X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আমাদের বাঙালি সমাজ

কাজী মারুফুল আলম
০৬ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৪৪আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৪৫

কাজী মারুফুল আলম ঘোর লাগা অদ্ভুত এক সময়ে বাস আমাদের। খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের আশেপাশের পরিবেশ, সঙ্গে সঙ্গে চেনা মানুষগুলো। এতদিনের জেনে আসা সবকিছু মুহূর্তেই হয়ে উঠছে অচেনা। যে বিষয়গুলোকে এতদিন ঘুষ বলে জেনেছি তা কোথাও হয়ে উঠছে ‘স্পিড মানি’, কোথাও হয়ে উঠছে ‘তদবির খরচ’। ন্যায়-অন্যায় বোধের দোলাচলে এখন আমরা এতটাই দ্বিধান্বিত যে, আলো কোনটা আর অন্ধকার কোনটা তা বোঝা আমাদের জন্য কষ্টকর। এখন তো এমন অবস্থা যে অন্ধকারকেই আলো বলে ভুল হয়। সততার আলো এখন আমাদের চোখ ঝলসে দেয়, বাদুড় পেঁচার মতো রাতের অন্ধকার আমাদের জন্য বেশি আরামদায়ক। সততা এখন করোনায় আক্রান্ত, একটু নিঃশ্বাসের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে করছে।   
মানব জীবনের অদ্ভুত এক দিক হলো আমাদের প্রত্যেকের নীতি নৈতিকতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। শৈশব ও কৈশোরে আমরা যে আর্দশকে লালন করে বেড়ে উঠি, কঠিন বাস্তবতা প্রতিনিয়ত তার পরীক্ষা নেয়। এ যেন ভেঙে গড়ার এক অদ্ভুত খেলা। জীবনটাকে মাঝে মাঝে মনে হয় ‘চামুচে মার্বেল’ দৌড়ের প্রতিযোগিতার মতো। এখানে শুধু মার্বেলের পরিবর্তে চামুচে রয়েছে আমাদের সততা। খুব সাবধানে আমরা কেউ কেউ দৌড়াচ্ছি তারপরও একটু একটু করে আমাদের সততা চামুচের ফাঁক গলে পড়ে যাচ্ছে। যদিও এ বিষয়টি কেউ কেউ একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। আবার কেউ প্রতি মুহূর্তে নিজেকে হারাবার বেদনায় পুড়ছে।   

আমাদের শিক্ষাঙ্গন যা কিনা হওয়ার কথা ছিল  নৈতিকতা তৈরির কারখানা, তা নিজেই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকে শিক্ষক নিয়োগে দলবাজি আর ‘তেলবাজি’র কাছে মেধা ও মেরুদণ্ড পরাজিত। আর স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগে অর্থ অথবা তদবির ঠিক করে দিচ্ছে কারা আমাদের শিশুদের ন্যায়নীতির পাঠ পড়াবে। এ অবস্থায় যে শিক্ষকের নিয়োগই হচ্ছে অসততার মাধ্যমে, তার কাছে ছাত্র -ছাত্রীরা অন্যায়ের সামনে নতজানু হওয়া ছাড়া আর কী শিখতে পারে?  

আরও মজার বিষয় হচ্ছে যাদের কিনা হওয়ার কথা ছিল সততার ধ্রুবতারা, যারা কিনা সবাইকে দিক নির্দেশনা দেবে, তারাই আজকে সবচেয়ে বড় ভন্ড, প্রতারক, মুনাফিক। আর তাই শিক্ষকদের হাতে ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়, কিছু মসজিদ মন্দিরে আর গির্জায় মানব প্রেমের বদলে চাষ হয় সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের, আর রাজনীতির নামে চলে অর্থ সংগ্রহের মহা উৎসব। এ কারণে আমাদের তরুণ তরুণীরা বলিউড স্টারদের তাদের রোল মডেল বানিয়ে ফেলেছে আর টিকটক স্টার হয়ে সারা বিশ্বে দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে আত্মতুষ্টির ঢেঁকুর তুলছে। 

আমাদের পরিবার ছিল আগে প্রতিটি শিশুর নৈতিকতা শেখার সুতিকাগার কিন্তু সেখানে আমাদের শিশুরা এখন শিখছে শুধুই প্রতিযোগিতা। কীভাবে পাশের বাসার ভাবির ছেলেকে টপকে ছেলেকে প্রথম করা যাবে, কীভাবে কেন সামাজিক আলোচনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা যায় সেই প্রতিযোগিতায় বিভোর আমরা ভুলেও ভাবছি না যে- কীভাবে আমরা আমাদের নিজের মনুষ্যত্বকে বিক্রি করে তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্ব কিনে নিচ্ছি। আমরা অভিভাবকরা আমাদের শিশুদের শুধু দৌড়াতেই শেখাচ্ছি, কিন্তু হাত ধরে হাঁটতে শেখাচ্ছি না। আমাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করতে করতে আমাদের শিশুরা আজকে শুধু ছুটেই চলেছে, জীবনকে অনুধাবন করা বা উচ্চতর বিষয়ে চিন্তা করার অনাবিল আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত।

আগে সামাজিকভাবে বিয়ের ক্ষেত্রে খোঁজ নেওয়া হতো পাত্র যে আয় করে তা সাদা নাকি কালো? তার চরিত্র কেমন? আর এখন পাত্রী পক্ষ এটা জানতে পারলেই খুশি যে-পাত্র ‘সরকারি চাকরি’ করে। তার বাড়ি, গাড়ি আছে। মজার বিষয় হচ্ছে—সরকারি ৪/৫ বছর চাকরি করে কারও পক্ষে বাড়ি গাড়ি করা সম্ভব না জেনেও, পাত্রী পক্ষ জেনে বুঝে চুপ করে থাকেন। এমনও দেখা গেছে পাত্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে  বিভাগীয় তদন্ত চলছে, অথচ তারই বাড়ির সামনে পাত্রীপক্ষের লাইন রেললাইনের মতোই লম্বা হয়েই চলেছে। না পাত্রীর পরিবার, না পাত্রী নিজে এটি খোঁজ নিতে আগ্রহী যে তার হবু জীবন সঙ্গি কতটা সৎ!

তার মানে, একজন ব্যক্তি সৎ নাকি অসৎ তা আমাদের ব্যক্তি জীবনে আর কোনও প্রভাব বিস্তার করছে না। এমনকি নতুন প্রজন্মের মন ও মগজেও এ বিষয়টা কোনোভাবেই রেখাপাত করছে না। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য একটি অশনিসংকেত, কারণ এ থেকে বোঝা যায় আমাদের নতুন প্রজন্মের মন থেকে ন্যায় অন্যায় বোধ নষ্ট হয়ে তার জায়গায় জন্ম নিয়েছে ভোগবাদী মানসিকতা আর লালসা। 

একথা স্বীকার করতে অনেকে লজ্জা পাবেন, কিন্তু সহজ সত্য হচ্ছে আমাদের সমাজে এখনও গুটিকয়েক যে কয়জন মানুষ ‘ভালো মানুষ’ হওয়ার দাবি করেন বা সততার গৌরবে যাদের বক্ষ স্ফীত হয়ে ওঠে, তাদের বেশিরভাগই সাহস অথবা সুযোগের অভাবে তথাকথিত ‘ভালো মানুষ’। সুযোগ পেলে অথবা একটু সাহস কারও কাছ থেকে ধার করতে পারলেই এদের ভেতর লুকিয়ে থাকা নেকড়ে বাঘ হালুম করে বেরিয়ে আসবে। এ ধরনের সৎ মানুষ আরও বেশি বিপজ্জনক কারণ এরা লুকিয়ে থাকে আমাদের খুব কাছেই। কখনও বন্ধু, কখনও আত্মীয়, কখনও সমব্যথি বা কখনও সময়ের চাহিদা রূপে।   

জীবন আর বাস্তবতা এখন একটু একটু করে আমাদের আত্মাকে কলুষিত করে তুলছে। আমরা হয়ে উঠছি ‘করপোরেট দাস’। অর্থ আর স্বার্থ এখন ভালোবাসা বা বন্ধুত্বের চেয়ে দাড়িপাল্লায় অনেক ভারী। মাঝে মাঝে মনে হয় এই কলুষতাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাদের দেননি।   

মানুষকে মনুষ্যত্বের ট্রেনিং দেওয়া যায় কিনা, নাকি এটা একান্তই একটি গবেষণার বিষয়। একজন সিরিয়াল কিলারের ডিএনএ-তে কি প্রোথিত রয়েছে তার রক্ত পিপাসা? উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সে কি হয়ে উঠতে পারতো এক অনবদ্য মানুষ? যদি তাই হয়ে থাকে তবে সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষের মাঝে আমরা কেন অসম্ভব অসুন্দরকে খুঁজে পাই?            

মজার বিষয় হচ্ছে আমরা যতই নীতিহীন হইনা কেন, নিজেদের নীতিবান প্রমাণের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা ক্ষেত্র বিশেষে নোবেল পুরস্কারের দাবি রাখে। নিজেকে নীতিবান প্রমাণের সবচেয়ে সোজাপথ হচ্ছে ধর্মীয় লেবাস ধারণ। ধর্মের প্রতি আমাদের ভালোবাসাকে ব্যবহার করার জন্য আজকাল অনেক নেতারা দুর্নীতির পয়সায় ঘন ঘন হজে যান, সরকারি অফিসের ঘুষখোরদের মুখ থাকে দাড়ি আর টুপিতে ঢাকা। এভাবে হয়তো আমরা অন্য মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারছি, কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেদেরকে কী বলে ভুলিয়ে রাখবো?

নীতি নৈতিকতাকে যদি কোনও মানুষের রূপ দেওয়া যেতো তবে তাকে হয়তো আজকে গুম করে ফেলা হতো অথবা চিড়িয়াখানায় সাজিয়ে রাখা হতো। সৃষ্টির আদিম লগ্ন থেকেই নীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক। যুগে যুগে কালে কালে কখনও মানুষরূপী অবতার আবার কখনও নবী রাসুলরা এই হতভাগা মানব জাতিকে ন্যায় নীতির পথে আহ্বান করেছেন।

হতাশার এই কালো রাত্রিতে যখন হার মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক, তখন কিছু কিছু মানুষ তাদের অতি মানবীয় আচরণ দিয়ে আমাদের হতভম্ব করে দেয়। আমরা নিজেদের দীনতা আর হীনতায় তাদের সামনে দাঁড়াতেও লজ্জাবোধে আড়ষ্ট হয়ে উঠি। অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে যায় যখন দেখি—করোনার যে সময়ে পুত্র, কন্যা পিতা বা মাতার লাশ নিতে অস্বীকার করছে, তখন একদল পাগল ছুটে বেড়াচ্ছে মৃত্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অজানা অচেনা কোনও হতাভাগার লাশ দাফনের জন্য। এমনও মানুষ আছে যে বছরের পর বছর হাসপাতালে সেইসব মানুষের সেবা করে বেড়াচ্ছে যাদের মুখে পানি তুলে দেওয়ার কেউ নাই। এই কলিকালে এরাই যেন ঈশ্বরের অবতার। সৃষ্টিকর্তা হয়তো এদের মাধ্যমেই আমাদের সঙ্গে দেখা করে যান আর আমাদের মুখের সামনে একটা আয়না ধরেন যেখানে আমাদের কুৎসিত স্বার্থপর রূপটা ফুটে ওঠে। এদের দেখলে মনে হয় আশাহীন পৃথিবীতে এখনও আশা বেঁচে আছে। 

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক, স্টেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।  

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৎপর হওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৎপর হওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
বিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে দুদক
রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির অভিযোগবিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতি অনুসন্ধান করবে দুদক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ