X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস

সালেক উদ্দিন
০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:৩৫আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:৫০

সালেক উদ্দিন প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা-সহযোগিতা ও তাদের সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালনের পেছনে যে ঘটনাটি কাজ করছে তা হলো ১৯৫৮ সালের মার্চে বেলজিয়ামে খনি দুর্ঘটনায় বহু শ্রমিকের মৃত্যু এবং পাঁচ সহস্র শ্রমিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়লে অনেক সামাজিক সংস্থা তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজে  এগিয়ে আসে। পরের বছর আন্তঃদেশীয় স্তরে এক বিশাল সম্মিলনে সর্বসম্মতভাবে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়। সেই আহ্বানের সূত্র ধরেই ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এই দিবসটি আমরা পালন করে আসছি।
দুর্ঘটনা ছাড়াও জন্মগতভাবে, পুষ্টির অভাবে, অসুখে-বিসুখে মানুষ প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়। এদের মধ্যে রয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও মানসিক প্রতিবন্ধী। শারীরিক বা মানসিক যেটাই হোক প্রতিবন্ধিত্ব মানেই অসহায়ত্ব। প্রতিবন্ধী সম্প্রদায় অসহায় ও দুর্বল মানুষ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অসহায় ও দুর্বলের ওপর অবহেলা অবজ্ঞা, নির্যাতন সৃষ্টির শুরু থেকে সব সমাজ ব্যবস্থায় ছিল এখনও আছে। উন্নত বিশ্বে এর ধরন এক আর অনুন্নত বিশ্বে এর ধরন আরেক। উন্নত বিশ্বে এই নির্যাতনগুলো এমনভাবে হয় যে তা হালালের জন্য আরেকটি আবরণও সৃষ্টি করা থাকে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে এই আবরণের বিষয়টি না থাকায় দুর্বলের প্রতি অবহেলা অবজ্ঞা নির্যাতন বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়।

বাংলাদেশে প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললে বিভিন্নভাবে দুর্বলের ওপর নির্যাতনের খবর চোখে পড়ে। এমন একটি দিন নেই যেদিন খবরের কাগজে নির্যাতন-ধর্ষণ-খুন অথবা গুমের  খবর ছাপা হয়নি। প্রতিবন্ধী নির্যাতন-ধর্ষণ ও খুনের মতো নৃশংস ঘটনাও আমাদের দেশের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এই লেখাটা যখন লিখতে বসেছি সেই সকালে একটি দৈনিক পত্রিকায় পাশাপাশি প্রকাশিত তিনটি খবরের শিরোনাম এমন—‘রাজধানীতে প্রতিবন্ধী কিশোরী ধর্ষণের শিকার’, ‘করোনাকালে মাসে ১০৮টি নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে’, ‘প্রতিবন্ধী শিশুকে রেলস্টেশনে ফেলে গেলো পরিবার’। এটাই আমাদের চালচিত্র। আর এর সবই যে সূত্রে গাঁথা তা হলো অসহায় ও দুর্বলের প্রতি সবলের অবজ্ঞা অবহেলা অবিচার ও নির্যাতন। একটি সভ্য সমাজে যা কখনও কাম্য হতে পারে না।

প্রতিবন্ধীদের অপাঙ্‌ক্তেয় বিবেচনা করা নয়। তাদের প্রতি অবহেলা নয় নির্যাতন নয়। তাদের জন্য ভালোবাসা আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াই হলো মানবতা। শিক্ষা প্রশিক্ষণ স্বাস্থ্যসেবা পুনর্বাসন কর্মসংস্থান বিনোদন প্রভৃতি মানুষ হিসেবে প্রতিবন্ধীর জন্মগত অধিকার। এজন্য সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য জায়গা করে দেওয়ার মতো কার্যক্রম অপরিহার্য। প্রতিবন্ধীদের পরমুখাপেক্ষিতা থেকে স্বাবলম্বীর পথে আনা, সমাজে আর দশ জনের মতো তাদের কেউ কর্মীর হাতে পরিণত করার পদক্ষেপ সমাজের ধারক বাহকদের নিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ  বিভিন্ন প্রতিবন্ধিতার শিকার। অধিকাংশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা সম্ভব হয়নি এ দেশে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের একটি অংশকে দেখা যায় ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন-যাপন করতে। অন্ধ প্রতিবন্ধীদের দলবেঁধে জারি গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায় রাস্তাঘাটে পাড়া-মহল্লায়। কেউ কেউ বিভিন্ন জায়গা থেকে এদের সংগ্রহ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামিয়ে এদের দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যও করে।

প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে এই সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। এদের স্বাভাবিক মানুষের মতো সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দেওয়া দেশের সরকারের জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। দেশের প্রতিবন্ধীদের তালিকা করে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে জেলা শহরে এমনকি থানা পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলা উচিত। এসব পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের শ্রেণিকরণ করে সে অনুযায়ী যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের  জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। সর্বোপরি অভিশপ্ত এসব প্রতিবন্ধী মানুষকেও দেওয়া যেতে পারে আর দশজনের মতো আনন্দময় চমৎকার জীবন।

প্রতিবন্ধীরা আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বোঝা মনে হলেও তাদের মধ্যেও রয়েছে স্রষ্টা প্রদত্ত অনন্য প্রতিভা। এ প্রসঙ্গে  একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দুর্ঘটনায় বা হাত হারানো ১৩ বছরের এক জাপানি প্রতিবন্ধী  জুডো শিখছিল। জুডোর এত প্যাঁচ থাকতে ওস্তাদ তাকে পাঁচ ধরে একটি  প্যাঁচই বারবার প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিল। প্রতিযোগিতায় তার প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী আর অভিজ্ঞ ছিল। ফলে প্রতিবন্ধী ছেলেটি মার খেতে খেতে যখন চরম বিপর্যয়ের মুখে তখনও তার ওস্তাদ বা গুরু রেফারিকে খেলা চালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। শক্তিমান প্রতিপক্ষ অধৈর্য হয়ে উঠলো। মরিয়া হয়ে আক্রমণ করতে লাগলো। বালক ঠান্ডা মাথায় প্রতিটি আক্রমণ কাটাচ্ছে। হঠাৎ প্রতিপক্ষ একটা ভুল করার সঙ্গে সঙ্গে বালক তার শেখানো প্যাঁচটি প্রয়োগ করলো এবং জিতে গেলো। সবাই আশ্চর্য। এও কী সম্ভব!

কেন এবং কীভাবে ছেলেটি জিতলো এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তার ওস্তাদ বা গুরু। তার মতে প্রতিবন্ধী ছেলেটি দুটি কারণে জিতেছে। এক. জুডোর খুব দুরূহ একটি কৌশল বা প্যাঁচকে সে দীর্ঘ সময় ধরে ভালোভাবে শিখেছে। দুই. এই প্যাঁচ থেকে বাঁচার জন্য প্রতিপক্ষের সামনে একটি পথই খোলা ছিল তা হলো আক্রমণরত প্রতিপক্ষের বাম হাত ধরে ফেলা। কিন্তু প্রতিবন্ধী প্রতিযোগীর তো বাম হাতই নেই, প্রতিপক্ষ তা ধরবে কীভাবে? যে কারণে অভিজ্ঞ ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ প্রতিবন্ধী বালক প্রতিযোগীর কাছে হেরে গিয়েছিল। অর্থাৎ সীমাবদ্ধতা যাই থাক সঠিক পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টায় তা অতিক্রম করা খুব একটি কঠিন কাজ নয়।

সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সীমাহীন সাফল্যের সুযোগ থাকে। যথাযথ সুযোগ পেলে  প্রতিবন্ধীরাও অনেক কিছু করতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে তারা সক্ষম। সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা যায়।

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সমাজ ও  সরকার যে কিছুই করছে না তা নয়। অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ভাতা প্রদান, প্রতিবন্ধী ছাত্র ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান  ইত্যাদি কর্মসূচির প্রচলন আমাদের দেশে  রয়েছে। দেশে কয়েকটি প্রতিবন্ধী মডেল স্কুলও রয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে যা এখনও চলছে।

এসব কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। সার্বিক অবস্থা  পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধীর অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের অধিকার খুবই নগণ্য। দেশে শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী সংখ্যা এত ব্যাপক নয় যে  প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে বিরাট বাজেটের প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন রয়েছে মানসিকতার পরিবর্তন এবং যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণের।

আশা করবো এবারের বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসকে কেন্দ্র করেই সরকারের পক্ষ থেকে সেই রকম একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে এবং তা বাস্তবায়নে সঠিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে  তাদেরকে পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ