‘বার বার বন্যায় ফসল গেলে কিতাই অইবো, আমরার তো ক্ষেত গিরস্থি কইরাই খাওন লাগবো। এর লাইগা জমিতে আবারও আমনের চারা বুনছি।’ বন্যায় সব হারিয়ে দিশেহারা কৃষক সুনামগঞ্জের রাধানগর গ্রামের মফিজ মিয়া তার বেঁচে ওঠার চেষ্টা ও ভবিষ্যত স্বপ্নের কথা বললেন এভাবেই। শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকালে বিশ্বম্ভরপুর কাচিগাতি সড়কের দক্ষিণ পাশে আমন ধানের জমিতে কাজ করছিলেন তিনি। মফিজ মিয়ার মতো বেঁচে থাকার লড়াই করছেন, নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন চালবন এলাকার লতিফ মিয়া,ভাদেরটেক গ্রামের আব্দুল মতিনসহ অন্যান্য কৃষকরা। তারা আমন চাষ করে ঘুরে দাঁড়াতে চান। আমন চাষের মধ্যদিয়ে ভবিষ্যত স্বপ্ন বুনছেন বোরো চাষের।
চালবন গ্রামের লতিফ মিয়া জানান, সরকারি সাহায্য আর কিছু ধারদেনা করে আবারও জমিতে আমন চাষাবাদ শুরু হয়েছে কৃষকদের। প্রথমবারের আমন ক্ষেত বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সবাই। তিনি বলেন, ‘ক্ষেত লাগাইয়াম, দেওনের মালিক আল্লা। ক্ষেত না লাগাইলে কি আল্লা বাড়িত বইয়া খানি আইনা দিয়া যাবো।’
ভাদেরটেক গ্রামের আব্দুল মতিন জানান, এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জমিতে আমনের চারা লাগাচ্ছেন তিনি। বোরো ধানের চেয়ে আমন জমিতে খরচ লাগে কম। তাই কষ্ট করে আবারও জমিতে ধান রোপন করছেন তিনি।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরপর দুইবার ফসলহানির পর চরম অর্থ সংকট আর বীজ পাওয়ার অনিশ্চয়তায় বোরোর আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সুনামগঞ্জ এলাকার হাওরের কৃষকরা।
কৃষকদের এ পরিস্থিতির বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, ‘বোরো মৌসুমের শুরুতেই সার, বীজ, ডিজেলসহ সহজ শর্তে কৃষি ঋণ না দিতে পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এ অবস্থায় আগামী বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে হাওরে বোরো আবাদের লক্ষ্যপূরণে সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’
মো. জাহেদুল হক জানান, গেল বোরো মৌসুমে দুই লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে এক লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল অকাল বন্যায় তলিয়ে গেছে। বোরো ফসল হারিয়ে যখন সর্বশান্ত কৃষক। এরপর শ্রাবণের বন্যায় হারিয়েছেন জমির আমন ধান। এ কারণে আগামী মৌসুমে বোরো চাষ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা।
কৃষকদের আশঙ্কা সরকারি সহায়তা না পেলে মহাজনের ঋণচক্রে জড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন, ‘হাওরপাড়ের কৃষকরা সুদখোর চক্র থেকে আস্তে আস্তে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু শ্রাবণের বন্যা তাদেরকে হয়ত আবারও ওই দিকেই ঠেলে দেবে।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রনজিত চৌধুরী রাজন বলেন, ‘হাওরের উঁচু এলাকার পানি নেমে যাওয়ায় খরচার হাওরসহ কিছু এলাকায় নতুন করে তৈরি হচ্ছে বীজতলা। বোরো আবাদের জন্য বীজের কিছুটা যোগান আসবে এখান থেকে। তবে এই স্বল্প আমন আবাদের বীজ দিয়ে বোরো মৌসুমের বিশাল চাহিদার পূরণ করা সম্ভব নয়। ঝড়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বীজ, সারসহ আনুসাঙ্গিক উপকরণ কেনার জন্য কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তারপরও হাওরের ঘরে ঘরে যে অভাব চলছে আগামী বছর বোরোর ফসল ঘরে ওঠার আগে তা থেকে পুরোপুরি মুক্তির কোনও সম্ভাবনা দেখছেন না কেউ।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক জাহেদুল হক বলেন, ‘আগামী বোরো মৌসুমে সারবীজ, ডিজেলসহ চাষাবাদের সকল কৃষি উপকরণ সঠিক সময়ে কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে।’
উল্লেখ্য, গত ২৮ মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট অকাল বন্যায় এক লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমির কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে যায়। যার বাজার মূল্য দেড় হাজার কোটি টাকা। এতে সাড়ে তিন লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে এক লাখ ৬৮ ভিজিএফ ও ২৩ হাজার ৬১৫টি ভিজিডি কার্ড ও জিআর চাল বিতরণের মাধ্যমে সরকারি খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া খোলা বাজারে ১১০টি পয়েন্টে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। দুর্গতদের সাহায্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন ত্রাণ বিতরণ করছে। দ্বিতীয় দফায় আগস্ট মাসের বন্যায় ১০ হাজার হেক্টর আমন জমি ও বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। এতে ৯৪ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।