X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

পুলুদার ‘শালা’

দাউদ হায়দার
১৬ নভেম্বর ২০২০, ১৮:৩৪আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২০, ২৩:০৫

দাউদ হায়দার দেশ থেকে বিতাড়িত। পাইকপাড়ায় গৌরকিশোর ঘোষের ফ্ল্যাটে আশ্রিত। মা, দুই কন্যা, এক পুত্র এবং স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর পরিবার। উটকো ঝামেলা পাকিয়েছি। মুখে কেউ কিছু বলছেন না ঠিকই, চোখে মুখেও চিহ্ন নেই। নিজের ভেতরেই অস্বস্তি ঘোরতর। আছি মাসাধিক। পকেট শূন্য। ঢাকা থেকে মাত্র ৬০ পয়সা (ভারতীয়) নিয়ে গিয়েছি। শীলাদি (গৌরকিশোর ঘোষের স্ত্রী) প্রতিরাতে পাঁচ টাকার নোট বালিশের নিচে রাখেন; বলেন না। সকালে উঠে বিছানা, বালিশ ঠিক করার সময় আবিষ্কার করি। বলি শীলাদিকে। ‘বালিশের নিচে পাঁচ টাকা ছিল।’ ফেরত দিই। বলেন, ‘তোমার হাত খরচ।’ ও চাঁদ চোখের জলে লাগলো জোয়ার। প্রতিরাতেই রাখেন।
গৌরদার সঙ্গে গাড়িতে আনন্দবাজারে যাই। প্রতি সপ্তাহে একটি দু’টি কড়চা কলকাতায় লিখি। কড়চা বাবদ কুড়ি রুপি নিজেকে রকফেলার মনে হয়।
গৌরদা বললেন একদিন, ‘পায়ে হেঁটে কলকাতা শহর চিনবি, অলিগলি ঘুরবি। বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে এখনও যাসনি। ওখানে কফি হাউজ, কবিসাহিত্যিকের আড্ডা, বিকেল-সন্ধ্যায়। অনেকের সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব হতে পারে।’

গেলুম এক সন্ধ্যায়। সব টেবিল পূর্ণ। গিজগিজ করছে কফি হাউজ। কেউ তরুণ, যুবক, মধ্যবয়স্ক। তরুণী, যুবতী, মধ্যবয়স্কাও। ঢাকায় কফি হাউজ নেই, ঢাকা নিউমার্কেটে ‘মনিকা’ রেস্তোরাঁয় মাঝেমধ্যে কবি, সাহিত্যিকের আড্ডা। নারীবর্জিত।

কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজে নানা মুখ। কে কবি, কে গল্পকার, কে ঔপন্যাসিক, কে বিপ্লবী, কে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক গা গতরে লেখা নেই।

ইতিউতি তাকিয়ে দেখি এক টেবিলে দু’জন, একটি চেয়ার ফাঁকা। বসলুম। দু’জনের একজন বললেন, ‘মশাই, আমাদের বন্ধু আসবেন, এলে চেয়ার ছেড়ে দেবেন।’ তথাস্তু। কিছু বলিনি। মিনিট দু’তিন পরে একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘মশাই কোত্থেকে এসেছেন? নাম কী?’

বললুম। একটু চুপ থেকে, ‘আপনি কি…?’

উত্তরে প্রশ্ন: ‘কলকাতায় বেড়াতে এসেছেন?’

না।

-কোথায় থাকেন?

গৌরকিশোর ঘোষের ফ্ল্যাটে, আস্তানায়।

- সাংবাদিক-লেখক গৌরকিশোর? রূপদর্শী?

প্রশ্নকর্তা কবি শম্ভু রক্ষিত। পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ওঁর নাম দেবী রায়। কবি।’

পরিচয় হলো। দিন তারিখ মনে নেই। ১৯৭৪ সালের মধ্য জুনের কথা বলছি। কলকাতায় আশ্রিত ২১ মে থেকে।

কফি হাউজে প্রায়-নিত্যদিন যাই, সন্ধ্যায় অনেকের সঙ্গে সখ্যসম্পর্ক। বন্ধুতাও। সেপটেম্বরের শেষে বা অকটোবরের প্রথম সপ্তাহে একদিন, সন্ধ্যায়, এক টেবিলে চার-পাঁচজন গল্পে মশগুল। হাসাহাসি। কণ্ঠ অনুচ্চ। একজনকে দেখে বিস্মিত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কফি হাউজে আড্ডা দেন? বাকি কারা? জিজ্ঞেস করতেও ভয়।

মার্চের (১৯৭৫) এক সন্ধ্যায় (দিন-তারিখ ভুলে গেছি) দেখি কফি হাউজে সৌমিত্রসহ আরও দু’জন। কৌতূহল তুঙ্গে।

কবি সুব্রত রুদ্র জানান ‘একজন ‘এক্ষন’ সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য, আরেকজন অভিনেতা রবি ঘোষ।’

স্বীকার করি, রবি ঘোষের নাটক, সিনেমা তখনও দেখিনি। অপরিচিত। ‘এক্ষন’ সম্পাদক নির্মাল্য আচার্যের নাম বাংলাদেশে থাকাকালীনই জানা। চেহারাসুরতে গম্ভীর। পণ্ডিতি দেমাক। সাহস হয় না কথা কই (পরে অবশ্য তাও, কয়েক বছর পরে সাংবাদিক কল্যাণ চৌধুরী, ওঁর স্ত্রী নাট্যাভিনেত্রী কাজল চৌধুরীর আস্তানায় আলাপ, সম্পর্ক অগ্রজ-অনুজের)।

সাধ জাগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপের, সুযোগ হয় না। কফি হাউজে দুই-তিন মাস পর হঠাৎ হাজির, নির্বাচিত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা।

কপাল খুললো। কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত কফি হাউজে। আড্ডা দিচ্ছি। নির্মাল্য, সৌমিত্র এলেন। অমিতাভ বললেন, ‘পুলুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।’ পুলু?  সে কে?

সৌমিত্রকে পুলু বলছিলেন অমিতাভ দাশগুপ্ত।

সৌমিত্রর প্রশ্ন: ‘বাংলাদেশে বাড়ি কোথায়?’

-পাবনায়।

শহরে?

-জি (‘জি’ শুনে চোখের দিকে তাকান। মৃদু হাসি। ‘আজ্ঞে’ বলিনি। বাংলাদেশে ‘আজ্ঞে’ বলে না। ‘জি’।  যদিও হিন্দুউর্দুতে প্রচলিত)।

পাবনার কোথায়?

-দোহারপাড়ায়?

কালাচাঁদপাড়ার নাম শুনেছো?

-আমাদের পাশের পাড়া?

সুচিত্রা সেনের বাড়ি কোথায় জানো?

-দিলালপুরে। কালাচাঁদপাড়ার পাশেই। দোহারপাড়া থেকে দূরে নয়, কাছেই। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আমাদের বড় আপা (‘বড় আপা’ অর্থাৎ ‘দিদি’, পরে বলি) একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়তেন। কালাচাঁদপাড়ায় হামেশাই যাতায়াত। কালাচাঁদপাড়া আর রাধানগরের দুর্গাপুজোয়, অন্যান্য পুজোয় আমরাই পান্ডা।

দীপার বাড়ি কালাচাঁদপাড়ায়। তাহলে তুমি পাড়াতুতো শালা।

- অ্যাঁ! শালা?

অমিতাভ দাশগুপ্তের প্রশ্ন, ‘শ্যালক নয়?’

সৌমিত্রর উত্তর, ‘শ্যালক দূরের, শালা কাছের।’

হাসাহাসি। (সবই যে হুবহু বয়ান, নয় হয়তো। অনেকটাই কানে যতটা সেধে আছে। যাচাই মুশকিল অমিতাভ, সৌমিত্র পরলোকে)।

দেখা হলে বলতেন, ‘শালা।’ সম্বোধন করতুম ‘পুলুদা।’

যেহেতু শালা এই আবদারে প্রায় হাজির ওঁর বাড়িতে। একবার বিপদ, বাড়িতে অ্যালসেশিয়ান কুকুর। প্রায় আক্রমণ। হামলে পড়ে। ছুটে এসে রক্ষা করেন।

গিয়েছিলুম (১৯৭৮), ‘বাংলাদেশের কবিতাসন্ধ্যা অনুষ্ঠান উপলক্ষে। আয়োজন কবি রবীন্দ্রসদনে সেই প্রথম (কলকাতায়) বাংলাদেশের কবিতাপাঠের একক অনুষ্ঠান।

স্ক্রিপ্ট লেখেন প্রণবেশ সেন। সঞ্চালক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। নামীদামি আবৃত্তিকার (আজকের দিনে ‘বাচিকশিল্পী’)। শম্ভু মিত্র রাজি হয়েও শেষ মুহূর্তে অপারগ। অপর্ণা সেন শুটিংয়ের ব্যস্ততায় অনুপস্থিত। কাজি সব্যসাচীকে রাজি করিয়েছেন আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ (অনুষ্ঠানের নেপথ্যে মূলত তিনিই)। অনুষ্ঠানে আবৃত্তিকার গৌরকিশোর ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসু, প্রদীপ ঘোষ প্রমুখ। সৌমিত্র পোস্টকার্ডে, চিঠিতে জানান, ‘আল মাহমুদের দুটি কবিতা পড়বো।’ সবিতাব্রত দত্তর চিঠিতে ‘জসীমউদদীনের ‘উড়ানীর চর’ কবিতা বাছাই করেছি।’

- হায়! চিঠিগুলো সংগ্রহে নেই। থাকবেই বা কী করে? হুটহাট জার্মানিতে প্রস্থান।

‘বাংলাদেশের কবিতা’র অনুষ্ঠান বিজ্ঞাপিত আনন্দবাজার, যুগান্তরে। সকাল ১১টার মধ্যে টিকিট নিঃশেষ ব্ল্যাকেও বিক্রি।

কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান উপলক্ষেই সৌমিত্র সঙ্গে নৈকট্য। প্রায়ই ওঁর আস্তানায় হানা। ব্যস্ত থাকলে কিংবা শুটিংয়ের তাড়া থাকলে বলতেন, ‘এখন নয় ফোন করে এসো।’

একবার টেলিফোন: ‘আল মাহমুদ কলকাতায় এলে জানিও। দেখা করবো।’ আশির গোড়ায় (১৯৮০) আল মাহমুদ এলেন। টেলিফোন করে, সময় নিয়ে আল মাহমুদকে নিয়ে গেলুম। অনেকক্ষণ গল্প। আল মাহমুদকে নিজে কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়ে বললেন, ‘আমার স্ত্রীর পাড়াতুতো এই…শালা।’ মজা করলুম।

সহপাঠী বন্ধু সোমেন মণ্ডলের ফ্ল্যাট (গল্প গ্রিনে) সোমিত্রর বাড়ি সংলগ্ন। এক সকালে ব্রেকফাস্টের জন্য গিয়েছি। সোমেনের ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে সৌমিত্রর বাড়িতে। তিনবার কলিংবেল টিপলুম। কেউ খোলে না। চলে আসবো। হঠাৎ দরজা খোলা। সৌমিত্রর পরনে তোয়ালে। স্নানের আগে। দেখে বিস্মিত। ‘কবে এসেছো’ জেনে ‘শুটিংয়ে যাবো।’ পরে ফোন করো। এসো।’ গিয়েছিলুম। ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে’ কাব্যগ্রন্থ উপহার দেন।

ওঁর জন্মদিনে, গত কয়েক বছরে, শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন করতুম। বছর তিনেক আগে ঢাকায় গিয়ে কী অভিজ্ঞতা, জানান ফোনে।

‘তুমি শুধু নও, বাংলাদেশে আমার অনেক শালা।’ বলেই হো হে হাসি।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ