X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ওরা সংখ্যালঘু নয় ভূমিপুত্র

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
১৪ নভেম্বর ২০২০, ১৩:০৯আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২০, ১৩:১০

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার বাংলাদেশে কারা সংখ্যালঘু সেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কাউকে সংখ্যাগুরু আর কাউকে সংখ্যালঘু বলে অভিহিত করাটা অন্তত আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ বাঙালি এটাই বড় পরিচয়। কে কোন ধর্মের অনুসারী এই বিষয়ের বিবেচনা সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে না। আজ যারা নিজেদের মুসলিম দাবি করে বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনুসারীকে সংখ্যালঘু বলতে চান- তারা হয় চোখ থাকতে অন্ধ; না হয় এ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণা নেই। এমনকি তাদের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও খুব জ্ঞান আছে এমনটিও মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দাবিকারী অনেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সংখ্যালঘু বলে অভিহিত করছেন অহরহ। তারা কতটুকু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বোঝেন বা লালন করেন সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই উচ্চারিত হয়েছে: বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ আমরা সবাই বাঙালি। যদি সবাই বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত হই, তাহলে কীভাবে বাঙালিদের একটি অংশ আবার সংখ্যালঘু হয়?

ইসলাম ধর্মের অনুশাসনে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর ধারণা অচল। সেখানে ধর্মের বিবেচনায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিধান পালনের ক্ষেত্রে মুসলিমদের সঙ্গে অমুসলিমদের ন্যায্য পার্থক্য আছে ঠিকই। তবে ওই ধর্মের বিধানে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই কাউকে সংখ্যালঘু আর কাউকে সংখ্যাগুরু অভিহিত করা হয়নি। বরং হজরত মোহাম্মদ (সা.) যে মদিনাকেন্দ্রিক উম্মাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন; ওই সমাজ ব্যবস্থায় অমুসলিমদেরও মুসলিমদের পাশাপাশি বসবাসের সমান অধিকার ছিল। মদিনা সনদের ১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে: ‘অন্যদের মোকাবিলায় তারা এক উম্মা (মুসলিম-অমুসলিম সবাই এর অন্তর্ভুক্ত) বলে গণ্য হবে’ এবং ৪৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে: ‘আর ইয়াছরিব (মদিনা) উপত্যকা এই চুক্তিনামার সব পক্ষের কাছে পবিত্র ভূমি বলে গণ্য হবে।’ মদিনাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠিত উম্মা ব্যবস্থার প্রাণ ওই সনদের ৫৩টি ধারার কোথাও কাউকে সংখ্যালঘু আর কাউকে সংখ্যাগুরু বলে চিহ্নিত করা হয়নি। হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ পাঠ করলেও খুব সহজে উপলব্ধি করা যায়, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ভাষা ও জাতিগত বৈচিত্র্যের কারণে নিজেকে ‘শ্রেষ্ঠ’ বা ‘গুরু’ দাবি করার সুযোগ ইসলাম ধর্মে নেই। হজরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁর বিদায় হজের ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন- ‘...আজ হতে বংশগত কৌলিন্য বিলুপ্ত হলো। সেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে নিজ কাজের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।... আরবদের ওপর অনারবদের এবং সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যখন তিনি এই ভাষণ প্রদান করেছেন; তখন ‘জনতা’, ‘জনমণ্ডলী’ বলে উপস্থিত লোকদের সম্বোধন করেছেন। আল কোরআনেও বহু স্থানে: ‘হে মানব জাতি!’ -এমন উল্লেখ রয়েছে। যা থেকে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, ইসলাম কেবল মুসলিমদের ধর্ম নয়। এটি সব মানুষের জন্য মনোনীত ধর্ম। যারা এর অনুসরণ করেন তারাই মুসলিম। আর যারা এর অনুসরণ করেন না; তারা মনুষ্য সমাজচ্যুত এমন মনে করার সুযোগ নেই। বরং অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি উদারতা ও সহনশীলতা হজরত মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবিরা দেখিয়েছেন, তা অনুসরণ করলে ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে যারা বিভিন্ন সময়ে কুমিল্লা, রামু, সাঁথিয়া ও অভয়নগরসহ বহু স্থানে মন্দির এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছেন; তারা প্রকৃতই ইসলাম ধর্মের বিধান লঙ্ঘন করেছেন তা স্পষ্ট হবে।

আল কোরআনে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে তাদের তোমরা গালি দিও না, কেননা, তারা সীমা লঙ্ঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দেবে...’ (সুরা আন্’আম : ১০৮)। আর আল কোরআনের অন্য আরও একটি আয়াতে বলা হয়েছে: হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তাকে ভয় কর যিনি তোমাদের একটি ব্যক্তি [হজরত আদম (আ.)] থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তার হতে তার জীবন সঙ্গিনীকে [হজরত হাওয়া (আ.)] সৃষ্টি করেছেন, আর তাঁদের দু’জন হতে অসংখ্য পুরুষ ও নারীর বিস্তার ঘটিয়েছেন, তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা পরস্পরে যাচনা (তাগাদা) করে থাকো এবং আত্মীয়স্বজনের ব্যাপারেও ভয় করো। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন (সুরা আন-নিসা: ১)।

ওই আয়াত অনুসরণ করলেই তো সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। কারণ, ইসলাম ধর্ম মতে সব মানুষই আদম-হাওয়ার সন্তান।

বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যও ওই বাঙালিদের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুতে বিভাজন স্বীকার করে না। যারা ধর্মীয় কারণে গর্ব করে নিজেদের সংখ্যাগুরু দাবি করেন; তারা কি কখনও ভেবেছেন: ওই সংখ্যালঘুরা কারা, কী তাদের পরিচয়, কোথা থেকেইবা তারা এসেছেন? তাদের ও আপনাদের পূর্বপুরুষরা একই পিতা ও মাতার সন্তান। একই পরিবারে আপনাদের ও তাদের পূর্বপুরুষরা বেড়ে উঠেছেন। তারা যে ভাষায় কথা বলে আপনারাও সেই ভাষায় কথা বলেন। তাদের ও আপনাদের চেহারায় এত মিল যে, তাদের বাড়ির বধূর কপালে যদি সিঁদুর আর হাতে শাঁখা না থাকে; তবে আপনাদের বাড়ির বউ আর তাদের বাড়ির বউকে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু তত্ত্বে আলাদা করা অসম্ভব হবে। আপনাদের কুমারী মেয়ে আর তাদের কুমারী মেয়েদের আলাদা করা যায় কি? আপনাদের ও তাদের মধ্যে এত মিল যে, অপরিচিত কোনও এলাকায় আপনাদের অথবা তাদের পুরুষ কোনও সদস্য দুর্ঘটনায় মারা গেলে সৃষ্টির আদিম অবস্থায় ফিরে না গেলে বোঝাই দায়; মৃত ব্যক্তিটি সংখ্যালঘু না সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের! ওই রকম যদি হাজারটা মিল অমিল দুপক্ষের মধ্যে খুঁজতে যাই; তবে ৯৯.৯৯ ভাগ দিক দিয়ে বাংলাভাষী বাঙালি মুসলিমদের কারোরই নিজেকে সংখ্যাগুরু এমন দাবি করার সুযোগ নেই।

সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর এই কেচ্ছা আমাদের রাজনীতিবিদরা সাজিয়েছেন কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে। ইসলাম ধর্মকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে তারা প্রায় সবাই সংখ্যালঘু ধোঁয়া তুলে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে নিপীড়ন করেছেন যুগের পর যুগ। ওই কথিত ইসলামপ্রেমীরা জানে, ধর্মের দোহাই দিয়ে হামলা চালালে ওরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পাড়ি জমাবে। তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি হয় সংখ্যাগুরুর কাছে কম দামে বিক্রি করবে। আর বিক্রির সুযোগ না পেলে তো এমনিতেই দখলে চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে হিসাব করলে দেখা যাবে, ১৯৭১-২০১৪ হিন্দু সম্পত্তি অধিকারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই।

পরিশেষে, কথিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাঙালিদের যেমন এ দেশে বসবাসের অধিকার রয়েছে; তেমনি অন্য ধর্মের মানুষেরও এই মা, মাটি, দেশের ওপর অধিকার কম নয়। তারাও বাংলার ভূমিপুত্র। তারা কোনোভাবেই সংখ্যালঘু নয়; তারা আমাদের ভাই। তাই তাদের রক্ষায় জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত। ইসলামের উদারতা ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে আল কোরআনের নির্দেশ ও হজরত মোহাম্মদের (সা.) আদর্শ অনুসরণ করে ওই সব কথিত মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে মুসলিমদের ইমানি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মুসলিমরা সেই দায়িত্ব পালন করবেন বলে আশা করি।


লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 
/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
‘চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজেই উদ্যোক্তা হোন’
‘চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজেই উদ্যোক্তা হোন’
শিলাবৃষ্টিতে ফুটো হয়ে গেছে ঘরের চাল, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
শিলাবৃষ্টিতে ফুটো হয়ে গেছে ঘরের চাল, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ