X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে নতুন কী ভাবা যায়?

মাহমুদুল সুমন
১৯ অক্টোবর ২০২০, ১৭:১১আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২০, ১৭:১২

মাহমুদুল সুমন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোর ক্ষেত্রে নতুন নতুন বদল বা প্রকল্প চোখে পড়লেও শিক্ষা কার্যক্রম বা ওই সংক্রান্ত চিন্তা-তৎপরতার ক্ষেত্রে বদল খুব একটা দেখা যায় না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অন্ততপক্ষে তাই বলে। শিক্ষা কার্যক্রমে বদল বা অভিনবত্ব আনার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি নতুন চিন্তা থাকলেও সেটা গ্রহণ করার কেউ নেই। আমি এই লেখায় শিক্ষা কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলবো। দীর্ঘদিন ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছর শেষের লিখিত পরীক্ষাগুলোকেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি বা টুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে। বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই লিখিত পরীক্ষার ব্যবহার দেখা যায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনকি এমফিল/পিএইচডি পর্যায়েও লিখিত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে মূল্যায়ন করার চল আছে।

এভাবে কোর্স শেষে লিখিত পরীক্ষা নেওয়াকে শিক্ষা গবেষণায়  ‘সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট’ বলা হয়। বলাই বাহুল্য, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেটার ওপরই ভরটা বেশি। একটা গড়পরতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার জন্য ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত নম্বর বরাদ্দ দেখতে পাওয়া যায়। সারা বছরের কাজ ও শ্রেণিকক্ষের নানা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য বরাদ্দ খুব সামান্যই। মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এর ফলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা যারা বছরব্যাপী (সাধারণত ৮ থেকে ৯ মাস সময় পাওয়া যায় এসব কাজে) ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে চেষ্টা করি, আমরা প্রায়ই এই বাস্তবতার সম্মুখীন হই যে, নানা বিষয়ে ক্লাসে পড়াশোনার অগ্রগতি থাকলেও শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই (আমার অনুমান ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ) এসব কিছুর সঙ্গে খুব একটা সংযোগ না রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা কাটিয়ে দিতে পারে। সারা বছরের ক্লাসভিত্তিক কাজ পড়াশোনার জন্য নম্বরের বরাদ্দ সামান্য হওয়ায়, দায়সারা গোছের কিছু করলেও সার্বিক বিচারে রেজাল্টের ক্ষেত্রে তেমন হেরফের হয় না। শিক্ষার্থীদের মাঝে হয়তো এই বোধও কাজ করে যে, ৭০-৮০ শতাংশ অ্যাসেসমেন্ট তো রয়েছেই, বছর শেষে অর্থাৎ ফাইনালের আগে কাভার করে নেওয়া যাবে। বলাই বাহুল্য সেটা আর করা হয় না, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে সম্ভবও না। সারাবছরের কার্যক্রম যদি পরীক্ষার আগের ১৫ দিনেই করা সম্ভব হতো, তাহলে আর সারা বছর ক্লাস নেওয়া কেন?

এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, যে ধরনের প্রশ্নের ভিত্তিতে এই লিখিত পরীক্ষাগুলো নেওয়া হয় (এক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা অবশ্য সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন সাবজেক্ট ও প্রশ্নের ধরনের মাঝে সীমাবদ্ধ) সেখানেও শিক্ষার্থীদের একটা নির্দিষ্ট ধরনের দক্ষতারই মূল্যায়ন করা হয়। যেমন শিক্ষার্থী কিছু প্রস্তুতি নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর কেমন লিখতে পারে, কেমন যুক্তি সাজাতে পারে ইত্যাদি। তাত্ত্বিকভাবে বিষয়টা এমনই হবার কথা থাকলেও বাস্তবে এসব লিখিত পরীক্ষায়ও শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করবার প্রবণতাই বেশি দেখা যায়, যা দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা প্র্যাকটিসও বটে। এর কারণ হিসেবে আমি অবশ্য আমাদেরকেই দায়ী করি। প্রশ্নে নানা অভিনবত্ব নিয়ে আসলে হয়তো এই মুখস্থ করার প্র্যাকটিসটা গড়েই উঠতো না, গড়ে উঠতো না ‘বেশি লিখলে বেশি নম্বর’ পাবার ধারণাটিও।

জরুরি প্রশ্নটি হচ্ছে কেবল লিখিত পরীক্ষার মধ্য দিয়েই বা কেন আমরা মূল্যায়ন করে যাচ্ছি বছরের পর বছর? এটা তো আশাই করা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা নানা কাজের মধ্য দিয়ে বিকশিত হবে। নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর কিছু প্রশ্নের ভিত্তিতে কে কতটা কেমন লিখলো তা দিয়ে হয়তো একটা নির্দিষ্ট বছরে পরীক্ষার আগে আগে কে কেমন প্রস্তুতি নিয়েছে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। এ ধরনের সময় বেঁধে দেওয়া মূল্যায়ন ব্যবস্থায় অধিকাংশ সময়ই কোনও শিক্ষার্থী কোনও কিছু পাঠ করে বা দেখে বা অন্য কোনও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কতটা কী বুঝতে পারলো, বা নতুন পরিসরে কোন আলাপকে বা ধারণাকে কতটা চিহ্নিত করতে পারলো এবং এর মধ্য দিয়ে কতটা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারলো, তা স্পষ্ট হয় না। অথচ সারা বছরে নানা ধরনের মূল্যায়ন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যদি কোর্সগুলো পরিচালিত হয়, তবে এসবের অনেককিছুই অর্জন করা সম্ভব।

সারা বছর ধরে নানা ধরনের ও ওজনের মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি করার একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে এতে করে শিক্ষকদের ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট-এর ওপর জোর দেওয়া সম্ভব হয়। এই ধরনের ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা সারাবছরই ধারাবাহিক গ্রেডিংয়ের পাশাপাশি ফিডব্যাকের ভেতরে থাকতে পারে। শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের জানা বোঝার পরিসরকে বাড়ানো, নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করা এই পদ্ধতিতে সহজ হয়ে ওঠে। ক্লাসের নানা কার্যক্রমের ভেতরে শিক্ষক কোর্সের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে উপস্থাপনা, রচনা, রেসপন্স পেপার, গ্রন্থ পর্যালোচনা, ছোট ছোট গবেষণা প্রবন্ধ জমা নিয়ে (এভাবে বলতে একটু অস্বস্তিই লাগছে, এমনতো নয় যে এগুলো কেউ জানে না) এই অ্যাসেসমেন্টের ভাগীদার যেমন হবেন তেমন করে শিখবেন।

এই পদ্ধতিতে অবশ্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থী—উভয়পক্ষকেই সারা বছর মনোযোগী থেকে ক্লাসের কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে। এটা তখনই সম্ভব যখন শ্রেণিকক্ষের কাজ মূল্যায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত নম্বর বরাদ্দ থাকবে। সারা বছর ধরে নানা ফরমেটিভ এবং বছর শেষের অল্প ওজনের (৩০ শতাংশর মতো হতে পারে) প্রস্তুতিভিত্তিক লিখিত পরীক্ষার (সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট-এর অংশ হিসেবে) মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী যখন একটা কোর্স শেষ করবেন, তখন নিজের অজান্তেই এমন অনেক কিছুই শিখে ফেলবেন যা বিদ্যমান পদ্ধতিতে সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত শিডিউলের ভেতর রাখা গেলে সাধারণভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে যেমন অগ্রগতি দেখা দেবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশের উন্নতি ঘটবে বলেও মনে হয়। কেননা সময়মতো কাজ জমা না দিলে প্রস্তাবিত নতুন মূল্যায়ন ব্যবস্থায় মোটরবাইক নিয়ে টহলরত ও রাজনৈতিকভাবে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা টিকে থাকতে পারবে না। এসব শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে গিয়ে ভিসিসহ নানা দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদেরও আর বাড়তি কর্মঘণ্টা গুনতে হবে না। নিয়মিত না থাকতে পারলে একজন শিক্ষার্থী নিজ দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে নিতে পারবেন ওই শিক্ষাবর্ষে তার কী করণীয় ইত্যাদি।

অতিমারির এই সময়ে অ্যাসেসমেন্ট নিয়ে নতুন করে ভাবাটা আরও জরুরি মনে হলো। কেবলমাত্র বছর শেষের লিখিত পরীক্ষার ওপর নির্ভরতার কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আজকে সেশন জ্যামের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটু আউট অব বক্স ভাবতেই হবে। যেমন পৃথিবীর বেশিরভাগ আন্ডারগ্রেড ও গ্রেড স্কুলেকোর্স শিক্ষকই নির্দিষ্ট কিছু সূচকের ভিত্তিতে ঠিক করে দেয় শিক্ষার্থীদের গ্রেড কী হবে। অনেক ক্ষেত্রে  কোর্স শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে কাজটা শিক্ষকের সহযোগীরাই করে থাকেন। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ নম্বরের বছর শেষের পরীক্ষায় কোর্স শিক্ষক ছাড়াও দায়িত্ব পড়ে একজন দ্বিতীয় পরীক্ষকের ওপর যিনি হয়তো কোর্সের বিষয়বস্তু, এমনকি কী ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে কোর্স শিক্ষক মার্কিং করছেন তার কিছুই জানেন না (এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক ও সঙ্গতও বটে)। ফলে দ্বিতীয় পরীক্ষকের মূল্যায়ন অতটা সহজ নয় যতটা আমরা ধরে নিয়ে থাকি। বিশেষ করে সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাস্ত্রের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

গড় ও গোপনীয় নম্বরের আড়াল আমার কাছে বরং একটা বহুল ব্যবহৃত পুরনো অস্ত্র বলেই মনে হয়। দুই অচেনা শিক্ষকের গোপন নম্বরের গড় দিয়েই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে বহুবছর ধরে। গড়ের পক্ষে এভাবে যুক্তিও দেয় অনেকে যে শিক্ষকের ‘হাতে বেশি নম্বর থাকলে’ তিনি বায়াজড হয়ে যেতে পারেন। ভাবটা এমন যে শিক্ষকরা এখন তেমন বায়াজড না! আমার মনে হয় বস্তুনিষ্ঠতার ধারণা বা প্রযুক্তি নয় (দুই শিক্ষকের গড় নম্বরের ধারণা সেখান থেকেই উদ্ভূত বলে মনে করি), বরং স্বচ্ছতার ধারণা/প্রযুক্তি দিয়ে মূল্যায়ন কাঠামোকে সাজাতে হবে। এই পদ্ধতিতে শিক্ষক নিজ দায়িত্বে সারা বছরের কার্যক্রমের মূল্যায়ন ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির করবেন। ফিডব্যাকের সুযোগ তৈরি হওয়ায় এই প্রযুক্তিতে শিক্ষার্থীও নানা যোগাযোগের মধ্য দিয়ে জেনে যাবে কম গ্রেড পেলে কেন সে তা পাচ্ছে, বা যারা ভালো গ্রেড পাচ্ছে তারাই বা কেন পাচ্ছে। গ্রেড নিয়ে আপত্তি থাকলে একটা থার্ড পার্টি গ্রিভেন্স কমিটির কাছে যেতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয় পক্ষের দায়িত্ব এখানে বেড়ে যায়। সব নম্বর সবার সামনে উন্মুক্ত থাকায় এই পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী বুঝতে পারবেন কী ধরনের পারফরম্যান্স, লেখা বা কাজকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ভালো মূল্যায়ন করছেন এবং সে অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করে নিতে পারবে। গ্রেড ভালো না পেয়ে যদি সকল ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী গ্রিভেন্স কমিটিতে নাও যায়, তবুও ব্যক্তিগত পরিসরে অন্তত বলে বেড়াতে পারবে যে, ঐ শিক্ষক আমাকে ভালো গ্রেড দেয় না বা দেয়নি। মানে শিক্ষার্থীর ক্ষমতা একটু হলেও বাড়ে! বিদ্যমান পদ্ধতিতে সেই সুযোগও নেই। এ কারণেই মনে হয়, মূল্যায়নের প্রযুক্তি হিসেবে ট্রান্সপারেন্সির ধারণা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ক্ষমতা বিন্যাসে নতুন সম্ভাবনা দেখায়।

লেখক:  অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ