X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কিন নির্বাচন হাসির খোরাক জোগাচ্ছে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০১ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৫০আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৪৮

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী টিম ওয়েইনার পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া সাংবাদিক। তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ আমেরিকার বড় বড় পত্রিকায় দীর্ঘদিন সুনাম সুখ্যাতির সঙ্গে কাজ করেছেন। দীর্ঘ দশ বছর তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এস্টাবলিশমেন্ট রেকর্ড, সিআইএ’র আর্কাইভ, হোয়াইট হাউস এবং সিনেট ডিপার্টমেন্ট থেকে সংগ্রহ করা ৫০ হাজারেরও বেশি ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে সিআইএ’র ৬০ বছরের ইতিহাস নিয়ে ‘লিগেসি অব অ্যাশেজ’ নামে একটি মূল্যবান বই লিখেছেন। বইটিকে আমেরিকার রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে একটা ইতিহাসও বলা যায়।
ওয়েইনার তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘ইতিহাসে এমন কোনও প্রজাতন্ত্র নেই যেটা তিনশ’ বছরের বেশি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। সেই অর্থে এদেশও (আমেরিকা) আর বেশি দিন সুপার পাওয়ার থাকবে না, যদি সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই চারদিকের বিশ্বকে দেখার চোখ তার না গজায়।’ এই বইটি আমি মনোযোগসহকারে কয়েকবার পড়েছি। এবারের নির্বাচনি কর্মকাণ্ড দেখে আমেরিকান রাষ্ট্রের জন্মের আগের ফরাসি জ্যোতিষ বিজ্ঞানী নস্ট্রাডামুস-এর ভবিষ্যৎবাণীও পুনরায় পর্যালোচনা করেছি। সবকিছু দেখে আমার মনে হচ্ছে যে আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমেরিকার জন্য এক অশনী সংকেত বয়ে আনছে।

২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি একজন ব্যবসায়ী, জীবনে কখনও রাজনীতি করেননি। তবে তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল আজীবনের লালিত শখ। যে কারণে তিনি একবার দুই প্রধান দলের প্রার্থীর বাইরে তৃতীয় প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি প্রাইমারিতে রিপাবলিকান প্রার্থী হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পেয়ে প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হয়েছেন। 

২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হলেও তিনি ছিলেন নারী। আমেরিকায় কখনও নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচন করেনি। তার পরাজয়ের এটি একটি বড় কারণ। আমেরিকায় একটা কথা বলা হচ্ছে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টা নিয়ে শ্বেতাঙ্গরা আতঙ্কিত। আর ট্রাম্প ২০১৬ সালের নির্বাচনে এ বিষয়টা নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের আতঙ্ককে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। শ্বেতাঙ্গরা তাকেই ভোট দিয়েছিলেন। সে কারণেই হিলারি থেকে অনভিজ্ঞ, কম শিক্ষিত ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে এলোমেলো কথাবার্তা বলে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদটির ভাবমূর্তি ক্ষীণমান করে ফেলেছেন। আমেরিকার ইতিহাসে এমন কোনও প্রেসিডেন্ট আসেননি যাকে নিয়ে প্রতিরাতে বড় বড় টিভিশোতে ঠাট্টা মশকরা করা হয়। ক্লাউন হিসেবে দেখা হয়। 

‘লিগেসি অব অ্যাশেজ’ পড়ে মোটামুটি এ কথা অনুধাবন করতে পেরেছি যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সিআইএ’র পরামর্শ অনুসারে দেশ চালাতেন। তাই কোটি কোটি ডলার সিআইএ’র পেছনে খরচ করতেন। এখন আমেরিকার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। সিআইএ’র পেছনে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করাও এখন সম্ভব নয়। সুতরাং এখন প্রেসিডেন্ট মেধাসম্পন্ন না হলে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হবেন। আর প্রেসিডেন্টের ভুল সিদ্ধান্তে আমেরিকাকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। 

এরই মধ্যে দুর্ভোগের কাল আরম্ভ হয়ে গেছে। ১৯৪৫ সালে আইএমএফ যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আমেরিকার ডলারকে একমাত্র আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। সেই খাতে আমেরিকা একটা ভালো কমিশন পেয়ে থাকে। সেটা তার উল্লেখযোগ্য আয়। কোনও কোনও প্রেসিডেন্ট কারণে-অকারণে অবরোধ জারি করে সে আয়কেও হতাশাগ্রস্ত করে ফেলেছেন। অবরোধ জারি করা মানে তুমি আন্তর্জাতিক লেনদেনে আমার মুদ্রা ব্যবহার করতে পারবে না। রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান এই অবরোধে পড়ে বহুদিন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। রাশিয়াকে এতোদিন অবরোধের কারণে ভিক্ষা করে খেতে হতো, কিন্তু রাশিয়া ইউরোপের একমাত্র দেশ যে সমগ্র ইউরোপে তার গ্যাস ভান্ডার থেকে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। ইউরোপের দেশগুলোর প্রেসারে আমেরিকা গ্যাসের পেমেন্টের বিষয়ে অবরোধ অকার্যকর করে রেখেছে। আইএমএফ মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো এবং জাপানের ইয়েনের পাশাপাশি চীনের মুদ্রাকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে থেকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের মুদ্রা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাতে এক্ষেত্রে কঠোরতা কিছুটা শিথিল হচ্ছে।

২০২০ সালের ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাট দলের জো-বাইডেন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য এখন মুখোমুখি। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুবই হাড্ডাহাড্ডি হচ্ছে। বাইডেন এর আগে দু’বার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এবারও ট্রাম্প অনভিজ্ঞ এবং কম শিক্ষিত প্রতিদ্বন্দ্বী। তার অস্ত্র হচ্ছে বর্ণবাদকে উস্কে দিয়ে ফায়দা লোটা। তিনি সেই পথেই হাঁটছেন। ২৯ সেপ্টেম্বরের (বাংলাদেশ সময় ৩০ সেপ্টেম্বর) প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কেও হোয়াইট সুপ্রিমেসির নিন্দা না জানিয়ে এর পক্ষে কথা বলেছেন ট্রাম্প। বিতর্কে ট্রাম্প ভোট কারচুপির আশঙ্কা করেছেন এবং ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসানোর জন্য তার সমর্থকদের আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য বাইডেনও  অনুরূপ আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনি বিতর্ক দেখে মনে হচ্ছে এ যেন তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশের ভোটযুদ্ধ হচ্ছে।

৯০ মিনিটের বিতর্কের মধ্যে বেশ কয়েকবার দু’জনের মধ্যে বচসা হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশ্য ছিল বাইডেনকে বিব্রত করা, যা নিশ্চিত করতে তিনি ক্রমাগত বাইডেনের কথার মধ্যে তাকে বাধা দিয়েছেন। এর ফলে ট্রাম্প যেমন প্রশ্ন তুলেছেন বাইডেনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে, তেমনি বাইডেনও ট্রাম্পকে ‘ক্লাউন’ বলে কটাক্ষ করেছেন। মহামারি, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনীতি নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে বাইডেন তাকে ‘চুপ করে’ থাকতে বলেছেন (‘Shut up, man’)। সিবিএস নিউজ বলেছে—ট্রাম্প ৭৩ বার বাইডেনকে বক্তৃতায় বাধা দিয়েছেন। বিতর্কে বাইডেন নিয়েছেন ৪৩ মিনিট আর ট্রাম্প ৩৮ মিনিট। দীর্ঘতম বিতর্ক হয়েছে করোনাভাইরাস নিয়ে ২০ মিনিট।

সপ্তাহখানেক পর তারা আবার টিভি বিতর্কে নামবেন। মঙ্গলবার রাতের প্রথম বিতর্কে কে জয়ী হয়েছেন—এই বিশ্লেষণে মোটামুটি ভোট যাচ্ছে বাইডেনের দিকে। আক্রমণাত্মক বক্তৃতা দিয়ে কিছু দর্শকের কাছে তার নতি স্বীকার না করার ইমেজ ধরে রাখলেও আখেরে লাভ হয়েছে বাইডেনের। তিনি আমেরিকানদের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছেন যে চাপের মধ্যে থাকতে পারেন এবং ৭৭ বছরের বয়স্ক বাইডেন বয়স বাড়ার কারণে একটি পদক্ষেপও ভুল করতে পারেন না। তিনি নিজের মেজাজ ঠান্ডা রেখেছেন এবং ট্রাম্পের আক্রমণকে ‘পান্তাভাত’ (আমেরিকানরা পড়বেন ‘পাই’) হিসেবে নিয়েছেন।

এর আগে মাঠের বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি পরাজিত হলে হোয়াইট হাউস ছাড়বেন না। জো-বাইডেন বলেছেন পরিস্থিতি অনুরূপ হলে সামরিক বাহিনী দিয়ে তাকে উচ্ছেদ করা হবে। ট্রাম্প আবার বলেছেন ভোট গণনা করে ফলাফল দিতে হয়তো কয়েক মাস সময়ও লাগতে পারে। আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক রিপাবলিকান দলের লোক। জুনিয়র বুশকে জিতিয়ে দিয়ে, আল গোরকে পরাজিত ঘোষণা করছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। এবারও ভোটগণনা নিয়ে অনুরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া বিচিত্র নয়। শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচন বিশ্ববাসীকে হাসির খোরাক জোগাবে মনে হচ্ছে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

 [email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ