গাইবান্ধা-১ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সাবেক এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা অস্ত্র আইনের মামলায় একই আসনের জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) আবদুল কাদের খানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মামলা দায়েরের দুই বছর চার মাস পর মঙ্গলবার (১১ জুন) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক দিলীপ কুমার ভৌমিক এ রায় ঘোষণা করেন।
এর আগে বেলা ১১টা ৫০ মিনিট থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ৪৩ পৃষ্ঠার রায় পড়ে শোনান বিচারক। রায় ঘোষণার সময় আসামি আবদুল কাদের খান আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এদিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে জেলা কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে কাদের খানকে আদালতে আনে পুলিশ।
দণ্ডিত আসামি আবদুল কাদের খান গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপরহাটি গ্রামের মৃত নয়ন খানের ছেলে। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে হত্যা মামলার প্রধান আসামি কাদের খান। ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর থেকে কাদের খান গাইবান্ধা জেলা কারাগারে আছেন। সম্প্রতি সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে কাদের খান ও তার স্ত্রী ডা. আখতার জাহান উম্মে নাসিমা বেগমের বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কাদের খানের সুন্দরগঞ্জের ছাপরহাটির গ্রামের বাড়ির উঠানের মাটির নিচ থেকে একটি পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলি ও একটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করে পুলিশ। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ২৫ ফেব্রুয়ারি কাদের খানের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করে। মামলার তদন্ত শেষ করে ৩৯ দিন পর ৫ এপ্রিল তদন্তকারী কর্মকর্তা কাদের খানকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তিন বছর চার মাস ধরে আদালতে মামলার বিচারকাজ চলে।
রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম শফিক জানান, ‘গত ৩০ মে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক, শুনানিসহ সব কার্যক্রম শেষে ১১ জুন রায়ের দিন ধার্য করেন বিচারক। আজ আদালত আবদুল কাদের খানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। আসামি কাদের খানের উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন বিচারক। রায় ঘোষণার পরই কাদের খানকে পুলিশ পাহারায় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।’
এদিকে, রায়ের সময় আদালতে এমপি লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এ সময় রায়ের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। লিটন হত্যা মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিজ বাড়ি সুন্দরগঞ্জের সাহাবাজ (মাস্টারপাড়া) গ্রামে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন সাবেক এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। হত্যার ঘটনায় ১ জানুয়ারি লিটনের বড় বোন ফাহমিদা কাকলি বুলবুল বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। এছাড়া হত্যার কাজে ব্যবহৃত গুলিভর্তি পিস্তল উদ্ধারের ঘটনায় অস্ত্র আইনে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করে পুলিশ। হত্যা মামলায় পুলিশ প্রধান আসামি কাদের খানসহ চারজনকে গ্রেফতার করে। পরে আসামিরা আদালতে লিটন হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বর্তমানে আদালতে হত্যা মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যায় তিনটি অস্ত্র ব্যবহার হয়। এরমধ্যে ১০ রাউন্ড গুলিসহ একটি অস্ত্র কাদের খান সুন্দরগঞ্জ থানায় জমা দিয়েছেন। দ্বিতীয় অস্ত্রটি আব্দুল কাদের খানের গ্রামের বাড়ি ছাপরহাটি থেকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক তৃতীয় অস্ত্রটিসহ ৪০ রাউন্ড গুলির সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তিনটি অস্ত্রের মধ্যে কাদের খানের লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্র ছিল একটি।
লিটন হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম দুই মাসে জামায়াত-শিবিরসহ দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করলেও হত্যার ক্লু ও প্রকৃত জড়িতরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরপর একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ফেলে যাওয়া ম্যাগাজিনের সূত্র ধরে এমপি লিটন হত্যার মামলার ক্লু উদঘাটন করাসহ হত্যার পরিকল্পনাকারী আবদুল কাদের খানসহ চার জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। পরবর্তী সময়ে কাদের খানের সহকারী শামছুজ্জোহা ও কসাই সু্বলকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে কসাই সুবল অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছেন। তবে অপর আসামি চন্দন কুমার ভারতে পলাতক আছেন।
