X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পান্তা-ইলিশ বনাম পান্তা-পিয়া

সালেক উদ্দিন
১৩ এপ্রিল ২০১৬, ১২:৫৮আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০১৬, ১৩:২৮

সালেক উদ্দিন বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে 'পান্তা-ইলিশ' একটি নব্য এবং ক্ষতিকারক সংস্করণ। এই 'পান্তা-ইলিশ'- এর জন্যে জেলেরা ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে (ডিম পাড়ার সময়ে) বড়বড় ইলিশ ধরে হিমাগারে রাখে এবং তিন চার মাস পরে চৈত্রের শেষে তা আকাশচুম্বী দরে 'পান্তা-ইলিশ' প্রেমীদের কাছে বিক্রি করে।
প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের আগ দিয়েই শোনা যায় বাজারে ইলিশ মাছের দর অস্বাভাবিক। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম দুই হাজার টাকা, দুই কেজি হলে চার পাঁচ হাজার, এর চেয়ে বড় হলে তো দশ হাজারের নিচে কথায় বলা যায় না । এ বছরও তার ব্যতিক্রম নেই। বেশ কিছু জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতার উল্লেখযোগ্য খবরের মধ্যে এবারও স্থান করতে পেরেছে 'ইলিশে আগুন'। আবার সেই আগুন যুদ্ধ জয়ের খবরও রয়েছে দৈনিকের পাতায় পাতায় । কোন এক মাছ বিক্রেতার বরাত দিয়ে একটি দৈনিকের বিশেষ খবর হলো, নববর্ষের জন্য তার কাছে দশ হাজার টাকা মূল্যের ইলিশ মাছের প্রচুর আগ্রিম অর্ডার রয়েছে। অন্যান্য বারের মতো এবারও তার মাছের ব্যবসা বেশ রমরমা।
দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্যতা যেমন দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি করে, তেমনি মাত্রাতিরিক্ত  চাহিদাও মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। এই সময়ে ইলিশের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই দুটি কারণই কাজ করে। সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাস ইলিশ মাছের ডিম পাড়ার সময় ।ইলিশ মাছেরা দল বেঁধে থাকে। এসময়ে সমুদ্রের গভীরে বসবাস করা ইলিশেরা দেশের বড়বড় নদীতে ডিম পাড়তে আসে। মা ইলিশ যেন মারা না পড়ে সেই লক্ষে কিছুদিন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখার সরকারি নিয়ম রয়েছে। এরপর মার্চ –এপ্রিলে জাটকা ইলিশের বড় হওয়ার সময় বলেও এসময় জাটকা না ধরার জন্য সরকারি নির্দেশ আছে। আর এই সময়টাতেই আসে বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখ। আসে পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের আধুনিক সংস্করণ হলো- 'পান্তা ইলিশ'। এই আধুনিক সংস্করণকে অপসংস্করণ বলবো এ কারণেই যে, বহুকাল ধরেই গ্রাম বাংলায় নববর্ষের যে উৎসব হতো তাতে 'পান্তা ইলিশ'-এর কোনও অস্তিত্ব ছিল না ।

আরও পড়তে পারেন: চেহারায় ইলিশ, আসলে ইলিশ নয়
সকল দুঃখ-গ্লানি ও জরা মুছে ফেলে পুরানো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করার লক্ষেই শতশত বছর ধরে বাঙালি জাতি উদযাপন করে আসছে অসাম্প্রদায়িক বাংলা নববর্ষ উৎসব। এই সব উৎসবে দেশের সকল ধর্মের মানুষই অংশগ্রহণ করে থাকে। একসময় নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ সকালে মরিচ-পেয়াজ দিয়ে ঢেঁকি ছাঁটা মোটা চালের পান্তা ভাত খেয়ে দিন শুরু করতো বাঙালিরা। রান্না করা হতো শতপদের শাঁকসব্জি। খাবারের সঙ্গে থাকতো বিভিন্ন ফলমূলের আয়োজন। তারপর সারা মাস ধরে চলতো  বৈশাখী মেলা। গ্রামীণ ব্যবসায়ীরা কদমা, বাতাসা, খই, মুড়কি, নাড়ু ইত্যাদি বিক্রি করত বৈশাখী মেলায়, বিক্রি করতো হাতপাখা, খেলনা হাতি, একতারা, ডুগডুগি, ঢোল ইত্যাদি। উৎসবমুখর ঘরোয়া আমেজ ছিল মেলাতে। বিনোদনের জন্য মেলায় বৌ-নাচুনি, পুতুল নাচ, চরকা ঘুরানো সহ নানাবিধ আয়োজন থাকতো। এই দিন মানুষেরা নতুন কাপড় পড়তো। আনন্দ উল্লাসে সময় কাটাতো এবং প্রার্থনা করতো সারা বছর যেন এমনই আনন্দঘন থাকে।
এই উৎসবের সঙ্গে 'পান্তা ইলিশ'-এর কোনও সম্পর্ক প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে কোথাও দেখা যায় না। ডঃ মুহাম্মদ শাহিদুল্লাহ, নীহার রায় সহ বিভিন্ন পণ্ডিতগণ প্রাচীন বাংলার নববর্ষ নিয়ে অনেকই তো লিখেছেন। তাদের লেখায় নববর্ষের অনুষ্ঠানমালার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে 'পান্তা –ইলিশের' কোনও অস্তিত্ব নেই। হালখাতা আছে, বৈশাখী মেলা আছে। আছে বউনাচুনি আর পুতুল নাচের কথা এবং মিষ্টি-মণ্ডা বিতরণের বর্ণনা । তাদের লেখা থেকে এমনকি আমাদের দেখা থেকেও বলা যায়, আমাদের ঐতিহ্য ছিল- চৈত্রের গরমে জীবন যাত্রায় প্রাণের ছোঁয়া ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে শীতল পানির জন্যে প্রার্থনা উৎসব।  এ ক্ষেত্রে গ্রামের ছেলেরা বাড়ির শুকনো উঠানে পানি ঢেলে  গড়াগড়ি করতো এবং  বৃষ্টি চেয়ে গান গাইত ।

 

আরও পড়তে পারেন: পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাবেন না প্রধানমন্ত্রী


আশির দশক থেকে শহরের বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মানুষেরা পহেলা বৈশাখের গ্রামীণ পান্তার আধুনিক সংস্করণ করেছেন 'পান্তা-ইলিশ'- যাকে একধরনের বিলাসিতা বলা যেতে পারে। সহস্রাধিক টাকা দাম হলেও ইলিশ যেন কিনতেই হবে। ইলিশ কিনতে না পারলে মহল্লায় মুখ দেখাতে আজকাল মানুষ লজ্জা পায় ।
চৈত্রের একেবারে শেষলগ্নে এই প্রতিবেদনটি লেখার সময়ে কাকতালীয়ভাবে আমার এক বড় সাইজের আমলা বন্ধু ফোনে জানালো এইমাত্র সে একলক্ষ টাকার ইলিশ কিনলো। আমি বললাম, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। মনে মনে ভাবলাম তাদের এই বিলাসিতার কারণে মারা পড়ছে ডিম ভরা মা ইলিশ, বেড়ে উঠতে পারছে না জাটকা।
বৈশাখের 'পান্তা ইলিশ'কে বাঙালি পান্তার চরম ভূল সংস্করণ বলে আখ্যায়িত করলে মোটেই ভূল হবে না । বরং জাতীয় মাছ ইলিশকে রক্ষা করার জন্যে বৈশাখে 'পান্তা-ইলিশ' দণ্ডনীয় করা উচিৎ ।

এই নববর্ষ উপলক্ষে যতগুলো ডিমভরা ইলিশ নিধন করা হবে, মারা পড়বে  যতশত জাটকা ইলিশ তা রোধ করা গেলে জাতীয় মাছ ইলিশের বংশবিস্তার ও সহজলোভ্যতা বহুগুণ বেড়ে যেত ।
ইলিশ রক্ষার জন্য আমাদের আরও সচেতন হওয়া উচিত। সরকারিভাবে গ্রহণ করা উচিৎ কঠিন পদক্ষেপ । বছরের যে সময়ে ইলিশ ধরা নিষেধ করা হয়েছে সে সময়ে ইলিশ ধরলে জেলেদের জন্য যেমন দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির বিধান রাখা উচিৎ তেমনি ওই সময় কেউ ইলিশ বিক্রি করলে বা কিনলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই শাস্তির বিধান থাকা উচিত। আবার শুধু বিধান থাকলেই হবে না, বিধান এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে । এতে ইলিশ রক্ষা পেলেও পেতে পারে ।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, মাছে-ভাতে বাঙালি বৈশাখেই মাছ খাবে না সেটা কেমন কথা?

আরও পড়তে পারেন:  উৎসবের কোনও লিঙ্গ হয় না!

 


প্রশ্নতো উল্টোভাবেও হতে পারে। বলা যেতে পারে, পান্তার সঙ্গে মাছ খেতে চাইলে অসময়ের ইলিশ মাছই যে খেতে হবে- সেটাই বা কেমন কথা? রুই কাতলে অসুবিধা কোথায়? এসময়ের সবচেয়ে সহজলভ্য মাছ তেলাপিয়াই বা কী দোষ করলো?
এ প্রসঙ্গে কোয়ান্টাম ম্যাথডের প্রবর্তক শহীদ আল বখারী মহাজাতকের উদাহরণ টানা যেতে পারে। তিনিও মাছে ভাতে বাঙালিতে বিশ্বাসী। তবে নববর্ষে 'পান্তা  ইলিশের' পরিবর্তে তিনি বহু আগেই প্রবর্তন করেছেন 'পান্তা-পিয়া' (পান্তার সঙ্গে তেলাপিয়া)। সারাদেশে যে লাখ লাখ কোয়ান্টাম অনুসারি রয়েছেন তারা 'পান্তা-পিয়া' দিয়ে নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। শুধু তাই নয়, কোয়ান্টাম অনুসারিরা ইলিশের বংশ বৃদ্ধির লক্ষে বৈশাখে ইলিশ খান না। কী চমৎকার সচেতনতা! কী মহান প্রবনতা! স্বীকার করছি কোয়ান্টামের ভিশনই সৃষ্টির কল্যাণ। সম্ভবত একারণেই তারা পেরেছে।
মানুষের ভিশনও তো ওই একটাই- সৃষ্টির কল্যাণ। তাহলে আমরা সচেতন মানুষেরা যে কতটা অসচেতন তা কি ভেবে দেখার সময় এসেছে?
অকল্যাণকর কোনও কিছুই সংস্কৃতিতে স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। বৈশাখে ইলিশ নিধন যেহেতু কল্যাণকর নয় সেহেতু আগামী নববর্ষের অনুষ্ঠানে 'পান্তা-ইলিশ' বন্ধ হওয়ার প্রত্যাশা করতেই পারি।
মাছে ভাতে বাঙালির যদি বৈশাখে পান্তায় মাছ খেতেই হয় তবে আর 'পান্তা-ইলিশ' নয়। শুরু হোক 'পান্তা-পিয়া'র যাত্রা ।

লেখক-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
‘বিএনপি যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে’
ফেসবুকে নিজের সমালোচনা দেখে হাসি পায় সাকিবের
ফেসবুকে নিজের সমালোচনা দেখে হাসি পায় সাকিবের
উপজেলা নির্বাচনে পলকের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হাইকোর্টে রিট
উপজেলা নির্বাচনে পলকের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হাইকোর্টে রিট
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ