X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রেন দিয়েও পাচার হয় বড়পুকুরিয়ার কয়লা!

বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর
২৫ জুলাই ২০১৮, ১৯:২৪আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৮, ১২:৩৭

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি (ছবি: দিনাজপুর প্রতিনিধি) ২৩০ কোটি টাকা মূল্যের ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কয়লা খনিতে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, চারজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কয়লা গায়েব নিয়ে আলোচনা চলছে দেশজুড়ে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই বিপুল পরিমাণ কয়লা দিনাজপুর বড়পুকুরিয়া খনির বাইরে গেলো কীভাবে। কয়লা ব্যবসায়ী, স্থানীয় বাসিন্দা ও খনি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি উপায়ে কয়লা পাচার হয় বলে জানেন তারা। উত্তোলনকৃত কয়লার হিসাবে গরমিল, ওজনে কারচুপি, ট্রাকে চালান দেওয়ার সময় নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি দিয়ে দেওয়া, ড্রেনের মাধ্যমে পুকুরে পাচার, স্তূপ পরিষ্কারের কথা বলে কয়লা পাচার হয় এখানে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা জানান, বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন উপায় অবলম্বন করে চুরি হয়েছে এই কয়লা। যার সঙ্গে জড়িত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা, উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক নেতাদের ডিও বাণিজ্যও কয়লা চুরির ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

বুধবার বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ১৯ কর্মকর্তাকে আসামি করে দায়ের করা মামলায় খনির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনিছুর রহমান উল্লেখ করেছেন, খনি উন্নয়নের সময় ২০০১ সাল থেকে ১৯ জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২ দশমিক ৩৩ মেট্রিক টন কয়লা উৎপাদন করা হয়েছে। উৎপাদিত কয়লা থেকে পার্শ্ববর্তী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৯ দশমিক ২৯ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ করা হয়েছে। বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে ডিও’র মাধ্যমে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮০ দশমিক ৩৭ মেট্রিক টন কয়লা বিক্রি করা হয়েছে। খনির বয়লারে ১২ হাজার ৮৮ দশমিক ২৭ মেট্রিক টন কয়লা ব্যবহার করা হয়। কয়লার উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার হিসাব করলে ১৯ জুলাই কোল ইয়ার্ডে রেকর্ডভিত্তিক কয়লার মজুত দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন কয়লা। কিন্তু বাস্তবে মজুত ছিল প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। অর্থাৎ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন কয়লার ঘাটতি রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৩০ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের মতে, দীর্ঘদিন ধরেই এই কয়লা চুরি হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মজুত কম থাকা এবং শ্রমিকদের ধর্মঘটের সময় কয়লা উত্তোলন বন্ধ থাকায় বিষয়টি জানাজানি হয়েছে। কয়লা চুরির এই ঘটনাটি প্রথম নয় বলেও জানান ব্যবসায়ীরা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নজরদারি না করায় বছরের পর বছর ধরে চুরির ঘটনা ঘটেই চলেছে বলে মত তাদের।

কয়লা ব্যবসায়ী মশিউর রহমান বুলবুল জানান, ‘কয়লা খনির দুর্নীতি হয় কাগজে-কলমে। খনির কিছু সুনির্দিষ্ট গ্রাহক রয়েছে, তারা অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে। যে পরিমাণ কয়লা ক্রয় করে তারচেয়ে বেশি কয়লা গ্রহণ করে তারা। কিন্তু কাগজে শুধু ক্রয়কৃত কয়লার হিসাবই লিপিবদ্ধ হয়। এতে কাগজে কয়লা ঠিক থাকলেও বাস্তবে কয়লা পাওয়া যায় না।’ তিনি আরও জানান, ‘ওজনে কারচুপি করেও কয়লা সরানো হয়। ট্রাকে নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি কয়লা তুলে দিয়ে পরে তা বিক্রি করা হয়।’

কয়লা দুর্নীতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ব্যবসায়ী জানান, ‘কয়লা খনির ড্রেন দিয়েও কয়লা পাচার করা হয়। খনির এসব ড্রেন দিয়ে মূলত ডাস্টযুক্ত পানি বের হয়। কিন্তু সেখান দিয়ে মোটা কয়লাও দিয়ে দেওয়া হয়। এই পানি এসে পড়ে কিছু ব্যক্তির কয়লা আটকানো পুকুরে। সেই পুকুর থেকে মাস শেষে জমা হওয়া কয়লা তুলে বিক্রি করা হয় ভালো কয়লার সঙ্গে মিশিয়ে।’ তিনি জানান, ‘গত বছর ২৫ কোটি টাকার কেমিক্যাল কেনা হয়েছে ডাস্টযুক্ত পানিতে দেওয়ার জন্য। এই কেমিক্যাল ডাস্টযুক্ত পানিতে দিলে ডাস্ট ঘনীভূত হয়ে বসে যাবে। অথচ এই কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না, যাতে করে বাইরে চলে আসে। এই কয়লা বিক্রির টাকা ভাগাভাগি হয় ওইসব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে, যাদের কেমিক্যালের বিষয়টি দেখার কথা।’ তিনি জানান, বছরে যদি এক হাজার টন কয়লাও এই ড্রেন দিয়ে পাচার হয় তাহলে পাচারের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম জানান, ‘কিছু দিন আগেও কোল ইয়ার্ডে কয়লার স্তূপ ছিল। কিন্তু এক মাসের ব্যবধানেই কয়লার সেই স্তূপ খালি হয়ে গেছে। কয়লা বিক্রির মৌসুম না হলেও এখান থেকে কয়লা বিক্রি করেছে অসাধু কর্মকর্তারা। রাতারাতি কয়লা বিক্রি ও গায়েব করা হয়েছে এখানে। আর এটাকে সিস্টেম লস দেখিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

কোল ইয়ার্ড থেকে এর আগেও চুরির ঘটনা ধরা পড়ে, কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে পার পেয়ে যায় জড়িতরা। এই কথা জানিয়ে কয়লা ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৭ সালের দিকে খনি থেকে ৩০০ টন কয়লা চুরি হয়েছিল। পরে বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে খনির কর্মকর্তারা রাতারাতি সেই ৩০০ টন কয়লার টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে সমন্বয় করে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, কর্মকর্তারাই কয়লা চুরির সঙ্গে জড়িত। ওই সময়ে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পার পেয়ে যায় জড়িতরা। এভাবেই দুর্নীতিবাজদের সাহস আরও বেড়ে যায় এবং এত বড় ঘাপলার ঘটনা ঘটে।’

বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির ফুলবাড়ী উপজেলা শাখার সম্পাদক এসএম নুরুজ্জামান অভিযোগ করেন, ‘কয়লার এই ঘাপলার জন্য শুধু কর্মকর্তারাই নয়, মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতারাও দায়ী। তারা বিভিন্ন নামে কয়লার ডিও দেন, এই ডিওতে যে পরিমাণ কয়লা দেওয়ার কথা তার বেশি পরিমাণ কয়লা দেওয়া হয়। যাতে করে লাভবান হন কর্মকর্তারা। আর ডিওতে গ্রহণ করা কয়লার মূল্য টনপ্রতি ১৭ হাজার টাকা হলেও বাজারে টনপ্রতি মূল্য ২০ হাজার টাকা। শুধুমাত্র ডিও নিয়েই অনেকে কমিশন বাণিজ্য চালাচ্ছে। যার টাকা ভাগাভাগি হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে।’

দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, কাগজ-কলমে ঠিক থাকলেও বাস্তবে কয়লা নেই। এটাতেই দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। দুদকের দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, ‘কোল ইয়ার্ড পরিদর্শন করে আমরা দেখেছি প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন কয়লার মজুত রয়েছে। অথচ কাগজ-কলমে রয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন। প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লার কোনও হদিস নেই। কাগজ-কলমের সঙ্গে বাস্তবের এই গরমিলই প্রমাণ করে এখানে দুর্নীতি হয়েছে।’ তিনি জানান, কয়লার ঘাপলা নিয়ে ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলার কাগজপত্র হাতে পেলেই তদন্তের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠানো হবে।

আরও পড়ুন- 

কয়লা দুর্নীতির ঘটনায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যেভাবে ধরা পড়লো কয়লা খনির দুর্নীতি

কয়লা গেলো কোথায়?

কয়লা গায়েবের সত্যতা পেয়েছে দুদক

বড়পুকুরিয়ার কয়লা সংকট নিয়ে কমিটি গঠনের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

‘বড়পুকুরিয়ায় কয়লা সংকট এক মাসের মধ্যে সমাধান’

কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেলো বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র

/এফএস/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নাইজেরিয়ায় বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত কারাগার, পালালো শতাধিক বন্দি
নাইজেরিয়ায় বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত কারাগার, পালালো শতাধিক বন্দি
গাজার গণকবরের ৮৫ শতাংশ মরদেহই অজ্ঞাত
গাজার গণকবরের ৮৫ শতাংশ মরদেহই অজ্ঞাত
‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের’ এক সদস্য গ্রেফতার
‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের’ এক সদস্য গ্রেফতার
বিশ্বসাহিত্যের খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না