X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা ও সংস্কৃতি

মুহাম্মাদ জাকারিয়া
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০০:৪৪আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০৪:৫১

ভাষা ও সংস্কৃতি ১৯৯৭ সালের কথা। আমি তখন স্কুলছাত্র। একুশে ফেব্রুয়ারির রাতে একুশের গ্রন্থমেলা থেকে বই কিনে চাচাতো বোনকে জন্মদিনের উপহার দেওয়ার জন্য শান্তিনগর যাচ্ছিলাম আব্বুর সঙ্গে। ওদের বাসার সামনেই উচ্চ শব্দে হিন্দি গান শুনে আমার মনে অনেক ক্ষোভ জন্মেছিল সেদিন। এই ক্ষোভ শুধু আমার ভাষাকে অপমানের জন্য ছিল না, ছিল আমার সংস্কৃতিকে অপমান করার জন্যও।
গতবছর ফেব্রুয়ারিতে দুটি পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধাভাজন দুজন শিক্ষকের কিছু লেখা পড়ে, এই বিষয়ে একটি পর্যালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার ‘সবার আগে চাই একটি ভাষানীতি’ শিরোনামে একটি পত্রিকায় এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য ‘বাংলা ভাষার প্রকৃত সমস্যা ও এর প্রকৃত সমাধান’ ও ‘ভাষাদূষণ একটি নাগরিক কুসংস্কার’ শিরোনামে অন্য আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে গত ফেব্রুয়ারি মাসেই বিখ্যাত সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক পিটার ট্রাডগিলের সঙ্গে ঠিক একই বিষয় নিয়ে আমার কথা হয়। নানিয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ট্রাডগিল ভাষার ওপর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রভাব এবং প্রাগৈতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নে ইউনিফরমিটেরিয়ান হাইপোথিসিস নিয়ে চমৎকার দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আমার এই লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রকাশিত প্রবন্ধ ও ট্রাডগিলের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।
শিশির ভট্টাচার্যের ‘বাংলা ভাষার প্রকৃত সমস্যা ও এর প্রকৃত সমাধান’ শিরোনামের প্রবন্ধ দেখে সাধারণ মানুষের কাছে একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে এই ভেবে যে ‘আমাদের বাংলা ভাষায় সমস্যা আছে।’ ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে আমরা জানি যে, ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে একটি ভাষা আরেকটির চেয়ে শ্রেয় নয় বা ভাষার কোনও সমস্যা থাকে না। শিশির ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটি পড়লে বোঝা যায়, তিনি আসলে বাংলা যে একটি সমস্যাযুক্ত ভাষা, সেটা বোঝাতে চাননি। সমস্যা যে জায়গায় বা যেই বিষয়ে সেটা হচ্ছে ভাষা পরিকল্পনা এবং ভাষা উন্নয়নে। তিনি তার প্রবন্ধে এফএম রেডিওর ‘বাংরেজি’ উচ্চারণের পক্ষে কিছুটা সাফাই গেয়েছেন। ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে এর ব্যাখ্যাও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যে জিনিসটা তিনি আড়াল করে গেছেন বা আলোচনা করেননি, সেটা হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক। একজন ভাষাবিদ হিসেবে স্যাপির-হোরফ হাইপোথিসিস এর কথা তিনি নিশ্চয়ই জানেন। সেটার ওপর বিশ্বাস থাকা‑না থাকা তার নিজস্ব ব্যাপার, কিন্তু এটা সবার কাছেই বোধগম্য যে, ভাষা ও সংস্কৃতি একটি আরেকটির সঙ্গে অপরিহার্যভাবে সম্পর্কিত এবং একটি আরেকটির ওপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
আমার এক বন্ধুর স্ত্রী সিলেটে বড় হয়েছেন। তার সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা, তিনি তখন এফএম রেডিওর অনুকরণে ‘বাংরেজি’ স্টাইলে কথা বলছিলেন দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। তার কাছে শুদ্ধভাবে বাংলা বলা হচ্ছে ‘বাংরেজি’ স্টাইলে কথা বলা। শিশির ভট্টাচার্য বলেছেন, এফএম রেডিও শুনে মানুষ ভাষা শেখে না। তার অন্য প্রবন্ধে তিনি ইংরেজি-ফরাসি ভাষার উদাহরণ টেনেছেন। যেটা তিনি বলেননি, সেটা হচ্ছে ইংরেজি-ফরাসি ভাষার পরিকল্পিত নীতি রয়েছে; যার একটি উদাহরণ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে ইংরেজি-ফরাসি ভাষার বাণিজ্যিক ভাষাশিক্ষা কার্যক্রম। একটির জায়গায় দু-তিনটি ভাষা শেখা অবশ্যই ভালো, তাতে কারও মনে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়, কিন্তু যে ভাষার উন্নয়নে কোনও পরিকল্পনা নেই, সেই ভাষা যদি ইংরেজির স্টাইলে এফএম রেডিগুলোতে দীর্ঘ সময় (অধ্যাপক সৌরভ সিকদার তার প্রবন্ধে বলেছেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টা) প্রচারিত হয় এবং একটি বিশেষ সমাজের স্থানীয় ভাষায় নাটক, আলোচনা, ইত্যাদি প্রচারিত হয়, তাহলে প্রমিত বাংলা বলতে বিশেষ উপভাষার অঞ্চলের মানুষ ‘বাংরেজি’ স্টাইলকেই অথবা একটি বিশেষ সমাজের স্থানীয় ভাষাকেই অনুসরণ করবে।

অধ্যাপক ট্রাডগিল তার ‘ভাষার ওপর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রভাব’ প্রবন্ধে বলেছেন যে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কারণে হয়তো অন্য ভাষার শব্দের ব্যাপ্তি ঘটতে পারে, কিন্তু ধ্বনির ব্যাপ্তি ঘটা অস্বাভাবিক। কারণ, ধ্বনির ব্যাপ্তির জন্য পরস্পরমুখী মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজন। কিন্তু এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে ভাষার সঙ্গে-সঙ্গে সাংস্কৃতিক কোনও আগ্রাসন ঘটছে কি না, তাও পর্যালোচনা করা। দিনকে দিন যেভাবে এফএম রেডিও এবং স্যাটেলাইটের কল্যাণে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষের মনোভাব পরিবর্তিত হচ্ছে, তা আশঙ্কাজনক বৈকি! যখন আমরা হিন্দি ও ইংরেজিকে বাংলার চেয়ে শ্রেয়তর ভাষা হিসেবে মেনে নেব  বিভিন্ন মাধ্যমের কল্যাণে, তখনই ঘটবে সংস্কৃতির আগ্রাসন এবং তাতে ঘটবে যত বিপত্তি। আমরা তখন আমাদের পরিচয় খুঁজে বেড়াব (প্রক্রিয়াটি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে)।

দুটি প্রবন্ধেরই শেষে শিশির ভট্টাচার্য কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন। সেগুলোর মধ্যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রমিত বাংলা ভাষায় শিক্ষা প্রদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে আমি আরও দুটি বিষয়ে যোগ করতে চাই- ১. উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় প্রকাশিত বই ব্যবহার করা (বাংলায় বই না থাকলে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করা) এবং বইগুলোতে বিষয়ভিত্তিক বাংলা পরিভাষার সৃষ্টি করা। যেন স্কুলে পড়া পরিভাষার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পরিভাষার ব্যাপক গরমিলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞান আহরণে বাধা সৃষ্টি না হয়।  ২. বাংলা ভাষা প্রচারে যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

অধ্যাপক সৌরভ সিকদার তার প্রবন্ধে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের এক মাসের ভালোবাসা এবং এর সঙ্গে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার আগ্রাসন সম্পর্কে বলেছেন। তার প্রবন্ধটিতে তিনি বাংলার চেয়ে ইংরেজি ও হিন্দি কিভাবে আমাদের কাছে মর্যাদার ভাষা হয়ে উঠছে, তাও উল্লেখ করেছেন। শিশির ভট্টাচার্য যে জিনিসটি আলোচনা করেননি, সেটি হচ্ছে ভাষা এবং সংস্কৃতির সম্পর্ক, যা অধ্যাপক সৌরভ সিকদারের লেখায় উঠে এসেছে। একুশ শতকের প্রেক্ষাপটে বাংলার ওপর ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার (তথা সংস্কৃতির ওপরে; ইংরেজি থেকে শব্দঋণ অনেকটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কারণ নতুন নতুন আবিষ্কার এর কারণে প্রচুর নতুন শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে, হিন্দিও বাংলার মতো ইংরেজি থেকে অনেক শব্দ ধার করে, কিন্তু যেখানে বাংলা ও হিন্দির উৎপত্তি একই স্থান থেকে এবং শব্দের রূপ বহুক্ষেত্রে প্রায় একই, সেখানে হিন্দি থেকে শব্দের ঋণ বাংলা ভাষার ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের একটি গতিশীল নিয়ামক) প্রভাব ঠেকাতে হয়তো বেগ পেতে হবে, তবে তা অসম্ভব কিছু নয়।

তবে, ভাষার পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, ভাষা ও সংস্কৃতি একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই বাংলার মতো একটি ভাষার উন্নয়নে এবং রক্ষণাবেক্ষণে যদি ভাষানীতি না থাকে, তাহলে প্রতিবেশী সংস্কৃতি ও ভাষার আগ্রাসনে বাংলা ভাষার বিলুপ্তি ঘটা অবাস্তব কোনও বিষয় নয়।

লেখক: ভাষা গবেষক, ভাষাবিজ্ঞান ও বহুভাষী অধ্যয়ন বিভাগ, নানিয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিঙ্গাপুর।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরু অথবা মাংস আমদানির বিকল্প কী?
গরু অথবা মাংস আমদানির বিকল্প কী?
ক্রিমিয়ায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের
ক্রিমিয়ায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের
প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী
প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী
গরমে হাসপাতালে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী
গরমে হাসপাতালে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ