিরপেক্ষ যে গল্পটি আর বাংলাদেশের পাঠকের মধ্যে সীমায়িত থাকেনি, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরিধির মধ্যে অন্তরীণ এক গল্প হয়ে থাকেনি, এটি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন মানবতাবাদের দর্পণে যুদ্ধের হাতে প্রেমের করুণ সংহারের এক বিশ্বজনীন গল্প। ‘যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবস-শর্বরী বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি’ তেমন এক মুক্ত মন ও জগতের গল্প সে হয়ে উঠতে পেরেছে। গল্পের কাঠামো পরিকল্পনায় লেখকের এই সচেতনতা গল্পের কথকের বয়ানের যৎসামান্য দুর্বলতাকে একেবারে যমুনার স্বচ্ছ জলে ধুয়ে সাফ করে দেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্পের ‘টাইপ’ যখন পাঠকদের প্রত্যাশাকেও গড়ে ওঠা টাইপের মধ্যে আটকে দেয়, তখন এই গল্পের পাঠক-প্রত্যাশা পূরণের যোগ্যতা কমে যায়-এটিই গল্পটির জন্য একটি দুর্ভাগ্যের বিষয় বলে আমার নিকট অনুভূত হয়েছে। 

বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটির নাম ‘পরীক্ষা দিয়ে কবি হওয়া’। নামটা শুরুতেই বলে দেয় যে এটি একটি বিদ্রুপাত্মক গল্প। কিন্তু গল্পটি পড়তে শুরু করার পর সেই বিদ্রুপার্থ খুঁজে না পেয়ে পাঠক একটু ধাক্কা খায়। কারণ, সাধারণ বিদ্রুপাত্মক রচনায় যে সকল জনপ্রিয় কারিগরি থাকে যেমন ব্যাজস্তুতি, হাইপারবোল, ব্যাথোস-সেগুলোর আয়োজন এখানে চোখে পড়ে না। যা চোখে পড়ে তা সবই সিরিয়াস, গম্ভীর এবং গুরুত্বের সঙ্গে শব্দের অর্থলগ্ন। ফলে পাঠককে কাঠামোর ও অর্থের যতগুলো স্তর কেটে সরিয়ে এর বিদ্রুপের অর্থপ্রপঞ্চের কাছে পৌঁছতে হয়, তা অনেক সময়ই পাঠকের জন্য পরীক্ষার মতো।

গল্পটিতে মূল দুটো ঘটনাবীজ রয়েছে। একটি হলো নিজের আয়োজিত শক্তির পরীক্ষায় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিয়ে মহল্লার পার্কের মূল মাঠে জামশেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা আর একটি হলো অন্যের আয়োজিত পরীক্ষায় নিজে হেরে গিয়ে কবিতার রাজ্য থেকে এবং নন্দনবোধের রাজ্য থেকে জামশেদের নির্বাসিত হওয়ার গ্লানি। গল্পের বুননে পরীক্ষা দুটো পাশাপাশি রাখার মাধ্যমে পরীক্ষা দুটোর মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক অন্বেষণের মর্মে পাঠকের প্রতি আহবান রয়েছে। এই পরীক্ষাদ্বয়ের বর্ণনায় এবং এ ঘটনাদ্বয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত চরিত্রদের কাজে ও বলায় কোথাও বিদ্রুপ প্রকাশক কোনো ব্যাজস্তুতি বা ব্যাথোস নেই। তারা যা বলছে এবং করছে সব সিরিয়াস এবং উদ্দিষ্ট অর্থের সঙ্গে তাদের বক্তব্যের সঙ্গে সর্বত্র সমাপতন রয়েছে। ফলে নন্দন ও সাহিত্য নিয়ে জামশেদের বাবা, হায়দার চাচা এবং সবশেষে মাওলানা আরাকান খান যা বলেছেন তা ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক উভয়ভাবেই সর্বতো সৎ ও সঠিক।

জামশেদের বাবা যখন বলছেন-‘আজ তোমাদের বয়সে তোমরা জীবনের কমনীয়তাটুকু বোঝো, কামড়টুকু বোঝো না। তোমরা আজ মহা কিছু করবে! ইতিহাস রচনা করবে! জেনে রেখো এই দেশের আমিই প্রথম ব্যক্তি যে বিদেশে স্টিম বয়লার রপ্তানি করেছি। ইতিহাস আমিই রচনা করেছিলাম।’-তখন সেই বাক্যে আমরা কোনো বিদ্রুপের দাগ দেখি না। আবার বাহরাম যখন বলছে- ‘জামশেদ, সমস্যাটা হলো তুমি কবি হয়ে উঠলে কিনা এটা তোমার লেখার অন্তত একশ বছর পর ছাড়া কেউ বলতে পারে না। কাজেই তুমি সত্যিই কবি হলে কিনা তা আমাদের জানার কোনো সুযোগ এ জীবনে হবে না। কবিতা লিখতে হলে বিশ্বাস নিয়েই লিখতে হবে, প্রমাণ করে দেখা যাবে না।’ তখন দেখি এ কথাও খুব সিরিয়াস, বিদ্রুপের কোনো শব্দ বা আবহ কিছুই এখানে নেই। জামশেদের কথাও একই রকম সিরিয়াস ও শব্দলগ্ন যখন সে বাহরামকে লিখছে-‘তোমার মেধাটা একটু পণ্ডিতি ধরনের। ফলে তুমি অনেক তথ্য মাথায় রাখতে পারো আর তার বদৌলতে যা কিছু পড় তার ওপর পণ্ডিতের মতো কথা বলতে পারো। আর এ কারণেই পাঠের বস্তুটাকে গভীর শক্তিতে তুমি উপলব্ধি করতে পারো না।’ আর শেষ অবধি মাওলানা আরাকান খানের শব্দ ও বাক্যও বিদ্রুপহীনভবে তেজোময় যখন তিনি বলেন ‘তোমার কবিতায় অনেক আবেগ, কিন্তু আত্মা কই? এটা এত অন্তঃসারশূন্য কেন? এটা কি এ কারণে যে তুমি খুব সস্তাভাবে পশ্চিমাদের অনুকরণ করছ? হতাশা ও শূন্যতা নিয়ে লেখা কেন? পশ্চিমাদের ইতিহাস তোমাদের ইতিহাস না। ক্লান্তি ও বিচ্ছিন্নতাবোধ নিয়ে এত কথা কেন? এত অনুতাপের গান কেন? এগুলো ওদের পরাজয়ের শতাব্দীর কথা, ওদের নৈতিক বিপর্যয়ের কথা। এগুলো তুমি লিখছ কারণ তুমি আধুনিক শিক্ষা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছ। অবশ্যই আমি তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য দায়ী করব না।’ যদিও এই ঘটনার অভ্যন্তরে একটু বিদ্রুপ আছে, কারণ তিনি পণ্ডিত যতই উঁচু হোন তিনি ধরতে পারেননি যে এগুলো আধুনিক পশ্চিমা কবিতার অনুবাদ। কিন্তু চরিত্রগুলোর উচ্চারিত শব্দে কোথাও বিদ্রুপ বা ব্যাজস্তুতি নেই। তাহলে এর বিদ্রুপের কাঠামোটি কোথায়?

এর বিদ্রুপের কাঠামোটি হলো এই দুই পরীক্ষার আয়োজনে। পরীক্ষা দিয়ে বাহুশক্তির পরীক্ষা হয়। সে পরীক্ষা মিসাইল আর কালাশনিকভ রাইফেলে হতে পারে, রামদা-বল্লমে হতে পারে, আবার এমনকি গ্যারেজের ফেলে রাখা পুরোনো হাবিজাবি দিয়েও হতে পারে। কোনোটাই বাহুশক্তি পরীক্ষার কোনো বিদ্রুপাত্মক ফর্ম নয়। কিন্তু সাহিত্য, নন্দন আর দর্শনের ক্ষেত্রে কোনো পরীক্ষা দিয়ে মাঠ দখলে রাখার প্রয়াস তা সে যত উচ্চমার্গীয়ই হোক, সম্পূর্ণভাবে হতাশাব্যঞ্জক এবং সম্পূর্ণভাবে বিদ্রুপাত্মক। সে পরীক্ষার পরীক্ষক ও পরীক্ষার্থী যত উচ্চমার্গীয় হোক, তাতে বিদ্রুপ অপসৃত হয় না। এখানে পরীক্ষার্থী জামশেদের পাঠ ও প্রয়াসে কোনো হাস্যকর বা মশকরাসুলভ অপ্রস্তুতি নেই। এমনকি সে যখন বিদেশি কবিতার অনুবাদ দিয়ে এ পরীক্ষায় পার পেতে চাচ্ছে, তখনো তাকে বিদ্রুপাত্মক ভাবার অবকাশ কম। কারণ, প্রকারান্তরে সে পশ্চিমা আধুনিক কবিতাকেই পরীক্ষার মাঝে ঠেলে দিচ্ছে। মাওলানা আরাকান খান জামশেদের কবিতার যে মূল্যায়ন করেছেন, তা-ও মূলত সাহিত্য ও নন্দনের ইতিহাস থেকে উঠে আসা মূল্যায়নই। তার ওই মূল্যায়নকে বিদ্রুপাত্মক বলতে গেলে সাহিত্য ও নন্দনের ইতিহাস থেকে মিস্টিক্যাল অধ্যায়কেই বাদ দিতে হবে। ফলত মূল বিদ্রুপটি কোনো মূল্যায়নে ও মন্তব্যে নয়। মূল বিদ্রুপের লক্ষ্য হলো এই ভাবনা যে, সাহিত্য ও নন্দনকে কোনো মজলিশি মূল্যায়ন বা বিচারকর্মের মধ্যে আনা যায়। সাহিত্য ও নন্দনের এই প্রপঞ্চে এ রকম যেকোনো মজলিশি পরীক্ষা বা মূল্যায়ন এবং সেই মূল্যায়নের মাধ্যমে কাউকে পাস করানো আর কাউকে ফেল করানোর যেকোনো প্রয়াস ঠিক তেমনভাবে ব্যর্থ ও হাস্যকর হবে, যেমনটা হয়েছে জামশেদ আর মাওলানা আরাকান খানের ক্ষেত্রে। এভাবেই গল্পটি একটি ভিন্নতর বিদ্রুপের গল্প, যা প্রকারান্তরে বিদ্রুপ করছে নন্দন ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের সর্বোত স্বীকৃত অনেক একাডেমিক চর্চা ও পদ্ধতিকে পর্যন্ত।  

‘আয়েশাকে হারিয়ে’ গল্পটি একটু দীর্ঘ। গল্পটি ক্ল্যাসিক ধারায় সাসপেন্স সরিয়ে লিখিত। গল্পের প্রথম বাক্যেরও আগে একেবারে গল্পের শিরোনামে বলে দেয়া হয়েছে গল্পের ক্লাইমেক্সে গিয়ে কী ঘটবে-উত্তম পুরুষ কথক তার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলবে আয়েশাকে। খুব আত্মপ্রত্যয়ী লেখক ছাড়া সহজে কেউ এভাবে সাসপেন্স নিধন করে গল্প বলতে সাহস করে না। বইয়ের প্রথম গল্প দুটো সাসপেন্স-ভিত্তিকভাবে লেখার পর লেখক যেন এক চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন সাসপেন্স নিধন করে ক্ল্যাসিক মহাকাব্যের ধারায় গল্প বলার। সে চ্যালেঞ্জে তিনি সফল। আয়েশা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, এই ক্লাইমেক্সকে প্রথম জানান দিয়ে দ্বিতীয় ধাপে তিনি আরও একবার গড়ে উঠতে যাওয়া সাসপেন্সকে নিধন করেন ইবিদ স্টোরে আয়েশাকে একঝলক দেখিয়ে এই অর্থে সরিয়ে নিয়ে যে আয়েশা আর কথকের জীবনে কখনো ফিরে আসার নয়।

সাসপেন্স সরিয়ে লেখক গল্পটিকে দুটি ঘটনাবিন্দুতে বিভক্ত করে একটির দ্বারা দ্বিতীয়টিকে শাণিত ও শক্তিমান করে তার কথকতা গতিময় রেখেছেন। লেখক কাজী আনিস আহমেদের এই কারিগরি শৈলীটি একাধিক গল্পে দৃশ্যমান যে তিনি গল্পটিকে একাধিক ঘটনাবিন্দুতে ভাগ করেন এবং অনেক সময় একটিকে ব্যবহার করেন অপরটির ‘ফয়েল’ হিসেবে। ফয়েল’রূপে হোক বা ভাবনার উৎসবীজরূপে হোক, প্রথম ঘটনাটি দ্বিতীয়টিকে অব্যর্থভাবে শাণিত করে ও শক্তিমান করে। ‘পরীক্ষা দিয়ে কবি হওয়া’ গল্পে পার্কের মাঠ দখলের লড়াইটা ছিল, কবিতার পরীক্ষা তথা কবিতার ও নন্দনের লড়াইয়ের মূল ঘটনার ফয়েল। একইভাবে ‘আয়েশাকে হারিয়ে’ গল্পে শুরুর দিকের ফুটবল খেলার গল্প এবং সে গল্পে জীবন থেকে একটি ফুটবলের বিকাল হারানোর গল্প পুরোটাই আয়েশাকে হারানোর চূড়ান্ত গল্পের ‘ফয়েল’। ফলে গল্প মূলত দুটো নয়। গল্প একটাই। অনেক ব্যাকরণিক পাঠক এই গল্পগুলোর ব্যাপারে এই ভেবে ভুল করতে পারেন যে, ছোটগল্পের আখ্যানিক ঐক্য বুঝি আনিস আহমেদের গল্পে ব্যাহত হচ্ছে; কারণ, তাঁর অনেক গল্পেই রয়েছে এমন একাধিক গল্প। তাদেরকে একটু তলিয়ে দেখতে হবে এবং খুঁজে নিতে হবে কীভাবে আনিস আহমেদ তাঁর শৈল্পিক যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন একাধিক গল্পকে মূল গল্পটির কাঠামোর মধ্যে লীন করে দিতে। এমন নয় যে তাঁর ছোটগল্পগুলোয় একই গল্পের একাধিক ডালপালা রয়েছে, বরং মূল গল্পটি বেঁচে আছে প্রথম বা দ্বিতীয় ছোটগল্পটি থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করে। ডাল একটি কেটে দিলেও গাছটি বেঁচে থাকে, কিন্তু প্রাণরসের শিকড়গুলো কেটে দিলে বৃক্ষটির জীবনই বিপন্ন হয়।

‘আয়েশাকে হারিয়ে’ গল্পটি যতটা প্রেমের গল্প তার চেয়ে অনেক বেশি নিঃসঙ্গতার দার্শনিক অনুভবের গল্প। নিঃসঙ্গ কথক বলছে-‘আমরা যখন কারও সঙ্গে কথা বলি তখন একটি ভিন্ন চেতনার রাজ্যে ডুব দেই। ভাগ্য ভালো হলে আমরা সেখানে চেতনাসলিলের এক নতুন গভীরতার সন্ধান পাই। সেই চেতনাস্রোতে নতুন বাঁক থাকে, কোথাও কোনো অপ্রত্যাশিত ঘূর্ণি থাকে, আশ্চর্য হওয়ার উপাদান থাকে, এবং কখনো কখনো সমর্থনযোগ্য নতুন ভাবনাও থাকে। আমি চাইতাম আমার কথা বলার লোকদের মাঝে আমি পাব চেতনার এমন নদী বা সাগরের মতো গভীরতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার বারবার খালি জুটত কাদার ডোবা।...আয়েশাকে হারানোর পরে ভেবেছিলাম ভালো করে খুঁজলে আরও পরিপূর্ণ কাউকে হয়তো পেয়ে যাব। কিন্তু পঁচিশ বছর হয়ে গেল কাউকে পেলাম না।’ এই প্রতীতির মধ্য দিয়ে অনুমিত হয় আয়েশা একটি মানবী নয়, চেতনাসলিলের এক সাগরসম গভীরতা। চেতনার এই রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে হলো ‘নিঃসঙ্গতা’। নারীসঙ্গ, নারীদেহ, রমণানন্দ কিছুতেই যে নিঃসঙ্গতা থেকে পরিত্রাণ ঘটে না সেই নিঃসঙ্গতার গল্প এটি। ‘আয়েশা’ এই অপার নিঃসঙ্গতাবিনাশী চেতনার একটি প্রতীকমাত্র। নিৎশে কি সে নিঃসঙ্গতার উৎসমূল? গল্পটি সে কথা খোলামেলা না বললেও, গল্পটিতে নিৎশের অনেক প্রসঙ্গ এ প্রশ্নকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। 

‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার ও অন্যান্য গল্প’ বইয়ের পরের গল্পটি হলো ‘তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দিন’। এ গল্পটিতেও একজন উত্তম পুরুষ চরিত্র আছে। তবে তিনি গল্পের নায়ক, নাকি তার আত্মহত্যাকারী বন্ধু আমজাদ এ গল্পের নায়ক, তা স্পষ্ট নয়। আমজাদ সরকারি ছোট চাকরি করত। সে হঠাৎই আত্মহত্যা করে। আমজাদ সাদা-লাল অফিসসুতায় বাঁধা একটি মোড়কের এক কোণে লিখে রেখেছে উত্তম-পুরুষ কথক-চরিত্রের নাম। সে নাম কী, তা অবশ্য পাঠককে জানতে দেয়া হয়নি। মোড়কের কোণে ওই নাম লিখিত থাকায় তাদের আরেক বন্ধু বাদল মোড়কটি কথকের কাছে পৌঁছে দেয়। কথক অনেক দিন অপেক্ষা করে অনেক আশঙ্কা নিয়ে মোড়কটি খোলে এবং সেখানে দশ-বারোটি কাগজে লিখিত আমজাদের জীবনের কয়েকটি টুকরা ঘটনা থেকে নিংড়ানো শূন্যতার কিছু অনুভবের সম্মুখীন হয় কথক।

যে ঘটনা থেকে আমজাদের জীবনে এমন অনুভবের সন্দর্শন ঘটে, সেগুলো খুবই মামুলি ঘটনা। এক দিন অফিস থেকে বের হয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাওয়া, আরেক দিন স্কুলজীবনে ক্লাসের মধ্যে বাইরে এক বৃষ্টির দৃশ্যের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। এই দুই হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্যে এমন কিছু মুহূর্তের দেখা মিলেছিল আমজাদের জীবনে যে মনে হচ্ছে অমন কোনো মুহূর্তের সন্ধানে সে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু জীবনের যে অর্থহীনতার বোধ এই গল্প ধারণ করে, সুখের সংজ্ঞাহীনতার যে বোধ এ গল্প ধারণ করে, যে বোধের জারণ ঘটলে জীবনের চেনা জগৎ অচেনা হয়ে যায়; সে বোধের মৃত্যু হয়নি আমজাদের মৃত্যুর সঙ্গে। বরং প্রায় অর্থহীন কয়েকটি কাগজের টুকরার মধ্য দিয়ে সেই বোধ প্রবাহিত হয়েছে কথকের জীবনে।

কিন্তু কীভাবে হলো? আমজাদের ওই চিরকুটগুলো কি এতখানি দার্শনিক প্রজ্ঞার ধারক যে তা হঠাৎ বদলে দিতে পারে কথকের এত দিনের জীবনদর্শন? না, সেগুলো মোটেই দার্শনিক প্রজ্ঞার কোনো উচ্চারণ নয়। তবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চমকে দেয়ার এক কঠিন কাব্যিক শক্তি। সেই তিনটে চিরকুট জাগিয়ে তোলে সেই দৈত্যাকার কাব্যিক বোধকে, যা জীবনানন্দ তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁর ‘আট বছর আগের একদিন’ নামক অমর কবিতায়। ‘তবু সে দেখিল কোন ভূত? ঘুম ভেঙে গেল তার?’-এই উচ্চারণে জীবনানন্দ যে ভূতের কথা বলেছেন এবং যে ঘুম ভাঙার কথা বলেছেন, আমরা দেখছি, আমজাদের ওই আপাত-অর্থহীন চিরকুটগুলোর মধ্য দিয়ে গল্পটির কথক-চরিত্রও দেখে ফেলেছে সেই ‘ভূত’ এবং ভেঙে গেছে তারও ‘ঘুম’। গল্পটি যেন জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতারই এক সার্থক গল্পরূপ।

বইয়ের নামগল্প ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার’ আরেকটি অন্য রকম মুক্তিযুদ্ধের গল্প। গল্পের নায়ক জেমস ডি-কস্তা সারা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে হানাদার বাহিনী কর্তৃক তার বাবাকে হত্যার করুণ স্মৃতি। গল্পে খুব বিশ্বাসযোগ্য আবহে চিত্রিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের এক ঐতিহাসিক চরিত্র মি. হেনরি কিসিঞ্জার। জেমস ডি-কস্তা অনেকটা পিকারেস্ক ধরনের একজন হিরো। তার শক্তিমত্তা, শারীরিক গড়ন ও ঋজুতা এবং নিজস্ব বোধজাত ন্যায় ভাবনার পক্ষে তার অন্যুব্জ লড়াই তাকে এ নায়কত্ব প্রদান করে। পিকারেস্ক হিরো হিসেবেই সে ন্যায়ের লড়াইয়ে মাঝে মাঝে সমাজের মূল্যবোধের ও সংস্কারের অনেক কিছু ভেঙে যায় ও ভেস্তে যায়। কিন্তু এ নিয়ে সে গা করে না। তবে অনেক পিকারেস্ক হিরোর মতো তার গায়ে বহু নারীর যৌন সংস্রবের দাগ নেই কিংবা দন কিহোতের মতো হাস্যস্পদতা তার চরিত্রে নেই।

ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ে তার অনড় অবস্থানের কারণেই ভাড়া করা গুন্ডাসহ তার নিজের ছাত্র জেমসের হাতে ধোলাই খায় এবং ছাত্রটিকে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে হয়। তখন ছাত্রটি যে গুন্ডা ভাড়া করে শিক্ষককে মারতে এসেছিল, সমাজ ঘটনাটিকে সেভাবে না দেখে বরং এভাবে দেখতে শুরু করে যে শিক্ষকের মার খেয়ে ছাত্রকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। ন্যায়ের প্রশ্নেই ছাত্রের অভিভাবক তার কাছে গলাধাক্কা খায়, পুলিশ নাজেহাল হয় এবং প্রিন্সিপালের টেবিল তার মুষ্ট্যাঘাতে দড়াম করে ওঠে। আবার এই ঘটনাগুলোর কারণেই সমাজের দৃষ্টি তাকে আইডিয়াল হিরো থেকে নামিয়ে পিকারেস্ক হিরোতে দাঁড় করায়। কিন্তু লেখক গল্পের শেষাংশে পাঠককে দাঁড় করায় এক অনিষ্পত্তিকৃত ধন্দের মাঝে। আমরা জেমসকে কীভাবে চাই? আইডিয়াল হিরো হিসেবে, নাকি পিকারেস্ক হিরো হিসেবে? 

ভাড়া করা গুন্ডাসহ তার নিজের ছাত্রকে মেরে সমাজের উল্টোস্রোত ভাবনার কারণে যে সমস্যায় পড়তে হয়, সে সমস্যা থেকে জেমসের মুক্তি ঘটে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর মধ্য দিয়ে। ঢাকায় বেড়াতে যেতেও এখন আর তার খুব ইচ্ছে করে না। ঢাকার অনেক কিছু মায়ার সঙ্গে স্মরণ করলেও সে এখন তার বর্তমান জীবন নিয়েই বেশি সুখী। বাবার ঘাতকদের একবার বাগে পেলে মধুর প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছেটাও আর তার সঙ্গে নেই। ‘আমার মেজাজের সবটুকু আগুন বলা যায় আমেরিকায় এসে ঠান্ডা হলো’-জেমস নিজে নিজেই উচ্চারণ করছে। আমেরিকার ভদ্র পরিবেশ তাকে পিকারেস্ক নায়কত্ব থেকে সরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এক আদর্শিকতার রাজ্যে যেন প্রতিস্থাপন করছে। কিন্তু সেই নিরীহ আদর্শিক ভাবনার জীবনটি আবার হোঁচট খায় ‘দি সলস্টিস’ রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের চাকরির সময়ে ওই রেস্টুরেন্টে মাঝে মাঝে খেতে আসা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের এক খলনায়ক মি. কিসিঞ্জারকে ওয়েটার হিসেবে সেবা দিতে গিয়ে। মি. কিসিঞ্জার জেমসের বাংলাদেশি পরিচয় পেয়ে তাকে প্রতিবারে খালি খোঁচাতে থাকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও তার স্বাধীনতার অর্থহীনতা নিয়ে। খোঁচায় খোঁচায় জেগে ওঠে জেমসের পুরোনো জীবনের পিকারেস্ক নায়কত্বের ভাবনাগুলো। আমরা দেখি জেমস ভাবছে-‘ডেজার্ট খাওয়ার ঝকমকে ছুরিটি তখনো টেবিলে পড়ে আছে। কিসিঞ্জারের ঘাড়টি যে পরিমাণ নরম ও ভাঁজপড়া, তাতে ওই ভোঁতা ছুরি দিয়েও কাজটি সাবাড় করে দেয়ার মতো। আর আমি প্রায়ই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে ফেলি এমন তাৎক্ষণিক আবেগেই, যদিও আমি চাই না এমন আবেগে কোনো কাজ করতে।’ উত্তম পুরুষ কথক-চরিত্র জেমস আবার একসময় বলছে-‘সেই সাক্ষাতের পর থেকে কিসিঞ্জারকে এক ঘা বসানোর ভাবনা থেকে আমি একদম নড়তে পারছিলাম না। সেই কিশোরকাল থেকে এ পর্যন্ত আর কোনো ঘটনায়ই একটি আক্রমণ বা সন্ত্রাসের কল্পনা একটানা এত দিন ধরে আমার মাথায় আটকে থাকেনি। ভাবছিলাম, এবারের আক্রমণে একটি কাবাব কাটার ছুরির বাইরে আর তেমন কোনো অস্ত্রের সুযোগ আমার নেই।’ শেষ পর্যন্ত জেমসের সেই পিকারেস্ক নায়কত্বের জয় আমরা শেষবারে দেখি না। বরং দেখি তার আমেরিকার আদর্শিক নিরীহ জীবন-ভাবনার জয়। গল্প শেষ হয় কিসিঞ্জারকে সম্পূর্ণভাবে ভদ্র এক ‘গুডনাইট’ জানিয়ে। তবে ইঙ্গিতে বোঝা যায়, এই ‘গুডনাইট’ শুধু কিসিঞ্জারকে নয় বরং সলস্টিস রেস্টুরেন্টের চাকরিকেও জেমস হয়তো একই সঙ্গে গুডবাই জানিয়েছে।

কিন্তু পাঠক কী চেয়েছিল? গল্পের কথন সম্পূর্ণভাবে পাঠকের মাঝে এই প্রত্যাশা জাগিয়েছিল যে জেগে উঠুক জেমসের সেই পিকারেস্ক নায়কত্ব এবং একটি ভোঁতা অস্ত্রের বাঙালির আক্রমণে শেষ হোক খলনায়ক মি. কিসিঞ্জারের বৃদ্ধ প্রাণটুকু। আর পরোক্ষে লেখক রেখে গেলেন পাঠককে এই ধন্দে-জেমস যা করেছে, তা-ই ঠিক আছে; নাকি ঠিক ছিল যা সে করেনি, তা-ই করা? পিকারেস্ক নায়কত্ব উত্তম, নাকি আদর্শিক নায়কত্ব উত্তম?

‘ফেরার বছর’ গল্পটি ঢাকার এক আন্ডারওয়ার্ল্ড কাহিনি, এক অপরাধজগতের কাহিনি। বইয়ের পেছনের গল্পগুলো থেকে ধারণা করা কঠিন যে যাপিত জীবনের দার্শনিক বোধ ও সংকটগুলোর বাইরে ঢাকার অপরাধজগতের কায়দাকানুন ও ক্রাইসিসসমূহ সম্পর্কেও এই বইয়ের লেখক সম্যক ওয়াকিবহাল। লেখক তাঁর গল্পের উত্তম পুরুষ কথক-চরিত্রকে যে অবয়বে উপস্থাপন করেছেন, তাতে দেখা যায় যে সেই উত্তম পুরুষ চরিত্র আন্দালিব খান ঢাকার অপরাধজগৎ সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নয়। সে বাইরের দেশে বড় হওয়া মানুষ। লেখক সম্বন্ধে আমাদের যে ভাবনা সেই ভাবনা লেখক কথকের অবয়বে চাপিয়ে দিয়ে গল্পের কথকতা পরিচালনা করেছেন, যাতে লেখক-কথকের অভিন্নতাবিষয়ক একটি ঘোর পাঠকের মধ্যে তৈরি হয়। এই ঘোরও এ গল্পের নান্দনিকতার অংশ। 

সেই ঘোরের মধ্যে থেকেই পাঠক উত্তম পুরুষ চরিত্রের জবানিতে প্রবেশ করতে থাকে ঢাকার রাজনীতিনিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাস-রাজত্বের মধ্যে। একেবারেই সীমিত চরিত্রের বয়ান। আন্দালিব খান, শামীম আর বাদশাহ। নামহীন আর দু-একটি চরিত্রমাত্র। আন্দালিব খান ঢাকার সন্ত্রাস-রাজত্বের চাঁদাবাজি থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নেয় তার বন্ধু চাঁদাবাজ বাদশাহর কাছে। সে আশ্রয় তার জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনে। আগের নামহীন চাঁদাবাজ তার কাছে চাঁদা চেয়েছিল ৫০ লাখ টাকা, এবার আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা বন্ধু তার কাছে ধার চায় ১ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত বাদশাহর যে প্রশ্রয়ে মিলত মদ ও মেয়েলোক, সেখানেই বন্ধুর হাতুড়িবাহিনীর হাতে ভালো মতো ধোলাই খেয়ে ৫ লাখ টাকা খুইয়ে কোনোমতে জীবন বাঁচে আন্দালিব খানের।

পাঠকের কাছে অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়। আন্দালিব খান সন্ত্রাসী বন্ধুর আশ্রয় চেয়ে ভালো করল, নাকি না চাইলে ভালো করত? সাহায্য না চাইলে কি তার ৫০ লাখ টাকা পুরোটাই সন্ত্রাসীর পেটে চলে যেত? বন্ধু সন্ত্রাসের গডফাদার বলেই কি হাতুড়িবাহিনীর কাছ থেকে সে জীবন ভিক্ষা পেল? এই প্রশ্নগুলো রেখে যাওয়ার মধ্য দিয়ে কি গল্পটি ছোটগল্পের সেই বেসিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করল? যে বৈশিষ্ট্যমতে ছোটগল্পের কাজ হলো প্রশ্নের উত্তর দেয়া নয়; বরং প্রশ্ন রেখে যাওয়া। এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। তবে পাঠক হিসেবে গল্পটির পরোক্ষ একটি মার্জিনের মন্তব্য অনুধাবন করি। তা হলো, ঢাকার সংস্কৃতিতে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে আজ আর রাষ্ট্র এবং পুলিশ কোনো সমাধান নয়। এই সমাধানের কথা আজ আর কেউ মনেও আনে না। ঢাকার সংস্কৃতিতে আজ সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির সমাধান রাজনীতিলালিত সন্ত্রাস নিজেই।

‘রামকমলের উপহার’ এই বইয়ের এমন একটি গল্প, যা সামাজিক বাস্তবতার একটু বাইরে দাঁড়ানো। এ গল্পে বাস্তবতার ওপরে নিরীক্ষণ রয়েছে। যে বাস্তবতা এই গল্প ধারণ করতে চায় শিল্প-সাহিত্যজগতের বাস্তবতাবাদবিষয়ক এযাবৎ প্রতিষ্ঠিত থিয়োরি দ্বারা সরাসরি তাকে বিধৃত করা যায় এমনটা ঠিক নয়। বলা যায়, গল্পটি ধারণ করতে চায় এমন একটি বাস্তবতা যা ধারণে সাহিত্যিক ফর্মগুলো এখনো খুব সক্ষম নয়। এই বাস্তবতাকে ধারণে অক্ষম অবস্থায় সাহিত্যের কী অবস্থা হয় তার কিছুটা নমুনা রয়েছে বোর্হেসের ‘এল আলেফ’ গল্পে। লেখক যদি অসাহিত্যিক হন আর তিনি যদি এই বাস্তবতাকে তাঁর সাহিত্যে ধারণের প্রয়াসে বেকুবের মতো নেমে পড়েন, তাহলে এই বাস্তবতাকে ধারণে অক্ষম সেই লেখকের সাহিত্যের অবস্থা হয় ঠিক যা হয়েছিল ‘এল আলেফ’ গল্পে বর্ণিত দানেরির কবিতায়। আর লেখক যদি বোর্হেস নিজে হন, তাহলে ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখে উচ্চারিত হয় হ্যামলেটের আফসোস-‘ O God! I could be bounded in a nutshell, and count myself a King of infinite space...। আর আমাদের কাজী আনিস আহমেদের গল্পে ওই অসম্ভাব্যতার প্রতীকী প্রকাশ ঘটেছে লেখক রামকমলের চিরতরে নাই হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।

রামকমল সেই বাস্তবতা একটি উপন্যাসে ধারণের প্রচেষ্টায় নেমেছিল এবং কীভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, তা বলার গল্প হলো ‘রামকমলের উপহার’। রামকমল একজন সাহিত্যিক। তার লেখাপড়া প্রচুর এবং কল্পনাও বেশ তেজি। সে তার লেখাপড়ায় ঋদ্ধ শিল্প-সাহিত্যের দ্বারা আলোকিত করেছে এই গল্পের অন্যান্য চরিত্র বাহার, জয়দীপ ও গল্পের উত্তম চরিত্র কথককে, যাকে সে ‘বার্গার’ বলে ডাকে। সে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে কাফকার ত্রাসের জগতের সঙ্গে এবং ভন ক্লিস্টের মোহনীয়তার সঙ্গে। রামকমলের সুবাদেই তারা ‘বার্নহার্ডের রাগের রসিকতা এবং দানিলো কিশ-এর মর্মবাদিতা’ বুঝতে শিখেছিল। তার আলোচনায় সে তার শিষ্যদের বুঝতে শিখিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার হালের দিগ্বিজয়ী সাহিত্যিকদের যেমন কার্পেন্তিয়ের এবং কোর্তাসার, বোর্হেস এবং রুলফো, এবং আরও কিছু জাদুবাস্তবতার লেখকদের। তার আলোচনায় আরও আসত  ‘আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদারে, স্পেনের হুয়ান গয়তিসেলো প্রমুখ’। তার জীবনের অভিজ্ঞতাও বিচিত্র। ‘কমিউনের ওপর বিরক্ত হওয়ার আগে’ সে এক গান্ধীগ্রামে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। তার জীবনের অনেক বছর কেটেছে পূর্ব ইউরোপের কিছু কৃষি সরঞ্জামের এক পরিবেশক হিসেবে। আবার একটি স্বল্পায়ু বামপন্থী দলের একজন হয়ে হাভানা ও হো চি মিন সিটিতে সে ভ্রমণও করেছিল।

এতখানি পড়াশোনা জানা আর অভিজ্ঞতাঋদ্ধ এক লেখক তার শিষ্যদের সম্মোহিতভাবে রাজি করেছে যে তারা সকলে মিলে একটি উপন্যাস লিখবে ঢাকা শহর নিয়ে। ‘সে বলত আমাদের যা করতে হবে তা হলো একেবারে নতুন এক কায়দায় শহরটাকে এবং উপন্যাসটাকে এক করে ফেলতে হবে।’ এই উপন্যাসের পরিকল্পনায় সে আরও বলত-‘আমরা যেটা লিখতে চাচ্ছি, সেটি হবে একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যানুয়াল। এই ম্যানুয়াল গবেষকের মতো বলবে কীভাবে একটি মানুষ সত্যিকারের নাগরিক হয়ে উঠবে এমন একটি নগরীতে, যে নগরীর নগরী হয়ে ওঠা চিরদিনের জন্য আটকে গেছে।’ রামকমলের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকা ছিল তার শিষ্যদের কাছে কংক্রিটের এক দৈত্যাকার নির্মাণ, তবে বড়ই হতদরিদ্র। বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হতো রিকেটস রোগাক্রান্ত কতগুলো হাত-পা নিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে, যেকোনো সময় ধপাস করে গুঁড়িয়ে পড়বে। হাত-পা তো তবু কতগুলো আছে, গায়ে ছালবাকল, রং-চেহারা কিছু নেই। কিন্তু রামকমলের পরিকল্পনার এই উপন্যাসের প্রকল্পে হাত দেয়ার পর থেকে তাদের মনে হতে থাকে-ঢাকা এক বিশাল উপন্যাসের টেক্সট, যেখানে লাখে লাখে কংক্রিটের নির্মাণ সব এক টেক্সটের পাতায় পাতায় সেঁটে যাওয়া স্থায়ী সব অক্ষর। ঢাকা নামের বাস্তবতাকে উপন্যাসের টেক্সট বানানোর পরিকল্পনায় রামকমলের শিষ্যরা ভাবতে শুরু করে-‘যেকোনো জায়গাই শব্দের অক্ষরে বর্ণিত হওয়ার মধ্য দিয়ে জায়গাটি নতুন এক রূপে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সত্যি বলতে সেই রূপ লাভের পূর্ব পর্যন্ত জায়গাটি অস্তিত্বশীলই হয়ে ওঠে না। এই বিশ্বাসসূত্রেই আজকের ঢাকার যা কিছু আমাদের খুব ছোট ও নিচ করে রেখেছে-যেমন রিকশাওয়ালাদের গাধার খাটুনি, খানাখন্দে ভরা রাস্তা, পানের পিক ফেলা হাটুরে জনগণ, জাঁকালো ভবনের ভুয়া মার্বেল বহির্দৃশ্য, দোকানগুলোর রংচঙা ভুয়া সব জিনিসপত্র, তাবৎ ভুয়ামির শিকার নাগরিকদের খাই খাই ভাব-রামকমলের লক্ষ্যভূত গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সবকিছুর জন্য এক অভাবিত নতুন অর্থের জগৎ তৈরি হবে।’
কাজী আনিস আহমেদ

কিন্তু সাহিত্যের এবং শিল্পের জগতের সীমাবদ্ধতার বাস্তবতা হলো এই যে ভাষায় গঠিত টেক্সট কখনো বস্তুগঠিত টেক্সটের সমান্তরাল বাস্তবতা ধারণে সক্ষম হয় না। এ কারণেই ‘এল আলেফ’ গল্পে দানেরির কবিতা এক মূর্খের পদাবলি হয়ে ওঠে আর বোর্হেসকে আফসোস প্রকাশের জন্য হ্যামলেটের বাক্য ধার করে বলতে হয়-‘ O God! I could be bounded in a nutshell, and count myself a King of infinite space...।’ কবিগুরুও এই অসম্ভাব্যতার কথা বাল্মীকির জবানিতে এভাবে বলেন-‘মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বদ্ধ চারি ধারে,/ঘুরে মানুষের চতুর্দিকে। ... প্রভাতের শুভ্র ভাষা বাক্যহীন প্রত্যক্ষ কিরণ/জগতের মর্মদ্বার মুহূর্তেকে করি উদ্ঘাটন/নির্বারিত করি দেয় ত্রিলোকের গীতের ভাণ্ডার;/যামিনীর শান্তিবাণী ক্ষণমাত্রে অনন্ত সংসার/আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, বাক্যহীন পরম নিষেধ/ ... দক্ষিণের সমীরের ভাষা/কেবল নিশ্বাসমাত্রে নিকুঞ্জে জাগায় নব আশা,/দুর্গম পল্লবদুর্গে অরণ্যের ঘন অন্তঃপুরে/নিমেষে প্রবেশ করে, নিয়ে যায় দূর হতে দূরে/যৌবনের জয়গান-সেইমত প্রত্যক্ষ প্রকাশ/কোথা মানবের বাক্যে, কোথা সেই অনন্ত আভাস,/কোথা সেই অর্থভেদী অভ্রভেদী সংগীত-উচ্ছ্বাস,/আত্মবিদারণকারী মর্মান্তিক মহান নিশ্বাস?’ মানবের বাক্যে সেই ‘প্রত্যক্ষ প্রকাশ’, সেই ‘অনন্ত আভাস’ এবং ‘আত্মবিদারণকারী মর্মান্তিক মহান নিশ্বাস’ নেই বলেই মানবের সৃষ্টির বাইরের ‘সৃষ্ট’কে ধারণের বা ‘টেক্সট’ভূত-করণের সামর্থ্য তার নেই। এমন সামর্থ্যহীনতার প্রতীকী প্রকাশ হলো এমন কল্পনার যে আয়োজক সেই রামকমলের নেই হয়ে যাওয়া। ‘রামকমলের উপহার’ গল্পের আসল উপহার হলো ভাষার ও ভাষাসৃষ্ট টেক্সটের এই সীমাবদ্ধতাসম্পর্কিত বোধ। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়।

‘এলিফ্যান্ট রোড’ গল্পটি এলিফ্যান্ট রোড নিয়ে নয়, এমনকি গল্পটি অনিন্দ্যর চাকরি হারানোর যে বয়ান দিয়ে শুরু হয়, সেই চাকরি হারানোর গল্পও নয়। গল্পটি মূলত কারও প্রতি অন্যায় করার পরে বিবেকের দংশনে আত্মসম্ভ্রম হারিয়ে হলেও তার কাছে মাফ চেয়ে বিবেকের দংশন থেকে নিজেকে মুক্ত করার গল্প। এটা একধরনের সিন অ্যান্ড সালভেশনের গল্প-পাপ ও পাপমোচনের গল্প।

অনিন্দ্য চাকরি হারানোর দিনেই অফিস থেকে নেমে এলিফ্যান্ট রোডে যায় তার স্কুলছাত্রী মেয়ের জন্য এক জোড়া পিটি শু কেনার জন্য। সে জুতা নিয়ে দোকান থেকে বের হয়েই শুনল অনেক মানুষের চিৎকার-‘ধর, ওকে ধর’। অনিন্দ্য দেখছে শুধু মানুষ ছুটছে। তাদের সামনে পাল্লায় এগিয়ে চিতার মতো দ্রুততায় ছুটছে একটি কিশোর ছেলে। পেছনে যে জনতা তাকে ধাওয়া করছে, তারাও কম বয়সী। মুখে জোর চিৎকার-‘ধর, ধর, ধর’। জনতা কাকে ধরার জন্য ছুটছে, অনিন্দ্য তা বুঝে ওঠার সেকেন্ডের মধ্যেই ছেলেটি তাকে অতিক্রম করছিল। আরও দু-এক সেকেন্ড ভাবতে পারলেও হয়তো অনিন্দ্য যা করেছে তা করত না। কিন্তু তেমন ভাবতে পারার আগেই অনিন্দ্য তার হাত থেকে ব্যাগটা নিচে ফেলে হাত দিয়ে পাশের ইলেকট্রিক পোস্টটা শক্ত করে ধরল এবং একটা পা সামনে জাগিয়ে ধরল। ছেলেটা অনিন্দ্যর পায়ের নলার সঙ্গে ধাক্কা খেল এবং তার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক পড়ে গেল না। জনতার তো দরকার ছিল তার গতিটা স্লো করার এক সেকেন্ড মাত্র। নলার ধাক্কার তাল সামলে উঠতে যখন সে চেষ্টা করছিল, ততক্ষণেই পেছন থেকে একজন এসে তাকে সোজা ধাক্কা দিয়ে সটান মাটিতে ফেলে দিল। আর ওঠার তার সুযোগ থাকল না।

অনিন্দ্য বুঝে উঠতে পারছিল না এলিফ্যান্ট রোডে সে যা করল, তা সে কেন করল। অনিন্দ্য বাসায় গিয়ে বালতিতে জমানো ঠান্ডা পানিতে স্নান করল। অনেক মগ ঠান্ডা পানি মাথায় ঢালল। কিন্তু তার পা দিয়ে ফেলে দেয়া ছেলেটির বিবর্ণ মুখ কিছুতেই সে তার মাথা থেকে ধুয়ে নামাতে পারল না। এরপর এই পাপ থেকে মুক্তির প্রয়াসই গল্পের পূর্ণ আয়োজন। ছেলেটিকে দেখতে অনিন্দ্য হাসপাতালে যায়। সেখানে সাংবাদিক সেজে দিনের পর দিন গিয়ে তার সঙ্গে খাতির জমায়। তারপর যেদিন অনিন্দ্য জানতে পারে যে আর দুদিন পরই ছেলেটি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে, সেদিন হঠাৎ করেই সে তার কৃতকর্মের কথা ছেলেটিকে বলে দিয়ে তার কাছে মাফ চায়। তারপরের ঘটনা অভাবিত। ছেলেটি তাকে মাফ তো করেই না; বরং প্রচণ্ড খিস্তিখেউড়ে সে অনিন্দ্যকে জর্জরিত করে। গলাটা সামনে বাড়িয়ে একদলা ঘন হলুদ শ্লেষ্মার মতো থুতু সে মুখ দিয়ে ছুড়ে মারে ঠিক অনিন্দ্যর মুখমণ্ডলে। অনিন্দ্য দৌড়ে পালায়। দৌড়ে বের হওয়ার পথে ওয়ার্ডের দরজায় এক মুহূর্ত থেমে সে তার শেষ ক্ষমাটি চায়-‘মাফ করে দিয়ো, আমি তোমার কোনো ক্ষতি চাইনি।’ ছেলেটি তাকে মাফ না করলেও অনিন্দ্য অনুভব করে সে তার বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পেয়েছে।

‘বৌয়ের ঘুমিয়ে পড়ার অনেক পরে আজ রাতেও অনিন্দ্য জেগে উঠল। গত রাতগুলোয় যেমন উদ্বেগ থেকে ঘুম ভাঙত আজকে তেমনটা নয়। আজ তার উদ্বেগ ও স্নায়বিক চাপ সরে গেছে। সে যেন তার মাঝে ফিরে আসতে পেরেছে এমনটা আজ তার অনুভব। ... অপরিচিত রূপের পেয়ারাগাছটি জ্যোৎস্নার আলোতে এক বৃদ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে-তাকে সঙ্গ দিচ্ছে এবং এই মুহূর্তে অনিন্দ্যর মনে হলো এটুকুই যথেষ্ট।’

অনিন্দ্যর সালভেশন এভাবে অর্জিত হলো ঠিকই, কিন্তু গল্পটি ‘সিন অ্যান্ড সালভেশন’ থিমের গল্পধারার ওপরে দুটো প্রশ্ন লটকে গিয়ে গেল। ‘লাভ’-এর সঙ্গে ‘মার্সি’র যে চিরন্তন যিশুখ্রিষ্টীয় সম্পর্কের বনিয়াদ, তা প্রকারান্তরে গল্পটি অস্বীকার করল। অনিন্দ্য অনেক অপমান সহ্য করেও যে প্রেম ছেলেটির জন্য প্রদর্শন করল, অনিবার্য চিরন্তনতায় তার থেকে প্রাপ্য ‘মার্সি’ তার লাভ হলো না। লেখক কি বলতে চান যে ‘অ্যানশিয়েন্ট ম্যারিনারের’ সেই ক্লাসিক যুগের সমাধি রচিত হয়ে গেছে? আজ আধুনিক যুগ। আধুনিক যুগে প্রেম থেকে বড়জোর আত্মপীড়নের যন্ত্রণার লাঘব হয়, ‘মার্সি’ লাভ আর সম্ভব নয়। নাকি এই গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক প্রশ্ন তুলছেন যে তোমাদের ওই প্রেম বুর্জোয়া আইডিয়োলজির প্রেম? এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে হয়তো প্রকারান্তরে তিনি বলছেন, তোমাদের ওই প্রেম থেকে অর্জিত শান্তিও বুর্জোয়া আইডিওলজির ছলনাময়ী শান্তি। সমাজকে এই ছলনা থেকে বাঁচতে হলে শিখতে হবে ওই ছেলের দ্রোহ এবং দেখাতে হবে ওই দ্রোহের তেজ। এই অমীমাংসিত দুই প্রশ্ন রেখে শেষ হয়েছে গল্প ‘এলিফ্যান্ট রোড’।

বইয়ের সবচেয়ে বড় গল্প ‘আমার শত্রুরা’, যেখানে শাহবাজ সাহেবের শত্রুদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু তিনি নিজে। এই দীর্ঘ গল্পটি ধীরে ধীরে বলে কীভাবে অর্থবিত্তের প্রতিযোগিতায় সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উচ্চাভিলাষী মানসিকতা একজন সফল মানুষকে ধীরে ধীরে একা করে দেয়, কীভাবে এই মানসিকতার কারণে পাশের সকল মানুষকে ধীরে ধীরে তার শত্রু মনে হয় এবং কীভাবে মানুষের চেয়ে আভিজাত্যের কোডগুলো বড় হয়ে দাঁড়ানোর পরে মানুষটি আভিজাত্যের মোড়কে বন্দী একটি রোবট হয়ে যায়। তিনি মানুষের সফলতাকে মাপছেন টাওয়ারের উচ্চতা দিয়ে, তিনি চাকরির ইন্টারভিউতে আসা ছেলেটির যোগ্যতাকে তাচ্ছিল্য করছেন তাঁর মর্জি ও ইচ্ছার গুরুত্ব যে ওই যোগ্যতার চেয়ে বড়, এমন বিনয় ওই ছেলেটির বাক্যের মধ্যে নেই বলে এবং তিনি নিজের ছেলের শিল্পবোধের যোগ্যতাকে অর্থহীন দেখছেন তাঁর ব্যবসা ও টাওয়ারের স্থায়ীত্বের সামনে। মনুষ্যত্ববোধকে গিলে ফেলেছে তাঁর দম্ভ ও আর্থিক দোর্দণ্ড সামর্থ্য। ওয়েটার হিসেবে আসা চাকরিপ্রার্থী ছেলেটির করুণ আর্তি এবং সৎ যোগ্যতার বিষয়গুলো তাঁর দম্ভ-আবৃত মস্তিষ্কে প্রবেশের পথ পায় না। ছেলেটিকে চড় দিয়ে তিনি যে মানবতাকে অপমানিত করেছেন, তা তাঁর মাথায় ঢোকে না, যদিও মন্ত্রীকে অপমানিত করেছেন এই শঙ্কা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। মানবের সপক্ষের সকল বোধ ও শক্তি আসলে তাঁর শত্রু হয়ে উঠেছে। ফলে শাহবাজ সাহেবের গল্পটি আরেকজন উইলি লোম্যানের (Willy Loman) গল্প, যেখানে উইলি লোম্যান রূপী শাহবাজ সাহেব ব্যবসায়িকভাবে সফল, সামাজিক প্রতিষ্ঠার চূড়ায় অধিষ্ঠিত কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হিসেবে প্রকৃতই Low Man; প্রকৃতই মানুষ হিসেবে তাঁর পতন হয়েছে, টাওয়ারের উচ্চতা যা আটকাতে পারেনি। 

এই গল্পের মধ্য দিয়ে কাজী আনিস আহমেদ শেষ করেছেন তাঁর ঢাকার জীবন নিয়ে লেখা গল্পগ্রন্থ ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার’। গ্রন্থটির সব গল্পেরই পটভূমি ও প্রতিবেশ ঢাকা। দু-একটি গল্পে কিছু এপিসোডের জন্য দেশের বাইরের পটভূমি ও প্রতিবেশ রয়েছে। প্রথম দুটি ও শেষ গল্পটি ছাড়া সব গল্পের কথক একজন উত্তম পুরুষ চরিত্র। এই তিনটি গল্পের কথক সর্বজ্ঞ তৃতীয় পুরুষ। অনিন্দ্য ও ‘বার্গার’ ছাড়া উত্তম পুরুষ কথক-চরিত্রগুলো লেখকের মতোই উচ্চশিক্ষিত ও সমাজের উঁচু তলার লোক হওয়ায় লেখক-কথক অভিন্নতার ঘোর পাঠকের মাঝে থেকে যায়। ‘রামকমলের উপহার’ ছাড়া সবকটি গল্প সম্পূর্ণ রিয়ালিস্টিক এবং ক্লোজ ন্যারেটিভ ধাঁচের। কিছু গল্পের গতিময়তা এসেছে ডায়ালগ টেকনিকে। আবার কিছু গল্প চলেছে ক্লোজ ন্যারেটিভের স্বভাবসিদ্ধ ধীরগতিতে। সাসপেন্স তৈরি না করে শুধু বর্ণনার ও কথকতার শক্তিতে গল্পগুলো আধুনিক গল্প হয়ে উঠেছে। প্রতিটি গল্পেই গল্প রয়েছে, যা ছোটগল্পের প্রাণ; সঙ্গে রয়েছে প্রয়োজনীয় সবটুকু নান্দনিকতা ও শৈল্পিকতা।   

লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশ সফরে জিম্বাবুয়ে দলে কিংবদন্তির ছেলে
বাংলাদেশ সফরে জিম্বাবুয়ে দলে কিংবদন্তির ছেলে
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে  ইসরায়েল?
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে ইসরায়েল?
রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্মরণ
রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্মরণ
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ