X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতির পরিবর্তন চাইলে দায়িত্ব আপনার

রুমিন ফারহানা
৩১ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৩৬আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০২০, ১৮:১৯

রুমিন ফারহানা নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের জেরে হাজী সেলিমের বাসায় ২৪ ঘণ্টার মাথায় অভিযান চালায় র‍্যাব। সেই অভিযানে উঠে আসে এক অত্যাশ্চর্য চিত্র। বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনামের ভাষায় ‘সাম্রাজ্য চালাতে’ বাসায় কন্ট্রোল রুম বসিয়েছিলেন তিনি। পুরান ঢাকা এলাকা ২৪ ঘণ্টা মনিটর করতে ‘হাজী সাহেবে’র বাসায় গড়ে তোলা হয়েছিল আধুনিক রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিসহ অত্যাধুনিক কন্ট্রোল রুম। কী নেই সেই রুমে? আধুনিক ভিপিএস (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার), ৩৮টি ওয়াকিটকি, ড্রোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস। রাষ্ট্রের ভিভিআইপি’দের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এলিট বাহিনীর কাছে যেসব সরঞ্জাম থাকে, সেসব সরঞ্জামও পাওয়া গেছে সেখানে। আছে বিদেশি অস্ত্র, হ্যান্ডকাফ আর মদ। এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ। রাস্তায় একটি দুর্ঘটনা আর তৎপরবর্তী এমপি পুত্রের বেধড়ক মারপিটের তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এই ভয়াবহ কাহিনি। সেই তদন্তও আবার হয়েছে এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে। এমপি পুত্রের উচ্ছৃঙ্খলতার শিকার ব্যক্তিটি যদি নৌবাহিনীর কর্মকর্তা না হয়ে দেশের সাধারণ কোনও নাগরিক হতেন তাহলে বিষয়টি নিঃসন্দেহে সেখানেই শেষ হতো। অন্তত অতীত উদাহরণ তাই বলে।   

একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হওয়া উচিত। হাজী সেলিম কোনও একক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনীতি এখন বহুলাংশেই মাফিয়া চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মেধাশূন্য কিন্তু অর্থ, পেশিশক্তি কেন্দ্রিক রাজনীতিতে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছুও নয়। একটা সময় পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটি রাজনীতিতে আসতো, বখে যাওয়া নষ্ট ছেলেটি নয়। রাজনীতিবিদদের প্রতি সম্মানটাও ছিল সমাজের সর্বস্তরে। ব্রিটিশ আমলে একজন রাজবন্দির পরিবার সরকার থেকে ভাতা পেতো। এমনকি ৮০’র দশক পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের সেই সম্মান কিছুটা হলেও ছিল। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হবার কারণে আমি নিজেই তার সাক্ষী। অবিভক্ত ভারত এবং পরবর্তী পাকিস্তান আমলে যারা রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন তাদের বেশিরভাগই এসেছেন অভিজাত এবং বিত্তশালী জমিদার পরিবার থেকে যাদের একটি অংশ রাজনীতি করতে এসে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন। নবাব, ভূস্বামী বা জমিদার, স্বনামধন্য আইনজীবী, যশস্বী ডাক্তার বা সাংবাদিকরাই রাজনীতি করে গেছেন।

একটা উদাহরণ বিষয়টিকে স্পষ্ট করবে। নওয়াব আলী চৌধুরী যিনি বঙ্গীয় গভর্নরের কাউন্সিল অব মিনিস্টার্সের কয়েক বারের মন্ত্রী ছিলেন এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলেন তিনি তার নিজস্ব জমিদারি বন্ধক রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সিংহভাগ অর্থ জোগান। যেহেতু কয়েক পুরুষের আভিজাত্য ছিল তাদের সঙ্গে তাই রাজনীতিতে কিছু ব্যতিক্রম বাদে তারা বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে কিছু দিতে পেরেছিলেন।

উপমহাদেশের আরেক কীংবদন্তি রাজনীতিবিদ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রেখে প্রথমেই চলে যান তার গ্রামের বাড়ি সন্তোষে। সেদিন সন্তোষে তার মাথা গুঁজবার ঠাঁইটুকু পর্যন্ত ছিল না। নিজের বসতবাটির উন্মুক্ত প্রাসাদে দাঁড়িয়ে সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি ‘তোমরা যেভাবে পার সাহায্য করো আমাকে, তিনখানা ছনের ঘর তৈরি করে দাও। আমি দালান কোঠায় থাকতে চাই না। কৃষক মজুরের ঘরেই থাকতে চাই।’ এই ছিল সেই সময়কার রাজনীতিবিদদের চিন্তাভাবনা।

রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করবার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তার জোগান দিতেন ব্যবসায়ীরা। তারা নিজেরা তখনও রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন নাই। কিন্তু পরবর্তীতে বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতির দখল ক্রমেই চলে যায় লুটেরা শ্রেণির স্বল্প শিক্ষিত নব্য ধনীদের হাতে। প্রান্তিক পর্যায় থেকে জাতীয় সংসদ সর্বত্রই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের। ধীরে ধীরে রাজনীতি পরিণত হয় বিনা পুঁজির সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায়। আইন প্রণয়ন, আইন সংশোধন এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের মূল ক্ষেত্র সংসদ দখল করে নেন এমন সব মানুষ যাদের অনেকেরই ন্যূনতম যোগ্যতা নেই এই বিষয়গুলোতে মতামত দেওয়ার। যে কারণে দেখা গেছে একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ৯ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে যেখানে ভারতের ১৭তম লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ। বাংলাদেশে উত্থাপনসহ প্রতি বিল পাস করতে যেখানে গড়ে ব্যয় হয় ৩২ মিনিট সেখানে ভারতের লোকসভায় ২০১৯ সালে প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লাগে গড়ে ১৮৬ মিনিট। প্রকৃতপক্ষে ঠিকাদার থেকে সাংসদ হয়ে ওঠা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। আবার অনেকেই সংসদে গেছেন সম্পূর্ণই ভিন্ন উদ্দেশ্যে এবং বলতে দ্বিধা নেই তাদের সংখ্যাই বেশি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে আইন প্রণয়ন, আইন সংশোধন কিংবা বিলের ওপর আলোচনায় খুব কম সংখ্যক সাংসদই অংশ নেন, অধিকাংশেরই সময় ব্যয় হয় দলীয় প্রধানের অপ্রাসঙ্গিক স্তুতি, স্মৃতিচারণ, মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাস চর্চা, কবিতা পাঠ আর সংগীত চর্চায়। যদিও সংসদের ১ মিনিট সময়ের মূল্য ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৮৬ টাকা।       

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নমিনেশন বোর্ডে প্রার্থীদের বলেছিলেন, ‘তোমরা যারা কম শিক্ষিত তোমরা ইউনিয়ন বোর্ড, জেলা বোর্ডের সদস্যপদে নির্বাচন করবে। তোমরা পার্লামেন্ট নির্বাচন করার জন্য এসে কেন ভিড় করছ? পার্লামেন্ট হচ্ছে আইনসভা। সেখানে দেশের জন্য আইন প্রণয়ন হবে। সেটা শিক্ষিত লোকের বিষয়। তোমরা অশিক্ষিতরা এখানে এসে ভিড় করছ কেন?’

এখন বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দূরেই থাকুক, এলাকায় চাঁদাবাজি, জমি দখল, ঠিকাদারি করে অর্থের মালিক বনে যাওয়া প্রায় সকলেই একটাই স্বপ্ন দেখে। কোন প্রকারে সংসদে কী করে যাওয়া যায়। ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিনাশ্রমে ৫০০০ কোটি টাকা বানানো কেবল রাজনীতিতেই সম্ভব। সেই সঙ্গে ক্ষমতা ভোগের আনন্দটা বোনাস।  

বর্তমান সরকার রাজসিক, সন্দেহ নাই। এখানে দুর্নীতি বা লুট কোনোটাই হাজার কোটি টাকার নিচে না। এই যেমন কিছুদিন আগেই ক্যাসিনো কাণ্ড এবং তৎপরবর্তী ঘটনা উন্মোচিত করেছে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত অঙ্গ সংগঠনের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মী কত সহজে হাজার কোটি টাকার মালিক বনতে পারে সেই চিত্র।

প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করলে জনগণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে আর গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন ও দলীয় নেতাকর্মী। আর তাই তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। সে কারণেই এমন কিছু ব্যক্তি মনোনয়ন পাওয়ার সুযোগ পায় যাদের অনেকের নাম পরিবার পরিজনসহ দখল, টেন্ডারবাজি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, টিআর-কাবিখা প্রকল্পে লুটপাট, চোরাচালান থেকে শুরু করে ইয়াবা ব্যবসা সহ নানান অপরাধের সঙ্গে যুক্ত।

রাজনীতিতে বেশ দীর্ঘ সময় একটা বিশাল প্রজন্ম ‘I hate politics’ বলে দায় এড়িয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই সেই জায়গার দখল চলে গেছে এমন সব মানুষের হাতে যাদের রাজনীতিতে আসার কোনও কারণই ছিল না। অথচ রাজনীতি সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক, নিয়ামক এবং কেন্দ্রবিন্দু। শুদ্ধ রাজনীতির চর্চা ছাড়া না সুস্থ সমাজ গঠন সম্ভব, না সম্ভব রাষ্ট্র বিনির্মাণ। সুতরাং সকল কিছুর আগে রাজনীতির পরিবর্তন জরুরি। সেই পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে কেবল মাত্র রাজনীতিবিদেরাই। কিন্তু রাজনীতি যদি থেকে যায় কালো টাকা আর পেশিশক্তির হাতে তাহলে সেই পরিবর্তনের আশা দুরাশা মাত্র। যোগ্য ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থেই যদি না এগিয়ে আসেন তাহলে এই অবস্থার পরিবর্তন কিছুতেই সম্ভব না। পলিটিক্সকে দূর থেকে ‘হেইট’ করে দায় এড়ানো সহজ কিন্তু এর ভেতরে ঢুকে এর পরিবর্তন সাধন কঠিন। পরিবর্তন চাইলে সেই কঠিন কাজটিই করতে হবে আপনাকে, না হলে এর অধঃপাত ঠেকায় সাধ্য কার?   

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ