X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনিশ্চয়তায় আশঙ্কায় আমেরিকা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৬ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০২আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৩৬
বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে কিন্তু এখনও চলছে ভোট গণনা। আমি যখন এটি লিখছি তখন পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটিক দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন পেয়েছেন ২৬৪ ইলেকটোরাল ভোট আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পেয়েছেন ২১৪ ভোট। ইলেকটোরাল ভোট, পপুলার ভোট দুটিতেই এগিয়ে বাইডেন। চূড়ান্ত ফলাফল এখন নির্ভর করছে তিনটি রাজ্যের ওপর– জর্জিয়া, নেভাদা ও পেনসিলভেনিয়া। এই তিন রাজ্যে দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান এত হাড্ডাহাড্ডি যে, এক শতাংশেরও কম, দশমিকে সীমাবদ্ধ। ট্রাম্পকে জিততে হলে এই তিন রাজের‌্য সব ভোট পেতে হবে। আর এক নেভাদার ৬ ইলেকটোরাল ভোট পেলেই জো বাইডেন বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হবেন।

এমন হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচন আমেরিকা এর আগে দেখেনি, আমেরিকান সমাজের এমন শক্ত বিভক্তি বিশ্ব আগে দেখেনি। জো বাইডেন দ্বিতীয়বারের মতো সমর্থকদের শেষ ভোট গণনা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন আর ট্রাম্প দ্বিতীয় দফা ভোট কারচুরি অভিযোগ এনে ভোট গণনা বন্ধ করতে বলেছেন। ট্রাম্পের নির্বাচনি দল এরইমধ্যে পেনসিলভেনিয়া, উইসকনসিন, জর্জিয়া ও মিশিগানে ভোট গণনা বন্ধ করার জন্য মামলা দায়ের করেছে। তবে মিশিগান রাজ্যে ভোট গণনা স্থগিত চেয়ে ট্রাম্প প্রচার দলের এক মামলা খারিজ করে দিয়েছেন বিচারক। তিনি বলেছেন, মামলায় ভুল কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়েছে।

ট্রাম্পের নির্বাচনি দল তাদের মামলা চালানোর খরচ তোলার জন্য প্রচারকার্য চালাচ্ছে। তাদের আবেদন, নির্বাচনের ফল যাতে ‘চুরি’ করতে না পারে সেজন্য ‘বামপন্থীদের’ ঠেকিয়ে দিন। লক্ষ লক্ষ ডলার চাঁদা পাচ্ছেও তারা। একদিনেই ৮০ লক্ষ ডলার চাঁদা তুলেছেন বলে সিবিএসকে জানিয়েছেন ‘ট্রাম্প ভিক্টরি’ নামের একটি গ্রুপের অর্থ বিষয়ক চেয়ারম্যান।

এসব ঘটনাবলি প্রমাণ দিচ্ছে ট্রাম্প এতদিন ভোটের আগে যেসব কথা বলেছিলেন সেসব কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। মনে হচ্ছে যে তার কারণে নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ ভোটের ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করতে পারবে না। অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভোট-উত্তর পরিস্থিতি এগিয়ে যাচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বড় বড় শহরে উভয় পক্ষ বিক্ষোভ করছে। যদিও বা নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনী ময়দানে রয়েছে, তবে উভয় পক্ষের মাঝে সংঘাত শুরু হলে তা সামাল দেওয়া মুশকিল হবে।

দৃশ্যত ট্রাম্প হার মানতে নারাজ বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। অনুরূপ পরিস্থিতিতে দেশে শান্তি বজায় রাখা কঠিন হবে। ট্রাম্প আগেই বলেছেন ফলাফলের বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়াবে। এখনও বলছেন। মেইল-ইন ব্যালটকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প বারবার দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ তুললেও তার দাবির সপক্ষে কোনও প্রমাণ দিতে পারেননি। ট্রাম্প মন্তব্য করেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয় বিচারকদেরই ফলাফল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিতে হবে।’ দেখা যাচ্ছে দ্রুত পরিস্থিতি সেদিকে মোড় নিচ্ছে এবং জুনিয়র বুশ ও আল-গোরের নির্বাচনের সময় যেভাবে জুনিয়র বুশ সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, ট্রাম্পও অনুরূপ একটা সুযোগ গ্রহণ করে সর্বোচ্চ আদালত থেকে একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রত্যাশা করছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা নিরপেক্ষ নয়। দলীয় লোকজনকে বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করার প্রথা চালু রয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতিদের মাঝে রিপাবলিকান সমর্থক জজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই প্রথা আমেরিকার স্থপতিদের সময়ও ছিল। দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন এডামসের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগের রাতে তিনি তার নিজস্ব ১০ জন লোককে জজ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। মধ্যরাতে তাদের নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। তাই তাদের ‘মিড নাইট জাজেস অফ এডামস’ বলা হতো। তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনকে তার কার্যকালে পদে পদে আটকানোর জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে তাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন এডামস।

নির্বাচনের কয়দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও হাইকোর্টে একজন রিপাবলিকান সমর্থক মহিলাকে জজ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এতে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে। বিদ্যমান ব্যবস্থার মাঝে নতুন জজ নিয়োগ দেওয়া অনৈতিক কাজ এই কথা ডেমোক্র্যাটরা বললেও ট্রাম্প তা শুনেননি। উক্ত মহিলাকে জজ হিসাবে শপথবাক্য পাঠ করানো থেকে তিনি বিরত থাকেননি। তবে সুপ্রিম কোর্ট দিয়ে ট্রাম্প বিজয়ী হতে পারবে এটা আমার বিশ্বাস হয় না। ট্রাম্প চেষ্টা করতে পারেন, তবে আদালত নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

ট্রাম্প নির্বাচনে কারচুপি, অনিয়মের অভিযোগ এনেছেন তবে উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত ছাড়া। আমেরিকার নির্বাচনে যে কারচুপি হয় না তাও নয়। হিলারি ক্লিনটনের জীবনী গ্রন্থ ‘হোয়াট হ্যাপেন’ পড়লে দেখা যায় কীভাবে কারচুপি হয়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এই বইতে হিলারি ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া ট্রাম্পকে জেতানোর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিল বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কিন্তু এবার যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের সাইবার বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার ক্রেবস এক বিবৃতিতে বলেছেন যে ভোট গণনায় কোনও বিদেশি পক্ষ হস্তক্ষেপ করেছে, এমন কোনও প্রমাণ সরকারের কাছে নেই।

মিডিয়া এবং নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত যে প্রজেকশন করছে তাতে ট্রাম্প কোনও কেরামতি না দেখাতে পারলে বাইডেন জিতবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি দাবি করতে পারবেন যে জাতির শাসন পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী আদেশ পেয়েছেন। তবে তিনি আসলে শাসন করতে সক্ষম হবেন কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যে সিনেট চরমপন্থী রিপাবলিকানদের হাতে থাকছে। যতটা করতে পারে তারা বাইডেনকে বিধ্বস্ত করে তুলবে আগামী চার বছর। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান এত কম হওয়ায় বুঝা যাচ্ছে গত চার বছরে বর্ণবাদী ব্যবস্থা পুনর্জীবিত হয়েছে। ট্রাম্প বিশ্বাস করেন শ্বেতাঙ্গরাই আমেরিকান আর অশ্বেতাঙ্গরা অভিবাসী। তিনি শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের পক্ষে। ট্রাম্প বর্ণবাদে এমন বাতাস দিয়েছেন যে গত চার বছরে অসংখ্য আকাম করার পরও তিনি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আসতে পেরেছেন। সুতরাং পরিস্থিতি এখন এমন যে নেতৃবৃন্দ একটুখানি অসতর্ক হলেই গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে।

আরেকটি কথা বলতে হয় যে, ট্রাম্প এবার নির্বাচনি লড়াই করলেন অসম পরিস্থিতিতে। একদিকে তিনি নিজে আর অন্যদিকে আমেরিকার পুরা সুশীল সমাজ। এক ফক্স নিউজ ছাড়া আগাগোড়া মিডিয়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আছে। আমি তো মনে করেছিলাম এবারের নির্বাচনকে ‘মিডিয়া ক্যু’ বলবো। কিন্তু এখনও বলার সুযোগ পাচ্ছি না চূড়ান্ত ফলাফল আসা পর্যন্ত। বর্ণবাদের বিষবাষ্প মিডিয়া ক্যু বলা থেকে শেষ পর্যন্ত আটকিয়ে দিলো। এখন আকাশ পরিষ্কার হতে সময় নেবে। সমগ্র বিশ্ব কামনা করে যুক্তরাষ্ট্রের অ-বর্ণবাদী ব্যবস্থা ফিরে আসবে।





লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
 
 
 
/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ