X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সহিষ্ণুতার ইসলাম এবং আমাদের অতি স্পর্শকাতর অনুভূতি

প্রভাষ আমিন
২৫ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৩৩আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২০, ১৮:২৭

প্রভাষ আমিন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সাথে এক বুড়ির কাহিনি আপনাদের সবার জানা। এক বুড়ি প্রতিদিন মহানবীর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। মহানবী চলার পথে কাঁটা সরিয়ে গন্তব্যে যেতেন। একদিন দেখলেন পথে কোনও কাঁটা নেই। তিনি খোঁজ নিলেন, সেই বুড়ির অসুখ করেনি তো। এই ছিলেন শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) উদারতা।
মহানুভবতা, অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য, অনুপম ব্যক্তিত্ব, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, নম্রতা, সত্যনিষ্ঠা- সব মিলিয়ে বিরল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে তিনি মানবিক ও সদাচরণ করতেন। বিশ্বমানবতার কল্যাণ, সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই ছিল হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ব্রত। তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছিলেন। নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মালয়কে সুরক্ষিত রাখার সুযোগ দিয়েছিলেন। কোনও দিন তাঁর প্রচারিত ইসলাম ধর্ম কোনও অমুসলিমের প্রতি চাপিয়ে দেননি। ব্যক্তিগত কারণে কোনও অমুসলিমের ওপর কোনও প্রতিশোধ নেননি। মোহাম্মদ (সা.)-এর এই অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং উদারতার জন্যই ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বে। তিনি ভালোবেসে মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। এমনকি অন্য ধর্মের মানুষ বা শত্রুরাও তাঁর সংস্পর্শে এসে বদলে গেছেন। বিদ্বেষ নয়, হানাহানি নয়, হিংসা নয়; মোহাম্মদ (সা.) সারা জীবন মানবতার বাণী, শান্তির কথা ছড়িয়েছেন।
কিন্তু আজ তাঁর কিছু উম্মত ধর্মের নামে, ইসলামের নামে যা করছে; তা কোনোভাবেই তাঁর ইসলাম নয়। কিছু বিভ্রান্ত মুসলমানের কারণে আর পশ্চিমাদের প্রচারণায় ইসলামের সঙ্গে আজ শান্তি নয়, সন্ত্রাস শব্দটিই বেশি উচ্চারিত হয়। পশ্চিমাদের সৃষ্ট এই পারসেপশন বদলাতে মুসলমানদের আরও বেশি নম্র, ভদ্র, সহনশীল হওয়া উচিত ছিল। তাদের কথায়, কাজে যেন কেউ কষ্ট না পায়। বরং প্রতিটি মুসলমানের কথায়-কাজে মুগ্ধ হয়ে যেন বিশ্বের মানুষ বুঝতে পারে, ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসের কোনও সম্পর্ক নেই। ইসলাম সত্যিই শান্তির ধর্ম, সহনশীলতার ধর্ম, সহাবস্থানের ধর্ম। কিন্তু আমাদের যেটা করা উচিত, সেটা না করে আমরা করছি উল্টোটা। মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির যেন অন্ত নেই।
শিয়া-সুন্নির বড় বিভেদ তো বিশ্বজুড়ে; বাংলাদেশেই দেখি ইসলামের কত ধারা। কেউ মিলাদ পড়ে, কেউ পড়ে না। কেউ মাজারে যায়, কেউ যায় না, এমনকি মাজার ভেঙে ফেলতে চায়। কেউ শবেবরাত পালন করে, কেউ করে না। কেউ ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করে, কেউ করে না। একপক্ষ আরেক পক্ষকে মুরতাদ ঘোষণা করে, অমুসলিম ঘোষণা করে। শুধু ঘোষণা করেই বসে থাকে না; গায়ের জোরে সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলাম সব মানুষের ধর্ম। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু উগ্র মৌলবাদীর কথা শুনলে মনে হয়, ইসলাম কেউ তাদের কাছে ‘লিজ’ দিয়েছে। ইসলাম নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তারা ‘হৈ হৈ’ করে ওঠে, ইসলাম নিয়ে কিছু বলার অধিকার আপনার নেই। কেন নেই? ইসলাম নিয়ে কে কথা বলবে না বলবে; তা ঠিক করে দেওয়ার আপনি কে? তারা বলে, আপনারা ইসলাম সম্পর্কে জানেন না, তাই বলতে পারবেন না। আরে ভাই, জানি না বলেই তো জানতে চাই, প্রশ্ন করতে চাই, আরও বেশি শুনতে চাই। কিন্তু তাদের কথা হলো, কোনও প্রশ্ন করা যাবে না। আরে ভাই, প্রশ্ন না করলে জানবো কীভাবে? আর ইসলাম সম্পর্কে জানা-বোঝার এখতিয়ার কি শুধু এই উগ্র কাঠমোল্লাদের। যে কেউ চাইলে কোরআন, হাদিস, ইসলামের ইতিহাস পড়ে জানতে পারবে, মতামত দিতে পারবে, প্রশ্ন করে নিজের বিভ্রান্তি দূর করতে পারবে। এটাই হওয়া উচিত, হওয়ার কথা। তাদের একটাই কথা, ‘কল্লা চাই, কল্লা চাই’। তারা কোনও যুক্তির কথা বলবে না, তারা কোনও বাহাস করবে না, ভিন্নমতকে ধারণ করবে না, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করবে না, ভিন্ন ধর্মের মানুষদের মর্যাদা দেবে না।

সাকিব আল হাসানকে হুমকি দিয়েছে যে মহসিন তালুকদার, তার হুমকির ভিডিওটি আপনারা কেউ দেখেছেন? আমি কয়েক মিনিট দেখতে পেরেছি। এরপর আর কান নিতে পারেনি। তার হুমকির ৯৫ ভাগই অশ্লীল গালাগাল। এখন ভিন্ন ধর্মের কেউ যদি মহসিন তালুকদারকে মুসলমান মনে করে, তাহলে ইসলাম সম্পর্কে তার ধারণাটা কী হবে? আরব ভূমি থেকে ইসলাম যে আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে, তা কীভাবে সম্ভব হয়েছে- গায়ের জোরে, গালি দিয়ে, কল্লা ফেলে? অবশ্যই না। ভালোবাসা দিয়ে ইসলাম বিশ্ব জয় করেছে। শান্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু মুসলমান নামধারী কিছু উগ্র মৌলবাদী সেই শান্তির ইসলামকে আজ সন্ত্রাসীদের ধর্ম বানাতে চাইছে।
ধরুন, ১২০০ বছর আগে যদি মামুনুল হকের মতো কেউ ধর্ম প্রচার করতে এ অঞ্চলে আসতো, তাহলে কী হতে পারতো? মামুনুল হকের বক্তৃতা শুনে আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে তো মানুষ ভয়েই পালাবে, ইসলামের কথা শোনার সুযোগই হবে না কারও। এই ভয়ঙ্কর মামুনুল হকদের কবল থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে হবে।
ফেসবুকে ইসলাম প্রসঙ্গে কিছু লিখলেই কিছু লোক এসে অকথ্য এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শুরু করে। ইসলামের মতো একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জীবন বিধানের পক্ষে বলার মতো হাজারটা যুক্তি থাকার কথা। কিন্তু এই উন্মাদগুলোর কাছে কোনও যুক্তি নেই। এরা ইসলাম সম্পর্কে জানে না, জানতে চায়ও না; কেউ জানতে চাইলেও তাদের প্রবল আপত্তি। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় আল্লামা শফী গ্রুপের বিপক্ষে বাবুনগরী গ্রুপ বিদ্রোহ করে। তারা অসুস্থ আল্লামা শফীকে জিম্মি করে দাবি আদায় করে। হাটহাজারী মাদ্রাসা নিয়ে শফী এবং বাবুনগরী গ্রুপ একে অপরকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। কিন্তু যখনই আমি লিখতে গেছি, তখনই দুই পক্ষ মিলে আমার ওপর ক্ষিপ্ত- হাটহাজারী মাদ্রাসা নিয়ে আপনার কিছু লেখার অধিকার নেই। যেন ইসলাম নিয়ে মাদ্রাসা আর কিছু কাঠমোল্লা ছাড়া আর কিছু বলার অধিকার নেই। অথচ ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম।
পবিত্র কোরআনে মুসলমানদের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট উপদেশ আছে- কথাবার্তায় কর্কশ না হওয়া, রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা, অন্যের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, অহংকার না করা, অন্যকে তার ভুলের জন্য ক্ষমা করা, লোকদের সঙ্গে ধীরস্থির হয়ে শান্তভাবে কথা বলা, উচ্চস্বরে কথা না বলা, অন্যকে উপহাস না করা ইত্যাদি। বাংলাদেশের তথাকথিত মুসলমানরা এর কয়টা মানে? বাংলাদেশে ওয়াজ মানেই উচ্চস্বরে হুমকি দেওয়া, নারীদের অবমাননা করা, অশ্লীল গালাগাল করা। মামুনুল হকের কিছু বক্তব্য শুনলেই তো সবাই ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করবে।
বাংলাদেশের অল্প কিছু মুসলমানের ইসলাম সম্পর্কে ধর্মীয় অনুভূতি যেন অতি স্পর্শকাতর। কথায় কথায় তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। ইসলাম সবসময়ই ভিন্ন ধর্মকে, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করে। এ অঞ্চলের বরাবরই সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে। হিন্দুরা মুসলমানদের ঈদ উৎসবে যোগ দেয়, মুসলমানরা হিন্দুদের পূজা উৎসবে যোগ দেয়। তার মানে কিন্তু কোনও হিন্দু নামাজ পড়ে না, কোনও মুসলমানও পূজা করে না। শুধু উৎসবটা সবাই মিলে মিশে করে। বাংলাদেশ এবং ভারতেরও রাজনৈতিক নেতা এবং সেলিব্রেটিরা সব ধর্মের উৎসবে অংশ নেয়। অথচ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান কলকাতার একটি কালী পূজার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ায় যেন তাদের অনুভূতিতে আগুন লেগে গেছে। অথচ সাকিব কিন্তু পূজা করেননি, পূজার উৎসবে অংশ নিয়েছেন। গুজব শুনলেই তারা মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, ভিন্ন ধর্মের মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। অথচ এই হিংস্রতার সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই।
সময় এসেছে অল্প কিছু কাঠমোল্লার কবল থেকে উদ্ধার করে ইসলামকে সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার। ইসলাম যে সহজিয়া ভাবধারার সাধারণ মানুষের শান্তির ধর্ম; সেই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
রামরুর কর্মশালায় বক্তারাঅভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ