X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’

রুমিন ফারহানা
০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ২৩:৫১আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:০০

রুমিন ফারহানা ‘তাজকেরাত-উল-আউলিয়া’ বইটি বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়, বহু ঘরে বইটি গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করা হয়। বইটির লেখক ইরানের নিশপুরের আবু হামিদ বিন আবু বকর ইব্রাহিম (১১৪৫-১২২০)। পিতার কাজের সূত্রে তিনি চিকিৎসক হয়েছিলেন, কিন্তু কুফা, মক্কা, দামেস্ক, তুরস্কে ভ্রমণকালে তিনি সুফি শায়খ বা শেখদের সান্নিধ্যে এসে ভাবুক ও কবি বনে যান। তিনি কবিতা লিখতেন শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার (আত্তার মানে ফার্মাসিস্ট) নামে।
ইরান-তুরস্কে শেখ ফরিদ মহত্তম সুফি কবি হিসেবে স্বীকৃত। জালালুদ্দিন রুমির প্রেরণাদায়ী কবিদের একজন বলে তাকে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশেও ফরিদ উদ্দিন আত্তার খুব পরিচিত নাম। তাই এখানেও স্রষ্টার আর তার সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি এবং তাঁর কবিতা। তাই মুখে তাঁর নাম বলে (অর্থাৎ ভালোবাসার কথা) বগলে ইট (আক্রমণাত্মক মানসিকতা) রাখা আসলেই খুব ভয়ংকর। এটা ভণ্ডামি, আর ধর্মীয় পরিভাষায় মোনাফেকি।

এতে কোনও সন্দেহ নেই, যদি ‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’ থাকে কোনও ব্যক্তির বা দলের, তাহলে সেটা সেই ব্যক্তি বা দলের জন্য এক ভয়ংকর ব্যাপার। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক কয়েক দিন আগে তাঁর বাসভবনে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বিএনপির গণতন্ত্র হচ্ছে মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন অতি মেধাবী মানুষ। সাহিত্য তার প্রিয় বিষয়, লেখালেখিও করেন তিনি। দেখা যাক বিএনপি’র গণতন্ত্রের প্রশ্নে যে প্রবচনটি তিনি ব্যবহার করেছেন, কার ক্ষেত্রে সেটি সঠিক।

সরকার নাকি শাসন দীর্ঘায়িত করতে চায়- বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে পরবর্তী নির্বাচন হবে। তাই শাসন দীর্ঘায়িত করার কোনও ইচ্ছা সরকারের নেই, এমনকি সুযোগও নেই।’ শেখ হাসিনা সরকার উন্নয়নবান্ধব সরকার, দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে নিচ্ছে বলেই জনগণ বারবার আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

নির্বাচনের পথে না হেঁটে ক্ষমতায় যেতে নানান অগণতান্ত্রিক পথ খোঁজা বিএনপির পুরনো অভ্যাস জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাদের দুঃশাসন এখনও মানুষকে তাড়া করে। তাই তারা জনমানুষের আস্থা হারিয়েছে।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি নেতারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। আমরা বলবো, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগে নিজের দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। বক্তব্য-বিবৃতি আর গুজব অপপ্রচার চালিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এজন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন হয়। আর জনসমর্থন পেতে জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণের কাছে না গিয়ে তাদের সুখে-দুঃখে পাশে না দাঁড়িয়ে নির্বাচনকে উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নবিদ্ধ করা, গোপনে সরকার পতনের অলিগলির পথ খোঁজা আর দেশে-বিদেশে গোপন বৈঠক করা তাদের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে।’ বিএনপির গণতন্ত্র হচ্ছে– ‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম গণতন্ত্র নিয়ে বিএনপি সরকারের যেসব সমালোচনা করে এবং দেশের গণতন্ত্রের বিষয় যা যা বলে সব মিথ্যা অপবাদ। তাই সেসব কথা সরিয়ে রেখে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের প্রধান ভিত্তিমূল,‌ অবাধ-স্বচ্ছ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মান এসব নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কী বলে,‌ সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক।

সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রের পরিস্থিতি কেমন,‌ সেটা বোঝাবার জন্য অন্তত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সংস্থা বেশ কিছু সূচক বিশ্লেষণ করে সারা পৃথিবীর দেশগুলোকে মূল্যায়ন করে।

ফ্রিডম হাউজ-এর সর্বশেষ রিপোর্টে বাংলাদেশকে ‘আংশিক মুক্ত/স্বাধীনতার (পার্টলি ফ্রি) ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। এই রিপোর্টে যে দেশের স্কোর যত কম সেই দেশ তত বেশি মুক্ত/স্বাধীন। এই রিপোর্টে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় ৫, রাজনৈতিক অধিকারে ৫ এবং মানবাধিকারে ৫ করে পেয়ে বাংলাদেশ সর্বমোট ১৫ পয়েন্ট পেয়েছে। এই রিপোর্টে ভারতের স্কোর ৭, ভুটানের ১০.৫, নেপালের ১০.৫, শ্রীলংকার ১০.৫, আর গণতন্ত্র এবং আরও নানা ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের কাছে ধিকৃত দেশ পাকিস্তানের স্কোর আমাদের সমান, ১৫।

বিশ্বের গণতন্ত্রের পরিস্থিতি নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক প্রকাশ করে বিখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। মোট ৫টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই সূচক ঠিক করা হয়।

এগুলো হলো-

১. নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ।
২. সরকারের কার্যকারিতা।
৩. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ।
৪. গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
৫. নাগরিক স্বাধীনতা। এই সংস্থার সর্বশেষ গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পূর্ণ গণতন্ত্র দূরেই থাকুক, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের তালিকায়ও নেই, আছে ‘হাইব্রিড রেজিম’-এর তালিকায়।

জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করা আরেকটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা এই তিনটি ব্রড হেডিংয়ের নিচে ৪৯টি সূচক নিয়ে তারা তাদের রিপোর্ট তৈরি করে। ‌২০১৮ সাল থেকেই বাংলাদেশ এই সংস্থার সূচকে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ দেশ।

২০১৮ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে এই তালিকায় ঢুকেছিল লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া এবং উগান্ডা। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এই পাঁচটি দেশে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছিল না। এসব দেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনি ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয় রিপোর্টে।

বেরটেলসম্যান স্টিফটুং-এর ট্রান্সফর্মেশন ইনডেক্স (বিটিআই)-এর ২০২০ সালের রিপোর্টে ভারতের অবস্থান ৩৪, শ্রীলংকা ৩৮ আর রাজতন্ত্র থেকে এই তো সেদিন (২০০৭ সালে) গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করা শিশু গণতন্ত্র ভুটানের অবস্থান ৪৭। আর এই ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০।

বেরটেলসম্যান খুব যৌক্তিকভাবেই কোনও দেশের স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় ঢোকার পেছনে একমাত্র কারণ হিসেবে নির্দেশ করেছে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থাকে। একটা অবাধ-সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র না, কিন্তু তেমন একটি নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের একেবারে ভিত্তিমূল্য, যেটা না থাকলে গণতন্ত্রের কথা বলা ঠিক নয়।

‘আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছে’– কথাটি শুধু ওবায়দুল কাদেরই বলেছেন বা বলেন তা না, এটা ক্ষমতাসীন দলের খুব নিয়মিত একটি ‘প্রপাগান্ডা’। এই ক্ষেত্রেও বিএনপি কী বলছে, বিএনপির মহাসচিব কী বলছেন, কিংবা আমার মতো একজন বিএনপি কর্মী কী বলতে চায়, সরিয়ে রাখি সবকিছু।

২০১৪ সালে নানা কূটকৌশলে প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ সরকার গঠনের মতো সংসদীয় আসন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ব্যালট পেপারে একটিমাত্র সিল পড়ার আগেই। যা সংবিধানের ১১ (প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে) এবং ৬৫.২ (একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া...) অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন কেমন হয়েছে সেটা নিয়েও আমি নিজে কিছু না বলে বিদেশি কিছু নামি সংবাদপত্র এবং সংস্থার সংবাদ এবং বিশ্লেষণ-এর শিরোনাম উল্লেখ করছি-

1. ‘By hook, crook and ballot: Bangladesh’s prime minister wins a fourth term, in ruthless fashion’ (The Economist)
2.‘They Threaten Everyone’ Sheikh Hasina’s Landslide Win in Bangladesh Marred by Voter Suppression’ (Time)
3. ‘The kind of margin of victory – 96 percent – was a result one might expect in a place like North Korea, not a democratic nation such as Bangladesh' (Washington Post Opinion)
4. ‘Severe press freedom violations mar Bangladesh’s election’ (Reporters Without Borders)
5. ‘Bangladesh now one-party democracy’ (Observer Research Foundation Analysis)
6. Western powers call for probe into Bangladesh election irregularities, violence (Reuters)

আরেকটি আলোচিত বিষয় উল্লেখ করে নির্বাচনের আলোচনা শেষ করছি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণের কয়েকটি তথ্য আবার একটু দেখে নিই। ১০৩ আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল। ভোট পড়া ৯১ থেকে ৯৯ শতাংশ হিসাব করলে এটা অসংখ্য। ১২৮৫ কেন্দ্রে কোনও ভোট পায়নি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতীক ধানের শীষ। অন্যদিকে ৫৮৭ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পেয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। এসবের সাথে ধানের শীষের প্রাপ্ত মোট ভোট, আসন সংখ্যা সবকিছু যদি মিলিয়ে নিই তাহলে উপরে উল্লেখিত ওয়াশিংটন পোস্টের শিরোনাম আমাদের বিন্দুমাত্রও অবাক করবে না।

একটা দেশ ন্যূনতম গণতান্ত্রিকভাবে চলছে নাকি চলছে না, সেটা খুব উঁচু গলায় বলার দরকার হয় না। একটা গণতান্ত্রিক দেশের নানা লক্ষণ থাকে। তেমনি লক্ষণ থাকে কর্তৃত্বপরায়ণ দেশেরও। ক্রমাগত জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়া, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা নিয়ে কথা বলে দেখানোই যায় ‘মুখে শেখ ফরিদ’ কিন্তু সরকারের যাবতীয় সব আচরণকে ভিত্তি করে তৈরি হওয়া বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য নানা সূচক আমাদের কাছে প্রকাশ করে ক্ষমতাসীন দলটিরই ‘বগলে ইট’। বলা বাহুল্য, ইটের সংখ্যা অগণিত।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ