X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

এখনই স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার
০২ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৩৫আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২০, ১১:৩৬

ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার বিশ্বব্যাপী করোনা যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝেও সম্মুখ সারির সৈনিকদের সীমাহীন ত্যাগ কিংবা নিজেকে উৎসর্গীকৃত অবদানের কথা সাধারণ মানুষ কিন্তু ভুলে যায়নি। বরং ডাক্তার-নার্সসহ সকল যোদ্ধার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং সম্মান প্রদর্শনের জন্য বিভিন্নভাবে প্রতীকী অভিবাদন প্রকাশ করেছে– কেউ হাততালি দিয়ে, কেউ তৈজসপত্র দিয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে, কেউ বা বারান্দা থেকে রঙিন কাপড় উড়িয়ে। ঢাকাসহ পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহরেই সাধারণ মানুষ তা করেছে। উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হলো স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহ জোগানো এবং ভালোবাসা জানানো। তাঁদের এটা বলা যে আমরা তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, আমরা জানি তোমরা কীভাবে নিজের এবং পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও প্রতিদিন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছো, আমাদের পরিবারকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছো, মহান সৃষ্টিকর্তা তোমাদের সহায় হোন।

এখন দেখা যাক রাষ্ট্র বা সরকার এই করোনা যোদ্ধাদের জন্য যুদ্ধের রসদ কতটা সরবরাহ করেছেন! এই যে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা যুদ্ধযাত্রার অগ্রভাগে থেকে প্রতিদিনই করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন, অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন, হারাচ্ছেন আপনজনদের, মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন পরিবারের সদস্যদের। আবার সংক্রমিত রোগের কাছাকাছি থেকে কাজ করার কারণে অনেকেই সামাজিকভাবে নিগৃহীতও হচ্ছেন। সরকার বলতে গেলে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন তাঁদের যথাযথ সুরক্ষা দিতে। এখন পর্যন্ত সকল স্তরে পর্যাপ্ত এবং গুণগত মানের পিপিই সরবরাহ সুনিশ্চিত করা যায়নি। হাসপাতালগুলোতে আইপিসি (সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ)-এর কোনও নির্দিষ্ট প্রটোকল তৈরি হয়নি। পিপিই’র সঠিক ব্যবহার কিংবা রোগীদের (সন্দেহযুক্ত বা নিশ্চিত কোভিড-১৯ রোগী) নিরাপদ সেবা প্রদানের কোনও বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। কোভিড রোগীদের সেবা প্রদানরত ডাক্তার-নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টিনে থাকার কোনও সুব্যবস্থা নেই। এই বৈশ্বিক মহামারির সময়ে সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে করোনা যুদ্ধে নিয়োজিত সকল স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যবিমার কথা বলা হলেও সেটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি। এমনকি মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকি বা পরিশ্রমের জন্যও বিশেষ ভাতার কথা বলা হয়েছিল, সেটিও এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

অথচ, স্বাস্থ্য খাতের সকল অব্যবস্থাপনার দায়-দায়িত্ব আজ ডাক্তার-নার্সদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক নীতিনির্ধারকগণ কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে, ডাক্তার-নার্সদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে। কিন্তু এমনতর অবস্থা চলতে থাকলে বিশেষ করে মার্চের ৮  তারিখে প্রথমে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত ডাক্তার-নার্সদের ভেতরে যে আস্থাহীনতা এবং নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বাংলাদেশের ভগ্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে অতি দ্রুত আরও সংকটপূর্ণ অবস্থায় পতিত হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কাজেই এমন অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য প্রথমেই যা দরকার তা হলো ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। তাঁদের এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ তাদের পাশেই আছে। ডাক্তার-নার্সদের পেশাগত সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিধানের জন্য সীমিত সম্পদের মধ্যে যা কিছু করা সম্ভব, তা করতে রাষ্ট্র বদ্ধপরিকর। আজকের এই লেখায় আমি চারটি সুপারিশ অবশ্যকরণীয় হিসেবে সাধারণ পাঠক ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তুলে ধরতে চাই:

এক. স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা:

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সকল ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীদের (যেমন: ডাক্তার, নার্স, আয়া, ওয়ার্ডবয় এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী ইত্যাদি) নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে যা যা করণীয়- (ক) দ্রুততার সঙ্গে কোভিড সংক্রমণের সকল তথ্য এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের হালনাগাদ বিশদ বিবরণ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা; (খ) আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে প্রতিদিন সকালে হাসপাতালের সকল শ্রেণির কর্মীদের মধ্যে সর্বশেষ প্রাপ্ত জ্ঞানের সারসংক্ষেপ বিতরণ করা; (গ) প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে হাসপাতালের সাধারণ কর্মচারীদের নিয়মিত উৎসাহব্যঞ্জক কথোপকথন চর্চা করা, যা বিভিন্ন স্বাস্থ্যনীতি এবং প্রটোকলের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে অনেক সহায়ক ভূমিকা পালন করবে; এবং (ঘ) কোভিড-১৯ মনোনীত হাসপাতাল ছাড়াও অন্যান্য সকল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই সকল স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পিপিই সরবরাহ এবং সেগুলো ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, অন্যথায় পিপিইর অপ্রতুলতা কিংবা এর সঠিক ব্যবহার ও নিষ্কাশনের যথাযথ জ্ঞানের অভাবে যে স্বাস্থ্যকর্মী এবং সকল ধরনের রোগীদের সুরক্ষা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হতে পারে তার উদাহরণও ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি।

দুই. স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা:

কোভিড-১৯ মহামারি দেশের সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের অচিন্তনীয় অভিযোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বিধায় অতিরিক্ত কাজের পাশাপাশি শরীর ও মনকে বিপর্যস্ত করে তোলে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলছে। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এমন সব বিষয়েও সিদ্ধান্তও নিতে হচ্ছে। অতীতের চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যুর সাক্ষী হওয়া ছাড়াও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং পরিবারের কাউকে সংক্রমিত করছে কিনা সেই দুশ্চিন্তা ও মনোকষ্টে সময় কাটাতে হচ্ছে। যার এই অভিজ্ঞতা হয়নি তার জন্য এই মনোকষ্টের গভীরতা বোঝা দুঃসাধ্য। এছাড়াও সামাজিক কলঙ্ক এবং নিগ্রহের আতঙ্ক তো আছেই। তাই পেশাগত সহায়তা ছাড়াও সহকর্মী ও বন্ধুদের মাধ্যমে সামাজিক সহায়তা প্রদান স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল অটুট রাখতে সাহায্য করতে পারে। তাছাড়া কাজের জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কাউন্সিলিংয়ের বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। হাসপাতালের প্রধান প্রশাসক এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এই ধরনের বিশেষ কাউন্সিলিং সেশনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। এই ধরনের সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে এবং তা প্রতিটি হাসপাতালে বিতরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না রেখে কোনও ধরনের আন্তরিক সেবাই পাওয়া সম্ভব নয়। কোভিড-১৯-এর মতো মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে তো নয়ই।

তিন. নৈতিকতা ও সাম্যের প্রশ্নে কাজের সময়কে কঠোরভাবে নিরীক্ষণ করা:

কোভিড-১৯ সহ যেকোনও জরুরি অবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত সময় হাসপাতালে থাকতে হয়। তাছাড়াও কাজের নির্দিষ্ট কোনও সময় থাকে না। সবই নির্ভর করে রোগীদের চাপ এবং তাদের শারীরিক অবস্থার ভয়াবহতার ওপর। লম্বা সময় ধরে কাজ করা ছাড়াও স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিকভাবে ক্লান্তিকর সময় অতিবাহিত করতে হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ডাক্তার-নার্সসহ প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মীরই পরিবার-পরিজন আছে। পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের যাদের স্কুল বন্ধ তাদের কেউ মা অথবা কেউ বাবার জন্য অপেক্ষা করে। এই কনিষ্ঠ সদস্যদের দেখভাল করতে হয়। সুতরাং সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের সময় সঠিকভাবে নির্ধারণ করে দিতে হবে। অতিরিক্ত চাপ সামাল দেওয়ার জন্য সদ্য পাস করা ডাক্তার-নার্স এমনকি ছাত্রছাত্রীদের সাময়িকভাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে রোগীদের সেবায় কোনও বিরূপ প্রভাব না পড়ে। প্রতিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সাময়িক প্রয়োজন মেটানোর জন্য রাষ্ট্রীয় বিশেষ নির্দেশনা সাপেক্ষে এই ধরনের নমনীয়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা সময়ের দাবি।

চার. অধিক সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা:

প্রথমেই দেশব্যাপী সকল হাসপাতালের সার্বিক পরিস্থিতি যাচাই ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে, যার মাধ্যমে মহামারি সাপেক্ষে স্বাস্থ্যকর্মীর মোট চাহিদাকে পুনর্নির্ধারণ করা যাবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ প্রদানের পাশাপাশি কোভিড-১৯ সহ এই ধরনের সংক্রামক ব্যাধি কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে। ঢাকায় অবস্থিত কয়েকটি হাসপাতাল, যেমন: কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এই জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে দেশের সকল হাসপাতালে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় আইসিটি প্ল্যাটফর্ম এবং সুবিধা ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সেই জন্য ত্বরিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং যথাযথ অর্থায়ন প্রয়োজন। এ বছর জাতীয় বাজেটে কোভিড-১৯-এর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে এই বরাদ্দ থেকে স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের অর্থায়ন করা হবে একটি কার্যকরী সময়োচিত পদক্ষেপ।

কোভিড-১৯ জাতির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত কতটা অসহায়, কতটা দুর্বল এবং এখানে দুর্নীতির জাল কতটা বিস্তৃত। কিন্তু বাংলাদেশকে অবশ্যই অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং গণসম্পৃক্ততার মাধ্যমে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় প্রবাহ আসুক বা না আসুক, আমরা হয়তো রাজনৈতিক কিছু সুখময় তথ্য প্রদান করে আত্মতুষ্টি অনুভব করতে পারবো, কিন্তু আমাদের অসহায় জনগণকে ন্যূনতম এবং প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানেও সক্ষম থাকবো না!--

লেখক: স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা, বিশ্বব্যাংক



 
/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ