X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’দের জন্ম, বেড়ে ওঠা আর মৃত্যু

ডা. জাহেদ উর রহমান
১২ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০৪আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০৭

ডা. জাহেদ উর রহমান ‘ট্রাম্পইজম’ একটা পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ। রাজনীতিতে এসে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট (ট্রাম্প যা যা করেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পথে যা যা করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যা যা করেছেন সবকিছু মিলিয়েই ‘ট্রাম্পইজম’। এই প্যাকেজের মধ্যে নীতিগত বিষয় যেমন আছে, তেমনি আছে তার চিন্তা এবং আচরণগত ব্যাপারও। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প যা যা করেছেন সেটা আমেরিকার ইতিহাসেই অনেকক্ষেত্রেই এক্সক্লুসিভ ব্যাপার। তার মতো বহু কাজ, আচরণ করেননি পূর্বের কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু অনেকে যেমন মনে করছেন ট্রাম্প যে রাজনীতিটা করেছেন  সেটা নতুন, এটা ভুল ধারণা। এটা নতুন নয় মোটেও। এই লেখাটা সেই রাজনীতি নিয়েই।
এই লেখা যখন লিখতে শুরু করেছি তখনই সংবাদমাধ্যমে খবর বিশ্লেষণ করে বলা যায় ট্রাম্প উদ্ভট ধরনের কোনও জটিলতা তৈরি করতে সফল না হলে তিনি আর প্রেসিডেন্ট থাকছেন না। হ্যাঁ, ট্রাম্প পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু এই প্রশ্ন অনেকেই করছেন, তিনি কি আসলেই পরাজিত হয়েছেন? তার রাজনীতি আসলেই কি পরাজিত হয়েছে?

দেশ-বিদেশের অনেক বিশ্লেষক যুক্তি-তথ্য দিয়ে বলতে চাইছেন ট্রাম্পের রাজনীতি পরাজিত তো হয়ইনি বরং সেটা অনাগত দিনে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখা যাবে। এই ব্যাপারে আমার দ্বিমত আছে। সেটা নিয়ে আলোচনার আগে ট্রাম্প যে রাজনীতিটা করছেন, সেটা নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক। 

জাপানি বংশোদ্ভূত (জানি, এই বিশেষণ তিনি ভীষণ অপছন্দ করবেন) ইয়োশিহিরো ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার বিখ্যাত বই ‘The End of History and the Last Man’। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে বড় ধরনের ভ্রান্তি আছে বইটি সম্পর্কে ভাসা ভাসা জানা অনেকের মনে। অনেকে মনে করেন ফুকুয়ামা বলছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর লিবারেল ডেমোক্রেসি একমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে টিকে থাকবে এবং এখানেই ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটবে। এই ধারণাটা একেবারেই ভুল।

এটা ঠিক, ফুকুয়ামা মনে করেন, বিশ্বাস করেন লিবারেল ডেমোক্রেসিই মানুষের জন্য সবচেয়ে আদর্শ শাসনব্যবস্থা; মানুষকে এটাতেই শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হবে। কিন্তু তিনি এটাও খুব জোর দিয়ে বলেছেন নানা সময়ে এই শাসনব্যবস্থা থেকে অনেক রাষ্ট্রের স্খলন হবে, কিন্তু সেখানেই পরবর্তীতে আবার ফিরে আসতে হবে। গত প্রায় এক দশক ধরে উদার গণতন্ত্রের স্খলনের জন্য প্রধানত দায়ী আইডেন্টি পলিটিক্স (পরিচয়বাদী রাজনীতি)। ২০১৮ সালে প্রকাশিত তার বই ‘Identity: The Demand for Dignity and the Politics of Resentment’-এ ফুকুয়ামা দেখিয়েছেন কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রাজনীতিতে আইডেন্টি পলিটিক্স মাথাচাড়া দিচ্ছে এবং তার প্রভাবে উদার গণতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে। 

ফুকুয়ামা এটা মেনে নেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তার বিভিন্ন রকম পরিচয়ের ভিত্তিতে আত্মমর্যাদাবোধ কাজ করে। ধর্ম-বর্ণ-অর্থনৈতিক শ্রেণি-জাতিগোষ্ঠী-লিঙ্গ-যৌন আচরণ এসব কিছুর ভিত্তিতেই পৃথিবীর সব মানুষেরই কোনও না কোনও রকম পরিচয় থাকে। অনেকেই সেটাকে খুব শক্তভাবে ধারণ‌ও করেন। সেই কারণেই তারা চান তাদের এই পরিচয়ের স্বীকৃতি সমাজ বা রাষ্ট্র তাকে দিক। একটা রাষ্ট্রে তার অবস্থান সংখ্যাগত বা প্রভাবের দিক থেকে যতই ছোট হোক না কেন, সে তার সেই মর্যাদা সবার কাছে চায়। সেটা যখন সে পায় না তখনই তার মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ কাজ করে। হাল আমলের পরিচয়বাদী রাজনীতিবিদগণ সেই অসন্তোষকেই পুঁজি করেন, সেটাকে উসকে দেন। 

এটা খুবই সত্যি কথা গত এক দশকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচয়বাদী রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত চলছে। অনুন্নত কিংবা কম উন্নত দেশগুলোতে যেমন ভারতে এই রাজনীতি শক্তিশালী হবার এমনকি ক্ষমতায় চলে যাবার পেছনে এক ধরনের ব্যাখ্যা খুব সহজেই দেওয়া যায়। আমরা খুব সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি এটা বলে যে সেসব দেশে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ শিক্ষা নেই, পরিবারে-সমাজে গণতান্ত্রিক চেতনা শক্তিশালী নয় ইত্যাদি।

কিন্তু যখন দেখা যায় এই প্রবণতা সেসব দেশকে ছাপিয়ে উদার গণতন্ত্রের সূতিকাগার, অতি উন্নত দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে তখন সেটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা জরুরি। ব্রিটেনের নাইজেল ফারাজ কিংবা ফ্রান্সের মেরিন লা পেন এর উত্থান এবং রাজনীতিতে ভীষণ শক্তিশালী হয়ে ওঠা বেশ আগে থেকেই আমাদের এই সতর্কবার্তা দিচ্ছিল।  

পরিচয়বাদী রাজনীতির একটা খুব বড় সংকট আছে। এই রাজনীতি রাজনীতির মাঠে থাকা সব শক্তিকে নতুন ধরনের পন্থা গ্রহণ করতে একরকম বাধ্য করে। কোনও একটা রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি যদি সমাজে পরিচয়বাদী রাজনীতিকে উসকে দেয় তাহলে সেই দেশে থাকা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোরও সেই পথে হাঁটার প্রবণতা দেখা দেয়। তখন কেউ হয়তো কট্টর আর কেউবা নরম পরিচবাদী রাজনীতি করতে শুরু করে। 

এটা এক বিপজ্জনক খেলা। যখন কোনও রাষ্ট্রে পরিচয়বাদী রাজনীতির মূল প্রবক্তা দেখে অন্য দলটিও কিছুটা হলেও সেই রাজনীতিতে সাড়া দিচ্ছে তখন তার মাথায় কাজ করে অপরের সঙ্গে তো তার পার্থক্য কমে গেলো। তখন তার রাজনীতি আরও বেশি কট্টর হয়ে ওঠে। সেই কঠোর অবস্থানের সঙ্গে পাল্লা দিতে অন্যান্য দল তাদের রাজনীতিও আগের তুলনায় কট্টর করে তোলে। এরপর আবার অন্য দলটি–এ এক ভয়ঙ্কর খেলা।

খুব সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় এর খুব অসাধারণ প্রমাণ পাওয়া গেলো। ফ্রান্সে মহানবীর কার্টুন দেখিয়ে ধর্ম অবমাননাকারী অভিযোগে একজন শিক্ষককে যখন হত্যা করা হলো তখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যে ধরনের আচরণ করেছেন, যে মন্তব্য করেছেন সেটা আসলে ঠিক তার সঙ্গে যায় না। কিন্তু ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে খেয়াল করলে এটা এক ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। গত বেশ কয়েক বছর থেকেই ফ্রান্সে কট্টরপন্থী পরিচয়বাহী রাজনীতিবিদ মেরিন লা পেন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। একজন খ্রিস্টান শিক্ষকের মুসলিম জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারানোকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু করে তুলতেই পারেন। ম্যাক্রোঁ তাকে সেই সুযোগ না দেওয়ার জন্য নিজেই সেই রকম আচরণ করেছেন। বিশেষ করে সেটা এমন একটা সময় যখন পরবর্তী নির্বাচনের বাকি আর মাত্র দেড় বছর এবং ম্যাক্রোঁর জনপ্রিয়তা তলানির দিকে। 

কোনও দেশের রাজনীতিতে প্রান্তের মতো মানুষ কেন আসে প্রভাব বিস্তার করে এবং টিকে থাকে সেটা ফ্রান্সের এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়। একজন রাজনৈতিক নেতা যখন চরম রকম পরিচয়বাদী রাজনীতি করেন তখন সেই সমাজে থাকা উদারপন্থী নেতাদের কোনোভাবেই উচিত না সেটা কে প্রশ্রয় দেওয়া। বরং তাদের উচিত সে তার বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়ানো। কিন্তু সামনের নির্বাচনটিকে মূল লক্ষ্য করে অনেক ক্ষেত্রেই উদারপন্থী রাজনীতিবিদরা সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন না। এতে ভোটের মাঠে খারাপ ফলাফল করার ভীতি পেয়ে বসে তাদের।

এই প্রবণতার চমৎকার বিকল্প এখন আবার তৈরি হচ্ছে। এই বছরের শুরুতে ভারতের দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচণ্ড পরিচয়বাদী রাজনীতির মুখে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সেই ফাঁদে পা দেননি। বরং আগেরবার ক্ষমতায় থেকে তিনি দিল্লিবাসীর জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছেন, এবং ভবিষ্যতে কী করতে যাচ্ছেন, সেসব বলে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন। প্রবল পরাক্রমশালী বিজেপিকে শোচনীয়ভাবে হারিয়ে তিনি জয়ী হয়েছেন। এটা পরিচয়বাদী রাজনীতির বিপক্ষে একটা বড় বিজয় হিসেবে পৃথিবীর সামনে উদাহরণ তৈরি করেছে। ‌

এদিকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে খুব উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পপুলার ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন বাইডেন। এটাও ঠিক ট্রাম্প খুব বড় সংখ্যক ভোট পেয়েছেন। গত নির্বাচনেও ট্রাম্পের বিষয়টি আমরা যারা খুব বড় করে দেখানোর চেষ্টা করি, তাদের মনে রাখা উচিত মার্কিন নির্বাচনের জটিল পদ্ধতি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ এর কারণেই তিনি গতবার জিতেছিলেন। সেই নির্বাচনেও ট্রাম্প হিলারির চাইতে ৩০ লক্ষ পপুলার ভোট কম পেয়েছিলেন। 

বাইডেনকে ধন্যবাদ তিনি ট্রাম্পের গতবারের বিজয়ের পরেও অন্য অনেক উদার গণতান্ত্রিক নেতার মতো ভুল করেননি। তিনি নিজেও কোনও নরম ধরনের পরিচয়বাদী রাজনীতির পথ মাড়াননি। তিনি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এবং সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয় নিয়ে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন। নির্বাচনি প্রচারণার সময় এবং নির্বাচনে জেতার পর তিনি পরিচয়বাদী রাজনীতিবিদদের উল্টোপথে গিয়ে বিভেদ নয়, পুরো আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি তিনি সেই চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির আদর্শ সমুন্নত রাখার প্রত্যয় নির্বাচনে জেতা এবং ৪ বছরের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিতভাবেই ট্রাম্প যে মানুষদের ক্ষোভকে পুঁজি করে উসকে দিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছিলেন তাদের অনেককে আশ্বস্ত করবে। সেই কারণে আমি বিশ্বাস করি আগামী মার্কিন নির্বাচনের ট্রাম্প নিজে প্রার্থী হন অথবা আর কেউ তার মতো রাজনীতি করে ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করুক সেটা সফল হবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই নির্বাচনের পরাজয়‌ই হবে ট্রাম্পইজমের শেষের শুরু।

উদার গণতন্ত্র শুধু একটি সরকার ব্যবস্থা না, এটি একটি আদর্শ, দর্শনও। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদার গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে এই মূল্যবোধের চর্চা হওয়া উচিত মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়ে। উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখা উচিত উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমাজে প্রতিষ্ঠিত রাখা একটা নিরন্তর সংগ্রামের ব্যাপার। সেই সংগ্রাম নিশ্চিত করা গেলেই ট্রাম্প, লা পেন, কিংবা নাইজেল ফারাজদের মৃত্যু নিশ্চিত করবে এবং পুনর্জন্ম প্রতিরোধ করবে।

 

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট



/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ