পরপর দুটি কন্যা সন্তান। এরপর ছেলের জন্ম হলেও কয়েক মাস পর মৃত্যু হয়। চতুর্থবারের মতো সন্তান গর্ভে এলে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে মা আমেলা খাতুন জানতে পারেন এবারের সন্তানও মেয়ে। বিষয়টি সন্তানের বাবা আমিনুল জানতে পারলে শুরু হয় নানা কটূক্তিসহ মানসিক নির্যাতন। সোমবার সকালে আমেলার প্রসববেদনা শুরু হলে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি হন। সিজারের প্রস্তুতি চলছিল। এ সময় আমিনুলের সঙ্গে আমেলার আবারও ঝামেলা বাঁধে, কথা কাটাকাটি হয়। সন্তান ও নিজের জীবন হুমকিতে রয়েছে– এমন আশঙ্কায় তিনি ক্লিনিক থেকে সোজা রৌমারী থানায় উপস্থিত হন। নিজের ও অনাগত কন্যাসন্তানের জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে জানিয়ে ওসির কাছে সহায়তা চান। পরে পুলিশের সহায়তায় ঝামেলা মিটলে আমেলা শেরপুরের একটি ক্লিনিকে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।
আমেলার বরাতে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দেন রৌমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রূপ কুমার সরকার।
প্রসূতি আমেলা বেগম রৌমারী উপজেলার বন্দবেড় ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের দিনমজুর আমিনুল ইসলামের স্ত্রী। এই দম্পতির ঘরে ১১ ও ৯ বছর বয়সী দুটি মেয়েসন্তান রয়েছে। গতকাল রাতে তাদের আরও একটি মেয়েসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।
আমেলার অভিযোগ, আগের দুটি মেয়ে সন্তান হওয়ার পর আবারও গর্ভে মেয়ে সন্তান আসায় স্বামী আমিনুল নাখোশ ছিলেন। তাকে ও তার অনাগত সন্তানকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। এজন্য নিজের ও সন্তানের জীবন বাঁচাতে তিনি ক্লিনিক থেকে সোজা থানায় গিয়ে ওসির দ্বারস্থ হন। পরে পুলিশ তাদের সমস্যার সমাধান করে দেন।
আমেলা বলেন, ‘ঝামেলা ছিল। অহন মিইটা গেছে। অহন ভালা আছি।’
বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে আমেলার মা মোছেয়া খাতুন বলেন, ‘রাইতে আমেলার মেয়ে বাচ্চা হইছে। অহন মা মেয়ে ভালা আছে।’
তবে আমেলার এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তার স্বামী আমিনুল। তিনি বলেন, ‘ আপনারা খোঁজ নেন। তার মা’সহ ( আমেলার মা) আমি নিজে রৌমারীর নিরাময় ক্লিনিকে গিয়ে তাকে ভর্তি করাইছি। তার ভাইও ছিল। ব্লাডের দরকার ছিল, তাও জোগাড় করাইছি। সে বলে, ভালা মানুষ লাগবো। না হইলে অপারেশন করাইবো না। এই বইলা হঠাৎ সে ক্লিনিক থেকে উধাও হয়া যায়। ফোন দিলেও ধরে না। পরে বিকালে পুলিশ নিয়া ক্লিনিকে আহে।’
মেয়েসন্তানের জন্য স্ত্রী ও সন্তানের জীবন হুমকির প্রশ্নে আমিনুল বলেন, ‘এলাকায় খোঁজ নেন, আমি কেমন। মাইনষের পরিবারে ঝামেলা হইতে পারে না? আমার স্ত্রী-সন্তান আমি চিকিৎসা না করাইলে কে করাইবো! হেয় (আমেলা) হুদাই গিয়া পুলিশে খবর দিছে। তার মা সাথে ছিল তারেও জিগান।’
‘মেয়ে হওয়ার জন্য মায়ের দায় নাই। এটা ডাক্তার আমারে বুঝাইছে। ওসি স্যারও বুঝাইছে। আমি সেটা বুঝি। কিন্তু স্ত্রীকে কোনও হুমকি দেই নাই। তার কী সমস্যা, এলাকার মানুষরে জিগাইলে জানতে পারবেন।’ যোগ করেন আমিনুল।
পরে থানা থেকে ফিরে শেরপুরের একটি ক্লিনিকে সোমবার রাতে সিজারের মাধ্যমে তার স্ত্রী কন্যাসন্তান প্রসব করেন বলে জানান আমিনুল। তিনি তাদের সঙ্গে আছেন। স্ত্রী-সন্তান ভালো আছে বলেও জানান তিনি।
রৌমারীর নিরাময় হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্টাফ আরিফ হোসেন বলেন, ‘ ওই নারীর স্বামী, মা, ভাই ও স্থানীয় ইউপি সদস্য সহ কয়েকজন মিলে আমাদের এখানে এসেছিলেন। কিন্তু ওই নারী বলতেছিলেন যে ডাক্তার নাকি তাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলবে। এজন্য তিনি পরে পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। পরে শেরপুরের একটি ক্লিনিকে তার সিজার হয়েছে শুনেছি।’
বন্দবেড় ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য বিপ্লব হোসেন বলেন, ‘আমেলা আর আমিনুলের পারিবারিক সমস্যা নিয়ে অনেকবার সালিশ করেছি। আমেলার একটু মানসিক সমস্যা রয়েছে। তার নাকি সন্দেহ যে তাকে ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলবে। গতকাল আমি নিজেও ক্লিনিকে ছিলাম। তিনি যে অভিযোগ করেছেন তার কোনও ভিত্তি নাই।’
ওসি রূপ কুমার সরকার বলেন, ‘ওই নারী প্রসবকালীন নানা দুশ্চিতায় ভুগছিলেন। তার মনে হয়েছিল যে, তিনি যদি সিজারের সময় মারা যান তাহলে তার মেয়েকে স্বামী মেরে ফেলতে পারে। তার সমস্যার কথা জানার পর তার স্বামীকে ডেকে বুঝিয়েছি। মেয়েসন্তান জন্মের জন্য যে মা দায়ী নন তা তাকে ভালো করে বুঝিয়েছি। মেয়ে সন্তানের ধর্মীয় গুরুত্বের বিষয়টিও তাকে বলেছি। সে বুঝতে পেরে তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেছে। পরে তাদের মেয়েসন্তান হয়েছে। মা ও মেয়ে সবাই ভালো আছে বলে খবর পেয়েছি।’
