X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ

প্রভাষ আমিন
০১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৬:৩১আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৬:৩২

প্রভাষ আমিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন তিনি। তবে মেয়র থাকা না থাকায় কোনও ফারাক ছিল না। এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী সবসময় তার মতোই ছিলেন। কোনও অন্যায় হলে তার প্রতিবাদ করতেন, কোন দল ক্ষমতায় আছে, সেটা বিবেচনায় না নিয়েই। জাতীয় নেতা বা মন্ত্রী হওয়ার সব যোগ্যতা এবং সুযোগ থাকলেও তিনি কখনও চট্টগ্রাম ছেড়ে যাননি। তাকে সবাই ডাকতেন ‘চট্টলবীর’ বলে। তিন বছর আগে মহিউদ্দীন চৌধুরী মারা গেছেন। তবে রেখে গেছেন যোগ্য উত্তরসূরি। তার ছেলে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল উচ্চশিক্ষা নিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন। তিনিও চট্টগ্রামকে ভালোবাসেন। তবে তিনি জাতীয় রাজনীতিতেও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। অল্প বয়সে সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব। বর্তমানে তিনি পালন করছেন শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব। ছোট কাঁধে বড় দায়িত্ব। তবে কাঁধটা ছোট হলেও সেটা যে দায়িত্ব নেওয়ার মতো যথেষ্ট দৃঢ় তা বারবার প্রমাণ করেছেন। আওয়ামী লীগের এই তরুণ নেতাকে একটা স্যালুট দিয়েই আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই।

গত ১৩ নভেম্বর পুরান ঢাকার এক সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সম্পাদক মামুনুল হক উগ্র ভাষায় ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের প্রতিবাদ করেন। এবং ভাস্কর্য স্থাপন করা হলে তা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকির পরও আওয়ামী লীগ মহলে ছিল রহস্যজনক নীরবতা। সাধারণত এমন কিছু হলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী লীগ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মিছিল করে। আর কিছু না হোক, সারাদেশে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কয়েকশ’ মামলা হতে পারতো। কিন্তু আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা যেন দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের একটা অঘোষিত সমঝোতার কথা সবাই জানে। প্রতিবাদ করলে আবার কেউ মনক্ষুণ্ন হয় কিনা তা নিয়ে সবার দ্বিধা ছিল। তবে এই দ্বিধাকেই আমি বলবো, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ব্যর্থতা বা দুর্বলতা। মৌলবাদীদের আস্ফালন, তাও আবার বঙ্গবন্ধুর অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেত কখনও আওয়ামী লীগকে কখনও কারও সিগনালের অপেক্ষা করতে হবে, এটাই দুঃখজনক। এটা হলো আওয়ামী লীগের সহজাত আদর্শিক অবস্থান। কিন্তু সেখানেই মনে হয় একটু টান পড়েছে। জাতির জনককে এত বড় অবমাননার পরও দেশের কোথাও মামুনুল হকের বক্তব্যের বিরুদ্ধে কোনও তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়নি; এ বড় বেদনার, বড় বিস্ময়ের।

তবে ‘বাপের বেটা’ মহিবুল হাসান চৌধুরী কারও জন্য অপেক্ষা করেননি। পরদিনই চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারী মৌলবাদীদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট করে বলে দেন, ‘আপনাদের হুমকি-ধামকি বন্ধ করুন। এদেশের মানুষ গণতন্ত্রকে শ্রদ্ধা করে। মৌলবাদী কথা বলা, জনমনে শঙ্কা তৈরি করা, জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং জাতির পিতাকে নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা যারা দেখাবেন, তাদেরকে আমরা বলতে চাই—আপনারা বাড়াবাড়ি বন্ধ করুন। আওয়ামী লীগের কাছে, এদেশের মানুষের কাছে দ্বীন ইসলাম সুরক্ষিত আছে। আপনাদের কাউকে সেই ঠিকাদারি দেওয়া হয়নি। আপনারা সাবধান হয়ে যান, বাড়াবাড়ি বেশি করে ফেলেছেন। আপনাদের বাড়াবাড়ি দেখছি আর শুনছি। সরকার এবং রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। আওয়ামী লীগ ঘাড়ে হাত রেখে বন্ধুত্বও করতে জানে, ঘাড়ে হাত রেখে ঘাড় মটকে দিতেও জানে। সুতরাং ঘাড়ে হাত দিয়ে বন্ধুত্ব করেছি বলে, সহনশীল আচরণ দেখিয়েছি বলে, মনে করবেন না সেটা দুর্বলতা। দেশে হানাহানি করলে, আইনশৃঙ্খলা নষ্ট করলে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করলে ঘাড় আমরা মটকে দেবো। সময় থাকতে সাবধান হয়ে যান, মৌলবাদের জায়গা এই বাংলাদেশ নয়।’

অন্যরা যেখানে দ্বিধায়, সেখানে কনিষ্ঠ নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী তাৎক্ষণিকভাবে আওয়ামী লীগের আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট করে দেন। শুধু মুখে বলে বসে থাকেননি নওফেল। ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে মামুনুল হকের এক অনুষ্ঠানে যাওয়া ঠেকিয়ে দেয় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের দ্বিধার সুযোগে মৌলবাদীরা তাদের আস্ফালন এবং ঔদ্ধত্য চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। এই সময়ে ফেসবুকে কিছু প্রতিবাদ আর টুকটাক বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া তেমন জোরালো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। তবে বিশেষ ধন্যবাদ পাবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। করোনা আক্রান্ত হয়েও বাসা থেকেই ফেসবুকে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান জানান মাহবুবউল আলম হানিফ। ১৭ নভেম্বর তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য নিয়ে যারা উল্টা পাল্টা কথা বলছেন তাদের মনে রাখা দরকার এটা পাকিস্তান নয়, এটা স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে এই ধরনের বক্তব্য বরদাশত করা হবে না। এই কুচক্রীদের বিরূদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানাচ্ছি।’ তথ্যমন্ত্রীও সচিবালয়ে একাধিক ব্রিফিংয়ে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের ঘোষণা দেন। দুই সপ্তাহ পরে হলেও ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।

তবে আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অবস্থান জানাতে দুই সপ্তাহ সময় নেয়। ২৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বাসা থেকে তার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করেন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন মাঠে নেমেছে, মাঠে নেমেছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিকব সংগঠনও। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে এখন দেশজুড়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হচ্ছে। প্রতিরোধের মুখে মামুনুল হকের হুঙ্কার এখন ছোট হয়ে এসেছে। এখন তার দাবি, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার কথা তিনি বলেননি। এটা স্পষ্ট মিথ্যাচার। কারণ তার হুঙ্কারের ভিডিও এখনও ইউটিউবে আছে।

১৯৪৭ সালে ধর্মকে পুঁজি করে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগ হয়েছিল কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল ধর্মীয় রাজনীতি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সামরিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ধর্মকে আবার রাজনীতিতে টেনে আনে, বারবার সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশের মৌলিক চেতনায় আঘাত করে। এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। রাজনীতি এমন এক জটিল বিষয়, এখন বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাও আছে, রাষ্ট্রধর্মও আছে।

২১ বছর পর ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। ‘৭৫-এর পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার না করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল সেই কলঙ্কের অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচার করা। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঠেকিয়ে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ক্ষমতার প্রথম দফায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, যা কার্যকর করতে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের। তবে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগও বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদীদের কোনও কোনও অংশের সঙ্গে আপস করেছে। ২০০৬ সালে না হওয়া নির্বাচনের আগে খেলাফতে মজলিশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে’র পর হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস করেছে। তাদের নানা আবদার মিটিয়েছে। কিন্তু বারবার প্রমাণিত হয়েছে মৌলবাদীরা আওয়ামী লীগের সহজাত শত্রু। যতই আপস, সমঝোতা বা কৌশল করুক না কেন, আওয়ামী লীগ কখনও এদের পাশে পাবে না।

বরং এই কৌশল করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ তার সহজাত বন্ধুদের মন খারাপ করেছে। ১৯৪৯ সালে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিপক্ষে জনগণের মুসলিম লীগ মানে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। কিন্তু ১৯৫৫ সালেই নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রথম দুজন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ইসলামী আলেম। কিন্তু নিজ ধর্ম পালন করেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতে তাদের কোনও সমস্যা হয়নি। যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পূর্ণ বিকাশ, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দল এবং দেশকে এগিয়ে নিতে তার কোনও সমস্যা হয়নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও তার পিতার আদর্শেই পথ চলছেন। তাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করেও চেতনায় অসাম্প্রদায়িকতাই আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। ’৭১ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ বারবার সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম করেছে এবং জিতেছে। এই লড়াইয়েও নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগই। আবারও সময় এসেছে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ার।

গণতন্ত্রহীনতা, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা, বিরোধী মতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা, সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিস্তার—এ ধরনের অনেক অভিযোগ থাকলেও এখনও আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার শেষ আশ্রয়। আওয়ামী লীগকে তাই সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে জ্বলে উঠতে হবে আপন শক্তিতে, নিজস্বতায়। বাংলাদেশের স্বার্থেই এই লড়াইয়ে আওয়ামী লীগকে জিততে হবে। এখন আপস করা বা ছাড় দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে চাই শূন্য সহিষ্ণুতা। বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিপরপেক্ষতার পথ ধরে। বিজয়ের মাসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুমিল্লায় ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা, শেখ ইনানকে হত্যার হুমকি
কুমিল্লায় ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা, শেখ ইনানকে হত্যার হুমকি
হলমার্কের এমডি তানভীর ও তার স্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
হলমার্কের এমডি তানভীর ও তার স্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
পদোন্নতি পেলেন বিএনপির তিন নেতা
পদোন্নতি পেলেন বিএনপির তিন নেতা
নিয়ম ভাঙায় পয়েন্ট কাটা গেলো নটিংহ্যাম ফরেস্টের
নিয়ম ভাঙায় পয়েন্ট কাটা গেলো নটিংহ্যাম ফরেস্টের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ