X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

অযত্নে পড়ে আছে বীরপ্রতীক ‌‘রকেট জলিলের’ কবর

তৌহিদ জামান, যশোর
০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:০০আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৩৭

যশোরের ঝিকরগাছার শিমুলিয়া ইউনিয়নের পাল্লা মোড়লপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে শায়িত আছেন বীরপ্রতীক মো. আব্দুল জলিল। যিনি রকেট জলিল নামে খ্যাত। অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে সাহসী এই যোদ্ধার কবর।

কবরটি বাঁশ দিয়ে ঘেরা; যার অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। কবর সংরক্ষণে কিংবা পাকাকরণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন তার স্ত্রী হালিমা বেগম, ছোটভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক মোড়লও।

তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর বাঁধানোর প্রকল্প পাস হয়ে আসছে। খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বীরপ্রতীক মো. আব্দুল জলিল ওরফে রকেট জলিল ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, একাত্তরের রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন আব্দুল জলিল। একাত্তরে একই দিনে তিনি ৪-৫ জায়গায় অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অল্প সময়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার কারণে পাকিস্তানি বাহিনী ওই সময় বলতো, ‘রকেট হ্যায়, না কিয়া হ্যায়’। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৬ সালে আব্দুল জলিলকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। জীবদ্দশায় এই প্রতিবেদককে আব্দুল জলিল বলেছেন, ‘রকেট জলিল আমার খেতাব।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন আব্দুল জলিল

ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের মনোরম একটি গ্রামের নাম পাল্লা। ১৯৪৬ সালে এই গ্রামের মহর আলী মোড়ল আর চেয়ারবানুর ঘরে জন্ম আব্দুল জলিলের। স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৬৩ সালে তিনি মুজাহিদ কোম্পানিতে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মুজাহিদ কোম্পানি থেকে কেউ সেনাবাহিনী, কেউ পুলিশ কিংবা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগ দেন। আব্দুল জলিল ১৯৬৮ সালে ইপিআরে যোগ দেন সিপাহি পদে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন ইপিআরের রাজশাহী অঞ্চলে কর্মরত এই সিপাহি। ২৮ মার্চ তিনিসহ চার জন চারটি রাইফেল নিয়ে রাজশাহী থেকে প্রথমে যশোর, এরপর একই দিনে বেনাপোল ক্যাম্পে গিয়ে যোগ দেন। রাতেই তাদের যশোরের চাঁচড়া ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি সরাসরি অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। ৮ নম্বর সেক্টরে মেজর (পরে মে. জেনারেল) এম আবুল মঞ্জুরের (বীর উত্তম) নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন। ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদার (বীর বিক্রম) তত্ত্বাবধানে ছিলেন আব্দুল জলিল। 

জুলাই মাসে ঝিকরগাছার গঙ্গাধরপুর-দোসতিনায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হন আব্দুল জলিল। গুলিটি বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে বিদ্ধ হয়। ওই সময় নিহত হয় চার পাকসেনা। পরে ভারতের বনগাঁ হাসপাতাল থেকে গুলি বের করে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় নৌপথে চলে আসেন। ভারতে একরাত ছিলেন। কারণ তার অনুপস্থিতিতে সঙ্গীরা হতাশ হয়ে পড়েন।

ঝিকরগাছার বনমান্দার এলাকায় দ্বীপের মতো একটা আস্তানায় ছিল রাধানগর ক্যাম্প। চারপাশে পানি, নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। অনেক অপারেশনে তিনি সরাসরি অংশ নেন।

আব্দুল জলিলের স্ত্রী হালিমা বেগম

বীরপ্রতীক রকেট জলিলের ভাই আব্দুল খালেক রণাঙ্গণের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘একাত্তরের জুলাইয়ের প্রথম দিকের ঘটনা। দোসতিনার প্রাইমারি স্কুলের মাঠ, বল ফিল্ডে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানিরা। ছুটিপুরে তাদের হেডকোয়ার্টার্স। তখন বর্ষাকাল। ক্যাম্পের সেনারা প্রতিদিন বদলি হয়। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা নাগাদ তারা ক্যাম্প বদল করে। ভাইয়ের (রকেট জলিল) নেতৃত্বে ২০ জনের একটি টিম নিয়ে মধুখালীর শালবাগান এলাকায় বড় একটি অপারেশনের সিদ্ধান্ত হয়। রাত ৪টার দিকে ভাই (রকেট জলিল), আব্দুস সাত্তার, গোলাম মোর্শেদ, রফিকুল ইসলাম, চাপাতলার সাত্তারসহ ২০ জন সেখানে অ্যামবুশ করি। এরই মধ্যে রাস্তায় ১২টি এন্টি পারসোনাল জাম্পিং মাইন পুঁতে রাখা হয়। দক্ষতার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে সেনারা স্থান বদল করে। কিন্তু যথাসময়ে পাকিস্তানি সেনারা কেউ আসছে না।’

তিনি বলেন, ‘বেলা ১১টার দিকে রেকি করতে বের হয় তারা। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। মাথায় টোকা, হাতে কাস্তে। হঠাৎ হাজির পাকিস্তানি সেনারা। জিজ্ঞেস করে, ‘মুক্তি হ্যায়?’ ভাই চুপ। সেনারা ভাইকে আটক করে নিয়ে যেতে থাকে দোসতিনার মধ্য দিয়ে। বেশ বিচলিত হন তিনি। কালেমা পড়তে থাকেন; ভাবেন, রাজাকাররা যদি দেখিয়ে দেয়, তবেই শেষ। অবশ্য পরের ঘটনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একই সঙ্গে সাহসিকতারও। রকেট জলিলের মাথায় একটা গুলির বাক্স দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেনারা। কিছুদূর যাওয়ার পর কাদামাটিতে ইচ্ছা করেই পড়ে যান জলিল ভাই। তিনি ভেবেছেন, যদি অসুস্থ মনে করে ছেড়ে দেয় সেনারা। কিন্তু তা হলো না। উল্টো লাথি মেরে জোর করে উঠিয়ে আবারও মাথায় বাক্সটি তুলে দেয়। এভাবে পৌঁছে যায় দোসতিনার মোমিন মাস্টারের কাঁঠালবাগানে। সেখানে দুজন সেনার উপস্থিতিতে গাঁতি দিয়ে বাংকার খুঁড়তে বলে সেনারা। দু’এক কোপ দেওয়ার পর জলিল ভাই দেখেন, পাকসেনারা গাছের শেকড়ের ওপরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে দুজন দুই দিকে মুখ করে। এই সুযোগ। আস্তে আস্তে চলে যান তাদের কাছে। গাঁতি দিয়ে একজনের মাথা বরাবর দেন কোপ। দুই ভাগ হয়ে যায় মুহূর্তেই। শব্দ শুনে অন্যজন সামনে ফিরতেই তাকেও কোপ দেন। মাথার ঘিলু-রক্তের ছোপ ছিটকে মুখে লাগে। দুটি চাইনিজ রাইফেল নিয়ে দেন দৌড়। পরদিন সেই জায়গায় আবারও ১২টি মাইন স্থাপন করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাক সেনারা সেখানে থামে। তিন শতাধিক সৈন্য, কাদামাটিতে, অস্ত্র কাঁধে সতর্ক অবস্থায়।’

জীবদ্দশায় বাংলা ট্রিবিউনকে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন রকেট জলিল।  তার ভাষায়, ‘আমরা ২০ জনের মতো অ্যামবুশে ছিলাম। একজনের দায়িত্ব ছিল মাইনের সঙ্গে যে শক্ত সুতা বাঁধা, তা টান দেওয়ার। আর্মিদের উপস্থিতিতে দেখি ওই লোক আর নেই; পালিয়েছে আরও ৫-৬ জন। আমি বাংকারে, এসএলআর হাতে। এখান থেকে পালানো অসম্ভব। ইয়া আলী বলে সুতা ধরে টান দিই। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় মাইন। এসএলআর নিয়ে দাঁড়িয়ে ব্রাশফায়ার করি। অন্য সঙ্গীরাও ফায়ার শুরু করে দেন। ফায়ার করতে করতে আমরা পেছাচ্ছি। লাশ পড়ছে কাদার মধ্যে। কতগুলো সৈন্য মারা গেছে দেখিনি। কিন্তু মাইন বিস্ফোরণের পর দেখি, একটি খেজুরগাছের ডালে মাথাবিহীন দুই সৈন্য ক্রস চিহ্নের মতো ঝুলে রয়েছে। গরুর গাড়িতে করে লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় ঝিকরগাছা থানায়। যারা নিয়েছিলেন, তারা লাশ গুনে জানিয়েছিলেন ৩২ জন। পরদিন কপোতাক্ষের পানিতে পাওয়া যায় আরও ছয়টি লাশ।’

বীরপ্রতীক আব্দুল জলিলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ভাই আব্দুল খালেক

১৯৯৬ সালে ‘বীরপ্রতীক’ পদকপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধার ‘বীরপ্রতীক ভাতা’ ও আড়াই বিঘা জমি থেকে পাওয়া ফসল থেকেই এখন সংসার চলছে।

তার অবর্তমানে তিন স্ত্রী যথাক্রমে হালিমা বেগম, সালেহা বেগম আর মোমেনা খাতুন রয়েছেন পাল্লা মোড়লপাড়ার একতলা বাড়িতে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে দুই ছেলে এক মেয়ে, মেজো স্ত্রীর ঘরে এক মেয়ে আর ছোট স্ত্রীর ঘরে এক ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়েদের সবার বিয়ে হয়েছে। এক ছেলে পাল্লা বাজারে একটি দোকান নিয়ে ব্যবসা করছেন। অন্যরা দেশের বাইরে।

কয়েকদিন আগে বীরপ্রতীক নীড়ে কথা হয় রকেট জলিলের স্ত্রী হালিমা বেগম ও মোমেনা খাতুনের সঙ্গে। হালিমা বেগম বলেন, যুদ্ধের সময় আমার বড় ছেলে কোলে। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ছুটে গেছি রকেট ও তার সঙ্গীদের জন্য খাবার নিয়ে। পৌঁছে দিয়েছি অস্ত্র, গোলাবারুদ।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্রায় তিন বছর হলো রকেট মারা গেছেন। কিন্তু তার কবর সংরক্ষণে কেউ ব্যবস্থা নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন, তিনি যেন বীরপ্রতীকের কবরটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আগামী প্রজন্ম যেন জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধে তার কীর্তি। একই কথা বলেন বীরপ্রতীকের ছোটভাই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক মোড়লও।

এ বিষয়ে কথা হয় বীরপ্রতীকের বড় ভাইয়ের ছেলে ঝিকরগাছা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার শাহজাহান আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ঝিকরগাছার বেনেয়ালী থেকে পাল্লা সড়কটি রকেট জলিলের নামে নামকরণ, তার কবর সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে গত ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলা পরিষদসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রেজুলেশন করে পাঠানো হয়েছে। এর আগের ইউএনও আরাফাত রহমানের সঙ্গে এ বিষয়ে আমাদের কথা হয়। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবস্থা নেননি। নতুন ইউএনওর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবো।

জানতে চাইলে ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব-উল-হক বলেন, মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। গণপূর্ত বিভাগ কাজ পেয়েছে। এর আগে পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেসব কবর বাঁধাইকরণের জন্যে পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর কাজ শুরু হবে। সেক্ষেত্রে শিগগিরই বীরপ্রতীক আব্দুল জলিলের কবর পাকাকরণের কাজ হবে।

/এএম/
সম্পর্কিত
মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সাধারণ মানুষ, আজ সবকিছুর কৃতিত্ব চায় আ. লীগ
‘বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উৎসাহিত করেছিল’
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেই আমরা প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
হত্যা মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের দুই কর্মকর্তার জামিন
হত্যা মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের দুই কর্মকর্তার জামিন
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’