X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাহফুজ আনামের ভুল স্বীকারের মামলা এবং...

শহিদুল আজম
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১১:৫৫আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১২:০০

শহিদুল আজমএখন পটকা মাছ খেয়ে প্রাণহানির খবর আসে না অনেকদিন। এর মানে কী? বিষক্রিয়া কমে গেছে? নাকি জেলেরা পটকা মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন? নাকি বাজার থেকে কেউ পটকা মাছ আর কিনে খাচ্ছে না? প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্ত্ত উত্তর নেই। কে দেবেন? ছোট বেলায় পত্রিকায় অনেকবারই পটকা মাছ খেয়ে মৃত্যুর খবর দেখেছি। কখনও কখনও অনেকদিন ধরে লাগাতার শিরোণামই হতো এগুলো। আজ এ এলাকায় মানুষ মরেছে তো, কাল মরেছে ওই এলাকায়। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! যেমন হুট করেই শিরোনাম। আবার তেমনি হুট আবার গায়েব। কোনও আলোচনাও নেই। মরা পটকা মাছের মুখে মুখ লাগিয়ে বাতাস ভরে এর পেট ফুটাতেও দেখেছি অনেককে। কিন্তু কাউকে কখনওই অসুস্থ হতে দেখিনি। অথচ পটকা মাছের খবর কী না কখনও কখনও সংবাদপত্রে অনেকটা জায়গা জুড়ে। আর এ নিয়ে কত হই-চই। হুজুগ নিয়ে যখন কোনও আলোচনা হয়, কেন জানি আমার সামনে পটকা মাছের উদাহরণটাই সামনে চলে আসে। ১৬ কোটি মানুষের দেশ। বিষয়ের যেমন শেষ নেই। তেমনি খবরেরও কমতি নেই। কিন্তু হুজুগ ওঠে মাঝে মাঝে মাঝেই। একটি বিতর্কের মধ্যেই হাজির আরেকটি বিষয়। ব্যস, চাপা পড়ে যায় পুরনোটি। পুলিশের নির্যাতন, এটিএম বুথের টাকা লুটসহ আরও কত বিষয় নিয়ে এ মুহূর্তে সরব আলোচনা হতে পারতো।           

আলোচনায় উঠে আসতে পারতো যুব ক্রিকেটারদের পারফরমেন্স কিংবা এসএ গেমসের অর্জনও। আওয়ামী লীগ, বিএনপির কাউন্সিল, ইউপি নির্বাচন নিয়েও ঝড় উঠতে পারতো চায়ের কাপে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়েই আলোচনায় ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। শুধুই কি হুজুগের সংস্কৃতি বজায় রাখতে? প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলায় তার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে। সমনও জারি হচ্ছে কোথাও কোথাও। যেন এই মুহূর্তে দেশ ও জাতির একমাত্র সমস্যা তিনিই। অথচ তার বিরুদ্ধে মামলার কারণ, একটি ভুল স্বীকার। যা তিনি নিজেই করেছেন। বলেছেন, ১/১১ এর সময় ডিজিএফআইয়ের দেওয়া সংবাদ যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। সম্পাদক হিসেবে এটি ছিলো তার বড় ভুল। এটিএন নিউজের জনপ্রিয় টকশো নিউজ আওয়ার এক্সট্রায় সঞ্চালক মুন্নী সাহার প্রশ্নে একথা উচ্চারণ করেছেন তিনি। আর এরপরই ‘পেয়েছি’ ‘পেয়েছি’ বলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এটিই একমাত্র দোষ, এর কারণে দেশজুড়ে এতো মামলা!
সংক্ষুব্ধ যে কেউ আদালতে যেতে পারেন। এটা তার অধিকার। যারা মামলা করেছেন, তারা সংক্ষুব্ধ হতে পারেন কী না, কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞায় পড়ে কীনা, এ নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সেটি বিবেচনার এখতিয়ার অবশ্য আদালতের।
আদালত প্রয়োজনীয় সময়ে সেটি বিবেচনায় নেবেন। তবে জেলায় জেলায় মামলা দায়ের যে হয়রানির জন্যেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।  এমন মামলা করার সংস্কৃতি রাজনীতিবিদদের সৃষ্ট। ক্ষমতাসীনরা বরাবর এমন অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকেন বিরোধী পক্ষের ওপর। আর তাই ক্ষমতায় গেলে বিরোধীদের প্রথম কাজ হয় এ সব মামলা থেকে নিজেদের নাম কাটার ব্যবস্থা করা। বিএনপি সরকার হয়রানির উদ্দেশে মামলা করেছিলো এমন অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের কমবেশি সব নেতাই বিভিন্ন মামলায় নিজেদেরকে মুক্ত করে ফেলেছেন। ডেইলি স্টার সম্পাদক ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ নন। তার সে সুযোগ হয়তো নেই। কিন্তু এ ধরণের মামলা দেশের ইমেজ বাড়াচ্ছে কতটা?
বিশ্ব মিডিয়ায় এমনিতেই বাংলাদেশের ভালো খবর আসে কম। আর এমন মামলার খবর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে দেশের বাইরে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়। নানা সূচকে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়। অথচ, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কম সুবিধা ভোগ করছে না। বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে রিপোর্ট প্রকাশের পর সাংবাদিকদের পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়।
১/১১ অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করলেও সে সময়ও প্রতিবাদের সুযোগ ছিলো।। ডেইলি স্টার সম্পাদকের যে আত্মস্বীকৃতি নিয়ে এতো তোলপাড়, সেখানে আরেকটি সত্যও উচ্চারিত হয়েছে। তিনি নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবিরের প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, আমরা সবাই ছেপেছি। কেবল নুরুল কবির ছাপেননি। এর মানেই হলো, নুরুল কবির টলে যাননি। ডেইলি স্টার সম্পাদকের ভুল স্বীকার নিয়ে সমালোচনা হলে নুরুল কবিরের এই দৃঢ়তা নিয়ে কেন আলোচনা হবে না?  সংসদে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার সময় ভীষন উৎসাহিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সাংসদরা  বুঝি মুদ্রার ‘এ পিঠ, ও পিঠ’ নিয়েও কথা বলবেন। নিজেরা যেহেতু ১/১১-র অভিজ্ঞতা নিয়েছেন সরাসরি, তাই ভবিষ্যতে এমন  পরিণতিতে না পড়ার ফর্মুলা বাতলাবেন। গণতান্ত্রিক পরিবেশেও তারা সে সাহস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। কাজেই এই তারাই যখন একজন সাংবাদিককে ভুল স্বীকারের পরও অভিযুক্ত করেন, তখন তাদের নৈতিকতাও প্রশ্নের মুখে পড়ে।

ইউটিউবের কল্যাণে রাজনীতিবিদদের দেওয়া সেই সব সাক্ষাৎকার কত মানুষ দেখছেন। তাদের  চেতনা, আদর্শও তাই প্রশ্নের কাঠগড়ায়। রাজনীতিবিদরা ভুল স্বীকার না করলে সে তথ্য উপাত্ত প্রকাশ, প্রচারে বাধা কোথায়। সব সময়, সব সরকারের আমলেই গণমাধ্যমকে নানা নির্দেশনা মানতে হয়েছে। গণমাধ্যমের আঁড়ি পাতার যন্ত্র নেই। শীর্ষ রাজনীতিবিদদের টেলিসংলাপ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রচার তো হয়েছে। জজ মিয়া নাটক যখন রচনা হয়, তখনও গণমাধ্যমকে এটি প্রকাশের দায় নিতে হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। তবে আগামী দিনগুলোতে গণমাধ্যম যাতে এমনই অবস্থায় আর না পড়ে, সেই ব্যবস্থাটি করতে হবে কিন্তু রাজনীতিবিদদেরই। আইনসভার সদস্যদের। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর অগণতান্ত্রিক শক্তির সাহস দেখানোর পথরুদ্ধ হয়েছে। রাজনীতিবিদরা চাইলে গণমাধ্যমের জন্যেও এমনই একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। তখন নুরুল কবিরদের মতো দৃঢ়চেতা সম্পাদক বাড়বেই।

আর সেকারণেই পটকা মাছের মতো হুট করে আলোচনায় আসা মাহফুজ আনামের বিষয়টির আলোচনার শেষ চাই না। একজন সাধারণ সংবাদকর্মী হিসেবে আমি জানতে চাই, স্বাভাবিক অথবা আস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনও সংস্থা টেপ পাঠিয়ে দিলে তা প্রচার বাধ্যতামূলক কীনা। সেই টেপে যদি রাজনীতিবিদদের ঘুমজড়ানো চোখ নিয়ে কোনও স্বীকারোক্তি দেন, সেটি প্রচার রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে কী না। এটা স্পষ্ট হওয়া খুবই দরকার। ডেইলি স্টার সম্পাদক এমনই একটি নির্দেশনা জারির সুযোগ করে দিয়েছেন, একটি ভুল স্বীকারের মধ্যে দিয়ে। সেজন্যে তিনি ধন্যবাদ প্রাপ্য। কার মাধ্যমে সরকারের বার্তা গণমাধ্যমে আসবে, সেটি স্পষ্ট করা না গেলে মাহফুজ আনামের মতো সম্পাদকীয় ভুল সিদ্ধান্ত সব সময়ই হবে।

১/১১-এর অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়তো গণমাধ্যমের সব নীতিনির্ধারকের পক্ষে নুরুল কবিরের মতো দৃঢ় অবস্থান নেওয়া যায়নি। কিন্তু সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার নাম যদি হয় সৎ সাংবাদিকতা, সেটি উর্ধ্বে তোলার জন্যে গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদেরও আড়মোরা ভাঙতেই হবে। নইলে  তাদের দায়সারাভাব ভবিষ্যতে নতুন আলোচনার জন্ম দেবে।

লেখক: এটিএন নিউজের এডিটর, ইনপুট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ