X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

চাষিদের অসচেতনতায় চিংড়িতে মড়ক

আবুল হাসান, মোংলা
১৮ জুলাই ২০১৮, ২০:২৪আপডেট : ১৯ জুলাই ২০১৮, ০০:০৪

মরা চিংড়ি (ছবি- প্রতিনিধি)

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বাড়ায় এবং চাষিরা ঠিকমত পরিচর্যা না করায় বাগেরহাটের মোংলায় চিংড়িতে মড়ক (ভাইরাস)দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন,সারা বছরই লবণ পানি আটকে চিংড়ি চাষ করার ফলে ভাইরাসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় চিংড়ি মাছ। এক্ষেত্রে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও চাষিরা খুব একটা গ্রহণ করেন না। এছাড়া বিষ দিয়ে সুন্দরবনে মাছ শিকার এবং কীটনাশক ব্যবহারের পর সেই পানি চিংড়ি ঘেরে প্রবেশ করার কারণেও ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোংলাসহ আশপাশের এলাকায় বাগদা চিংড়ি চাষে সারা বছরই ভাইরাসের কারণে বিপর্যয় নেমে আসে। এ জন্য অধিকাংশ ঘেরে মাছ মরে যাওয়ায় এ অঞ্চলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে কম পরিমাণে।

মোংলা উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, লবণ পানি অধ্যুষিত মোংলাসহ আশপাশের এলাকায় প্রায় দুই যুগ ধরে ধানের পরিবর্তে বছরের প্রায় আট মাসই বাগদা চিংড়ির চাষ হয়ে আসছে। উপজেলার ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে ১০ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জমিতেই বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়ে থাকে। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৫৫০টি।

গত বছর বাগদা উৎপাদিত হয়েছিল চার হাজার ৪১ মেট্রিক টন। মড়কের কারণে এবারের উৎপাদন গতবারের অর্ধেক হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

উপকূলে মরা চিংড়ি (ছবি- প্রতিনিধি)

উপজেলার চাঁদপাই গ্রামের চিংড়ি চাষি মো. শাহ আলম জানান, ফেব্রুয়ারি মাসে ঘেরে পোনা মাছ ছাড়ার পর এপ্রিল মাস থেকে বিরতিহীনভাবে মাছ মরছে ‘হোয়াইট স্পট’ ভাইরাসের কারণে। ঘেরে মাছ মরে ভেসে উঠছে। ঘেরের ভেড়ির পাশে লালচে আকার ধারণ করে মরা মাছ পড়ে থাকছে। আবার যে পরিমাণ জীবিত মাছ পাওয়া যাচ্ছে তার অধিকাংশই দুর্বল। এগুলো নড়াচড়া করতে না পেরে মাটির সঙ্গে মিশে থাকছে। প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ঘেরই মাছশূন্য।

তিনি বলেন, ‘সরকার চিংড়ি রফতানি করে শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও চিংড়ি উৎপাদনকারীদের সমস্যা সমাধানে তেমন জোরালো পদক্ষেপ নেয় না। উপজেলা মৎস্য অফিসও চিংড়ি চাষিদের সচেতন করার জন্য কোনও পদক্ষেপ নেয় না।  এ পর্যন্ত কোনও ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়ি ঘেরে গিয়ে কী কারণে মাছ মারা যাচ্ছে বা কী করা উচিত— সে বিষয়ে তাদের কোনও দিকনির্দেশনা আমরা পাইনি। ফলে আমাদের একমাত্র জীবিকা চিংড়ি চাষ নিয়ে আমরা খুবই সমস্যার মধ্যে আছি।’

উপজেলার চিলা, আন্ধারিয়া, বুড়বুড়িয়া, জয়খা গ্রামের কয়েকজন ঘের ব্যবসায়ী জানান, গতবারের তুলনায় চিংড়ি পোনার দাম দ্বিগুণের বেশি। গতবার প্রতিটি পোনার মূল্য ৩০ পয়সা হলেও এবার সেই পোনা কিনতে ৭০ থেকে ৮০ পয়সা ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে ঘেরের ব্যয়ও দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাচ্ছে।

জেলেদের জালে চিংড়ি (ছবি- প্রতিনিধি)

মড়কের কারণে উপজেলার চিংড়ি উৎপাদন গতবারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক বলে দাবি করেছেন চিংড়ি চাষি ও ডিপো মালিকরা। উপজেলা চিংড়ি বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. নুরুল আফসার জানান, এবার মড়কের কারণে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কম। গতবারের তুলনায় মোংলার মাছের আড়তগুলোতে মাছের আনাগোনা প্রায় অর্ধেক।

মোংলা উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা লিয়াকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে বাগদা চিংড়ি মারা যায়। মৌসুমের শুরুতে ঘের প্রস্তুত করার সময় চাষিরা ঘেরের মাটির সঠিক পরিচর্যা করেন না। জমির ব্যাকটেরিয়া মারার জন্য যে পরিমাণ চুন ব্যবহার করার দরকার তাও ঠিকমতো করেন না। এ ছাড়াও নিয়মিত ফরমুলেটেড খাদ্য সরবরাহ না করা, পানি পরিবর্তন ও বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা না করার কারণেও মাছ মারা যাচ্ছে।’

চিংড়ি চাষিদের সচেতনতা তৈরিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাষিদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি ও সেমিনারের মাধ্যমে তাদের সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ কোনও এলাকায় মড়ক লাগার খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে ব্যবস্থা নেন বলেও তিনি দাবি  করেন।

চিংড়ি ঘের (ছবি- প্রতিনিধি)

পশুর নদীর ওয়াটার কিপার নুর আলম শেখ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় মোংলায় চিংড়িতে মড়ক (ভাইরাস)দেখা দেয়। তিনি বলেন, ‘সারা বছরই এই লবণ পানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষ করার ফলে নানবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিংড়িতে ভাইরাস দেখা দেয়। এছাড়া বিষ দিয়ে সুন্দরবনে মাছ শিকার এবং বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহারের পর সেই পানি চিংড়ি ঘেরে প্রবেশ করলেও ভাইরাস হয়।’

নদী ও চিংড়ি গবেষক নুর আলম বলেন,‘বছরের একটা সময় ঘের শুকিয়ে ফেলা উচিত। এছাড়া সুন্দরবনের খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ ঘেরের পানিতে কীটনাশক ব্যবহারও বন্ধ করতে হবে।’ মাছে ভাইরাস নির্মূল করতে চিংড়ি গবেষণাগার স্থাপন করে চাষীদের বিজ্ঞানসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের পরামর্শ দেন তিনি।

চিংড়িতে ভাইরাস নিয়ে গবেষণাকারী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নাজমুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিংড়িতে ভাইরাস ঠেকাতে নানা রকম উপায় আছে। আমাদের শরীরেও ভাইরাস আছে। তারপরও আমরা সতেচনভাবে চলি। এক্ষেত্রেও চাষীদের সতেচন হতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রথমত, চিংড়ির পোনার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রোগমুক্ত পোনা ঘেরে ছাড়তে হবে। এ জন্য সরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। তৃতীয়ত, ঘেরের গভীরতা দেখে মাটি পানি ও পরিবেশের ওপর নির্ভর করে ঘেরে উপযুক্ত চিংড়ি চাষ করতে হবে।’ এজন্য প্রান্তিক চাষিদের স্থানীয়ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলেও মত দেন তিনি।

 

 

/এইচআই/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তপ্ত রোদেও থামে না তাদের কাজ
আজ মহান মে দিবসতপ্ত রোদেও থামে না তাদের কাজ
মদ ছেড়ে বললেন, ‘মাইলফলক’
মদ ছেড়ে বললেন, ‘মাইলফলক’
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বৃহস্পতিবার
১০৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১৭৭ জনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন১০৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১৭৭ জনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার
সর্বাধিক পঠিত
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
আজকের আবহাওয়া: তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস
সাতক্ষীরার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড 
সাতক্ষীরার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড