X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বছরে ২০ কোটি টাকার পাঙাশ বিক্রি করেন জয়নাল

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
১৮ আগস্ট ২০২১, ২০:০৬আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২১, ২০:০৬

শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই সত্য, বছরে ২০ কোটি টাকার পাঙাশ মাছ বিক্রি করেন জয়নাল আবেদিন। ৬০ একর জমিতে ২০টি পুকুরে করছেন পাঙাশ চাষ। পরিশ্রম আর মনোবলকে কাজে লাগিয়ে বদলে ফেলেছেন ভাগ্যের চাকা। কিনেছেন জমি, গড়েছেন পাঁচ তলা বাড়ি। মাছ চাষিদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সদর ইউনিয়নের কোনাবাড়ি এলাকার জয়নাল আবেদিন (৬০)।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে পাঙাশ চাষ শুরু করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। জয়নালের শুরু তখন থেকে। ওই সময়ে পাঙাশের যেমন চাহিদা ছিল, দামও ছিল সেরকম। ফলে দ্রুতসময়ে লাভের মুখ দেখেন জয়নাল। কোনাবাড়ি ফিসারিজ নামে গড়ে তুলেছেন মৎস্য খামার। বছরে দেড় থেকে দুই হাজার মেট্রিক টন পাঙাশ বিক্রি করেন। ২৬ বছর আগে চাষ শুরু করা জয়নালের মাসে দেড় কোটি টাকার ওপরে পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়।

শুধু জয়নাল আবেদিন নন, অল্প পুঁজি নিয়ে মাছ চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন ত্রিশালের আবুল কালাম (৫৫) ও ভালুকার সাইফুল হুদা সোহাগসহ (৩৬) অনেক বেকার যুবক। 

দেশে বছরে সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন পাঙাশ মাছ উৎপাদন হয়। এই উৎপাদনে ময়মনসিংহ থেকে জোগান আসে দুই লাখ মেট্রিক টন। জেলার ছয় হাজার ১৭৫ খামারি পাঙাশ উৎপাদন করে এই জোগান দেন। বেকার ও হতাশাগ্রস্ত যুবকদের অনুকরণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন এসব মাছ চাষি।  

বাঁ থেকে মাছ চাষি জয়নাল আবেদিন, আবুল কালাম ও সাইফুল হুদা সোহাগ

জয়নাল আবেদিন বলেন, শুরু থেকেই পাঙাশ মাছ চাষ লাভজনক ছিল। এ কারণে ময়মনসিংহের অনেকেই পাঙাশ চাষে আগ্রহী হন। আগে পাঙাশের পোনা জেলার বিভিন্ন হ্যাচারিতে পাওয়া যেতো। বর্তমানে বগুড়া ও শান্তাহার থেকে আনতে হয়। দুই বছর ধরে পাঙাশ দেশের বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না। এ কারণে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত। রফতানি করতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, বছরে একবার মাছ ধরে বিক্রি করি। কোনও কোনও বছর ২০ কোটি টাকার ওপরেও বিক্রি হয়। তবে ওষুধ ও মাছের খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন পাঙাশ চাষে তেমন লাভ নেই। তবে দাম কম হওয়ায় সব শ্রেণির মানুষ পাঙাশ কিনতে পারে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ পাঙাশ মাছ দিয়ে আমিষের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। তরুণদের এসএমই ঋণ দিয়ে মাছ চাষে আগ্রহী করতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। এতে বেকারত্বের হার হ্রাস পাবে এবং কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়বে।

ত্রিশালের দরিরামপুর এলাকার স্নাতক পাস আবুল কালাম ২০০০ সালে পাঁচ একর জমিতে চারটি পুকুর কেটে পাঙাশ চাষ শুরু করেন। বিনিয়োগ ছিল পাঁচ লাখ টাকা। এক বছরের মাথায় মাছ বিক্রি করে খরচ বাদে লাভ হয় এক লাখ টাকা। বর্তমানে আবুল কালামের ৫০ একর জমিতে বড় পুকুর রয়েছে পাঁচটি। প্রতি বছর পাঙাশ বিক্রি করেন ৬০০-৭০০ মেট্রিক টনের বেশি। বিনোয়োগ রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। এখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে স্থানীয় ৩০ যুবকের।

আবুল কালাম বলেন, বিএফআরআই থেকে সাত দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোট পরিসরে পাঙাশ চাষ শুরু করি। সবাই লাভবান হচ্ছে দেখে চাষে আগ্রহী হই। বর্তমানে মুনাফা কম হলেও মাছ চাষ করছি। মাছ বিক্রি করি ত্রিশালের আড়তদারদের কাছে। আড়তদাররা পাঙাশ ঢাকা, রংপুর, বগুড়া ও সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠান।

আবুল কালাম ২০০০ সালে পাঁচ একর জমিতে চারটি পুকুর কেটে পাঙাশ চাষ শুরু করেন

তিনি আরও বলেন, করোনার আগে দেশের বাইরে পাঙাশ পাঠানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু রফতানি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আড়তদার ছাড়া মাছ বিক্রির সুযোগ কম। এই সুযোগে আড়তদাররা বাকিতে মাছ কিনে বিভিন্ন জেলায় পাঠান। এতে টাকা উঠাতে বেগ পেতে হয়।

আবুল কালাম আরও বলেন, শুরু থেকে যারা পাঙাশ চাষে জড়িত ছিলেন তারা ব্যাপক লাভবান হয়েছেন। অনেকেই মাছ চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন। তবে মেধা আর পরিশ্রমকে কাজে লাগাতে পারলে যে কোনও কাজেই সফলতা আসে। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে খামারকে আরও বড় করার পরিকল্পনা আছে।

ইংল্যান্ড থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ওপর পড়াশোনা করেছেন ভালুকার সাইফুল হুদা সোহাগ (৩৬)। দেশে ফিরে চাকরির পেছনে না ছুটে ২০১২ সালে বাবার এক একর জমিতে পুকুর কাটেন। এরপর শুরু করেন পাঙাশ চাষ। সাত থেকে আট লাখ টাকা নিয়ে মাছ চাষ শুরু করে ছয় মাসের মাথায় পাঙাশ বিক্রি করে ৯৪ হাজার টাকা লাভ হয়। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বিএফআরআই থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ইউনিভার্স ফিসারি নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে পাঙাশ চাষ করে এগিয়ে যান।

সোহাগ বলেন, ‘ইংল্যান্ড থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে এসে ভাবলাম, ভালো কোনও কোম্পানিতে চাকরি করবো। কিন্তু ভালুকা ও ত্রিশালের অনেক সফল মৎস্য চাষিকে দেখে মাছ চাষে আগ্রহী হই। এরপর পাঙাশ চাষ শুরু করি। ছয় মাসের মাথায় মাছ বিক্রি করে ৯৪ হাজার টাকা আয় হয়। এরপর চাকরি না করে মাছ চাষে মনোযোগী হই।’

ভালুকার সাইফুল হুদা সোহাগ চাকরির পেছনে না ছুটে এক একর জমিতে পুকুর কেটে পাঙাশ চাষ শুরু করেন

তিনি বলেন, ‘পাঙাশ বিক্রি করে এক বছরে ৩০-৪০ লাখ টাকা আয় হয়েছে। মুনাফার টাকায় বিনোয়োগ করে বর্তমানে ১৮টি পুকুরে পাঙাশ চাষ করছি। তবে করোনাকালীন সময়ে মুনাফা তেমন একটা হচ্ছে না। স্থানীয় ৪০ জন যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে দেশ স্বাভাবিক হলে পাঙাশ চাষ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা আছে। বেকার যুবকরা চাকরির পেছনে না ছুটে ইচ্ছা করলে অল্প পুঁজি নিয়ে মাছ চাষে নামতে পারেন।’

বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশে পাঙাশ মাছের চাহিদার অর্ধেক ময়মনসিংহের খামারিরা জোগান দিয়ে আসছেন। পাঙাশ চাষের শুরু থেকেই বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা চাষিদের কারিগরিসহ নানাভাবে সহায়তা করছেন। আমরা সবসময় তাদের পাশে আছি।

তিনি আরও বলেন, সাইফুল হুদা সোহাগ, আবুল কালাম ও জয়নাল আবেদিন মেধা কাজে লাগিয়ে পরিশ্রম করে সফলতা পেয়েছেন। তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি জাতীয়ভাবে মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাতে কাজ করে যাচ্ছেন। এসব সফল চাষিকে দেখে বেকার যুবসমাজ মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উদ্যোক্তা তৈরিতে এগিয়ে আসার অনু্প্রেরণা পাবেন।

/এসএইচ/এএম/
সম্পর্কিত
রাজশাহীতে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ধান উৎপাদন
ফলন বেশি, চরাঞ্চলের কৃষকরা ঝুঁকছেন ‘জাপানি মিষ্টি আলু’ চাষে
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
সর্বশেষ খবর
প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনতাই: পুলিশের এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা
প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনতাই: পুলিশের এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এক এজেন্সির ২৬০ হজযাত্রীর কারও ভিসা হয়নি, কারণ দর্শানো নির্দেশ
এক এজেন্সির ২৬০ হজযাত্রীর কারও ভিসা হয়নি, কারণ দর্শানো নির্দেশ
‘দরিদ্ররা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ২০ শতাংশও ভোগ করতে পারে না’
‘দরিদ্ররা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ২০ শতাংশও ভোগ করতে পারে না’
রাইসির হেলিকপ্টারের অবস্থান ‘শনাক্ত’, সুসংবাদের প্রত্যাশা
রাইসির হেলিকপ্টারের অবস্থান ‘শনাক্ত’, সুসংবাদের প্রত্যাশা
সর্বাধিক পঠিত
শনিবার ক্লাস চলবে ডাবল শিফটের স্কুলে
শনিবার ক্লাস চলবে ডাবল শিফটের স্কুলে
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
এনবিআর চেয়ারম্যানকে আদালত অবমাননার নোটিশ
এনবিআর চেয়ারম্যানকে আদালত অবমাননার নোটিশ
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
আগামী ৩ দিন হতে পারে বৃষ্টি, কমবে তাপপ্রবাহ
আগামী ৩ দিন হতে পারে বৃষ্টি, কমবে তাপপ্রবাহ