X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সব লাশের মুখ ছিল ডাবল পলিথিনে মোড়ানো

তানভীর হোসেন, নারায়ণগঞ্জ
১৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:৩১আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩১

সাত খুন প্রায় তিন বছর আগে সাত খুনের নৃশংস ঘটনা শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছিল। সাতজনকেই হত্যা করা হয়েছিল অভিনব নৃশংসতায়। একই স্টাইলে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় প্রত্যেককে যাতে করে লাশ ভেসে উঠতে না পারে। প্রত্যেকটি লাশের মুখ ছিল ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো।

সাত খুনের ঘটনায় ১২৭ সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জন সাক্ষ্য দেন। আদালতে ২১ আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। এই আসামিদের  জবানবন্দিতেও ওঠে আসে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা। সেখানে তারা নিজের ভাষায় হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন।

মামলার নথি, চার্জশিট, জবানবন্দি ও সুরতহাল রিপোর্ট সূত্রে জানা যায়,  নাসিক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অপহরণের দিনক্ষণ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি চাঁদাবাজির মামলায় স্থায়ী জামিন নিতে নজরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ আদালতে আসবেন। এ সম্পর্কে মেজর (অব.) আরিফ হোসেন নিশ্চিত হয়েই সেদিন সকালে অপহরণ পার্টিকে বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড় করান। সাদা পোশাকের একটি টিম নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নেয়। তারা সার্বক্ষণিক মেজর আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। নজরুল ইসলাম সেদিন তার গাড়ি না এনে সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপনের সাদা রংয়ের এক্স করোলা গাড়ি ব্যবহার করে আদালত প্রাঙ্গণে আসেন। সাত খুন

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে আদালত থেকে ওই গাড়িতে করে নজরুল ইসলাম বের হওয়ার পরপরই মেজর আরিফের কাছে খবর পৌঁছে দেয় আদালতের আশপাশে অবস্থান নেওয়া সাদা পোশাকের র‌্যাব সদস্যরা। নজরুলের সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম। গাড়ি ড্রাইভ করেন স্বপনের ব্যক্তিগত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর। নজরুলদের গাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। নজরুলদের বহনকারী গাড়িটি নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড হয়ে উত্তর দিকে যাওয়ার পথে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের সামনে (ময়লা ফেলার স্থান) পৌঁছার পর মেজর আরিফের নেতৃত্বে গাড়ির গতিরোধ করা হয়। নজরুলের গাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। পরে দুটি গাড়ি থেকে সাতজনকে অস্ত্র দেখিয়ে র‌্যাবের দুটি গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়।

গাড়িতে তাদের ওঠানোর পর একে একে প্রত্যেকের শরীরে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করা হয়। অচেতন হওয়া সাতজনকে কয়েক ঘণ্টা তাদের গাড়িতেই রাখা হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদীতে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিকল্পনা মতে কাঁচপুর ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বালু-পাথর ব্যবসাস্থল জনমানুষ শূন্য করার জন্য নূর হোসেনকে ফোন দেন মেজর (অব.) আরিফ হোসেন। গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর র‌্যাবের গাড়ি ওই স্থানে পৌঁছায়। গাড়ির ভেতরই অচেতন প্রত্যেকের মাথা ও মুখ পলিথিন দিয়ে মোড়ানো হয়। পরে গলা চেপে একে একে শ্বাস বন্ধ করে মারা হয় সাতজনকে। সাতজনের নিথর দেহ গাড়ি থেকে নামানো হয়। পরে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৫ নম্বর ঘাট থেকে র‌্যাবের নির্দিষ্ট নৌকা নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুর ব্রিজের নিচে।

লাশগুলো নৌকায় উঠিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে যাওয়ার পথে ‘নির্দিষ্ট স্থান’ থেকে লাশ গুমের উপকরণ নৌকায় তোলা হয়। নৌকার মধ্যেই সাতজনের পায়ে ২৪টি করে ইটবোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর হাত পেছন করে রশি দিয়ে বাঁধা হয়।  মুখমণ্ডল ডাবল পলিথিন দিয়ে গলার কাছে বাঁধা ছিল। পেট ছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে সোজাসুজি ফাঁড়া। এভাবেই সাতজনের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। সাত খুন

পরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শান্তিনগর এলাকা সংলগ্ন নদীতে কয়েকটি লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। এরপর ৩০ এপ্রিল বিকালে পুলিশ গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর এক কিলোমিটারের মতো এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে একে একে ছয়টি লাশ তুলে আনে। এরপর ১ মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

সাত খুন মামলা পরিচালনা করা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে মাত্র ৮ মাসেই মামলার আইনি কার্যক্রম শেষ হয়। ১২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। যুক্তিতর্ক ও আসামিদের জেরাতে রাষ্ট্রপক্ষ তথা আমরা আদালতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে মামলায় অভিযুক্তরা সবাই সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা, গুমসহ পুরো কার্যক্রমে জড়িত।’

সোমবার নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি ৯ জনকে সাত থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে তিনজন পলাতক। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন।

/এআর/এফএস/

আরও পড়ুন- 

নূর হোসেন ও র‌্যাবের কমান্ডার তারেক সাঈদসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড

মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো যাদের


সাত খুনের চার্জশিট: যেভাবে নেওয়া হয় হত্যার প্রস্তুতি

৭ খুন মামলা চলাকালে আলোচিত কিছু ঘটনা

যেভাবে ট্রাকের হেলপার থেকে ‘গডফাদার’

নূর হোসেনের সহযোগীরা এখনও সক্রিয়!

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা