X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

পাথরঘাটা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের যত অপকর্ম

বরগুনা প্রতিনিধি
২১ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:৪১আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:০৫

চার ছাত্রলীগ নেতা বাঁ থেকে দানিয়েল, সাদ্দাম, মাহমুদ ও রায়হান বরগুনার পাথরঘাটা কলেজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আদনান দানিয়েল ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে আটক হওয়ার পর তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর পরই একে একে প্রকাশ হতে থাকে তাদের নানা অপকর্ম।

কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানান, কলেজে ভর্তি, বিভিন্ন শ্রেণির পরীক্ষা, ফল প্রকাশ এমনকি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের চলাচলও ছিল কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিয়ন্ত্রণে। শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করাও ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। বিশেষ করে, ছাত্রীদের সঙ্গে নানা অপকর্মের কারণে এই দুই নেতা কলেজের ছাত্রীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। স্বেচ্ছায় রক্তদানের একটি সংগঠনের নামে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অনেকগুলো ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। কলেজেই ছিল তাদের মাদক সেবন ও বিক্রয় কেন্দ্র। তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে কলেজের সবাই এক রকম জিম্মি হয়ে ছিল। 

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে এমন বেপরোয়া হয়েছে উঠেছিল তারা।

শুধু শিক্ষার্থীই নয়, শিক্ষকদের ওপর এই নেতারা ছড়ি ঘোরাত। ভর্তি, পরীক্ষার হলে দায়িত্বপালন, রেজাল্ট প্রকাশ এমনকি ক্লাস চালাতে পর্যন্ত এদের কথা মানতে হতো শিক্ষকদের। এ বিষয়ে একাধিক শিক্ষক বলেন, চাকরি করতে এসে নিজেদের মান-সম্মান বাঁচানো নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। কারণ, এই চক্রটি কোন সময় কাকে লাঞ্ছিত করে সেই ভয়ে ভয়ে কলেজে আসতাম আমরা।

হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. মিলন মিয়া জানান, এই অভিযুক্ত ছাত্রনেতারা তাদের মতের বাইরে কিছু হলেই শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করতো। এমনকি শ্রেণিকক্ষে ঢুকে আমাকেও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল তারা। সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সামসুল আলম বলেন,গত আগস্ট মাসে আমি পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত ছিলাম। এ সময় দানিয়েল ও সাদ্দামসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা পরীক্ষার হলে কড়া গার্ড দিচ্ছি বলে ক্লাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের সামনেই আমাকে গালিগালাজ করে। ক্লাস চলাকালীন এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় এক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে রায়হান।

রসায়ন বিজ্ঞানের ক্লাস চলাকালে শিক্ষার্থীদের মিছিলে নিয়ে যেতে চাইলে বাধা দিয়েছিলেন শিক্ষক অমল চন্দ্র নন্দী। পরে ওই নেতারা এসে তাকে লাঞ্ছিত করে। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক জাকির হোসনকে কলেজে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ওই নেতাদের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সাংবদিকদের বলেন, ‘গত পাঁচ বছর ধরে কলেজে দানিয়াল, সাদ্দাম ও তাদের সহযোগীদের কর্মকাণ্ডে শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীরা সবসময় আতঙ্কে ছিলেন। তারা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় কলেজে নানা অপকর্ম চালিয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সময় শিক্ষকরাও তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। নারীঘটিত ব্যাপারে কলেজে তাদের খুবই বদনাম ছিল। অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে গিয়েও দলীয় নেতাদের চাপে দানিয়াল ও সাদ্দামের কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চাইতে হয়েছে। এ কারণে কলেজের শিক্ষকদের মুখ বন্ধ করে তাদের অন্যায় অত্যাচার মেনে নিতে হয়েছে।’ এখন যে মামলায় তারা আটক হয়েছে, সে ঘটনায় তারা যদি সত্যিকার দোষী হয়ে থাকে তাহলে তাদের বিচার দাবিও করেন তিনি।

উপাধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘গ্রেফতার ছাত্রলীগ সভাপতি ও সম্পাদকের মুক্তির দাবিতে তাদের অনুসারীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিয়ে প্রতিবাদ মিছিল সমাবেশ করানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করে আসছিল। এ কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত হয়নি। এমনকি যারা উপস্থিত হয়েছে তারাও ভয়ে ক্লাস থেকে পালিয়ে গেছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কলেজের অধ্যয়নরত বেশ কয়েকজন ছাত্রী জানান, ‘রক্তের বন্ধন’ নামে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করত ওই দুই নেতা। সেখানে রক্ত দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন সময়ে মেয়েদের ডেকে নিয়ে যেত গোপন আস্তানায়। সেখানে তাদের বাধ্য করা হতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। কলেজে টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য ছাত্রীদের ফরম ফিলাপ করে দেওয়ার নাম করে ডেকে কলেজের চতুর্থ তলায় নিয়ে বাধ্য করা হতো অপকর্মে।  কলেজের ভর্তির পরপরই দানিয়েল ও সাদ্দাম নতুন ছাত্রীদের প্রেমের প্রস্তাব দিত। এতে রাজি না হলে উত্ত্যক্ত করা শুরু করত তারা। এমনকি পথেঘাটে হাত ধরে টানাটানি, মোবাইল ফোনে হুমকি ও টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে হাঁটলেও তাদের লাঞ্ছিত ও মারধর করা হতো।

অভিযোগ রয়েছে, এক শিক্ষার্থী প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে কলেজ মাঠে সবার সামনে চুমু দিয়েছিল দানিয়েল। কলেজ ছাত্রলীগের এক নেত্রীর মাধ্যমে কলেজের চতুর্থ তলায় পছন্দমতো সাধারণ ছাত্রীদের ডেকে নিয়ে যেত দানিয়েল। সেখানে তাদের যৌন হয়রানি করা হতো।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের আশীর্বাদে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হয় রুহি আনাল দানিয়েল। এর পরপরই বেপরোয়া হয়ে উঠে সে। পাথরঘাটা ৭নং ওয়ার্ডের সাত্তার মাস্টারের ছেলে দানিয়েল। তার ভাই মোফাসসের হোসেন বাবুল ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।

এসব অপকর্মে তার সহযোগী ছিল সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ছোট্ট ও সাংগঠনিক সম্পাদক মহিদুল ইসলাম রায়হান। বিশেষ করে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের উত্ত্যক্তকরণের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। পাথরঘাটা পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুস সালামের ছেলে সাদ্দাম। সে এই কলেজের ডিগ্রি চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র।

কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিদুল ইসলাম রায়হান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান নাদিম ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক আরিফুজ্জামান আল ইমরানের আপন ফুপাতো ভাই। রায়হান তাদের প্রভাব দেখিয়ে এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।

গ্রেফতার হওয়া অপর নেতা উপজেলা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মো. মাহমুদও নানা অপকর্মে জড়িত। পাথরঘাটা পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের মিজানুর রহমানের ছেলে মাহমুদ। প্রথমে হাফেজি পড়লে পরে তা ছেড়ে দিয়ে সে পাথরঘাটা ফাজিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। বর্তমানে ওই মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছে। মাহমুদ একজন মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, একাধিকবার মাদকসহ তাকে আটক করলেও পরে ‘বিশেষ’ ফোন পেয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।

এদিকে, রুহি আনাল দানিয়াল ও সাদ্দাম হোসেন ছোট্টকে প্রথম দফা দু’দিনের রিমান্ড শেষে গত ১৫ নভেম্বর তাদের ফের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

গত ১০ আগস্ট দুপুরে পাথরঘাটা কলেজের পশ্চিম পাশের পুকুর থেকে অজ্ঞাত এক তরুণীর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।  ঘটনার পর থেকে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে দীর্ঘসময় লেগে থাকে বরগুনা থানা পুলিশ। পরে তথ্য পেয়ে ১০ নভেম্বর পাথরঘাটা কলেজের নৈশপ্রহরী জাহাঙ্গীরকে গভীর রাতে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি পুলিশ। তার দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পরদিন রাতে ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদ ও রায়হানকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পাথরঘাটার আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয় কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি রুহি আনাল দানিয়েল ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ছোট্টকে। তবে এখন পর্যন্ত নিহত তরুণীর পরিচয় পাওয়া যায়নি।

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গাজায় বিধ্বস্ত বাড়ি-ঘর পুনর্নির্মাণে সময় লাগতে পারে ৮০ বছর
গাজায় বিধ্বস্ত বাড়ি-ঘর পুনর্নির্মাণে সময় লাগতে পারে ৮০ বছর
এমপি আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুতে শোক জানালো সংসদ
এমপি আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুতে শোক জানালো সংসদ
শিগগিরই শুরু হচ্ছে উন্মুক্ত কারাগার তৈরির কাজ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
শিগগিরই শুরু হচ্ছে উন্মুক্ত কারাগার তৈরির কাজ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
কোকাকোলার বোতল সরিয়ে আলোচনায় সিকান্দার রাজা
কোকাকোলার বোতল সরিয়ে আলোচনায় সিকান্দার রাজা
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে