X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্গাপূজার চালে সিন্ডিকেটের থাবা

মতিউর রহমান, মানিকগঞ্জ
০৪ অক্টোবর ২০১৯, ২৩:১৩আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ২৩:১৫

মানিকগঞ্জ ব্যক্তিগত কিংবা সর্বজনীন প্রত্যেক পূজামণ্ডপের জন্য সরকার থেকে ৫০০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে পূজামণ্ডপের দায়িত্বশীলরা এসব চাল সংগ্রহ করার কথা থাকলেও নিম্নমানের কারণে তারা নিতে রাজি হন না। এই সুযোগে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার সরকারি গুদাম থেকে বরাদ্দ চালের বিপরীতে নগদ টাকা দেওয়া হচ্ছে। তবে, এই ক্ষেত্রে মাত্র অর্ধেক মূল্য দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন পূজামণ্ডপ-সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, এখানে সিন্ডিকেট থাবা বিস্তার করে বসেছে। এই সিন্ডিকেট পূজামণ্ডপকে ভালো চাল কিংবা ন্যায্যমূল্য দিতে চায় না। এসব অভিযোগ উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তারা স্বীকারও করেছেন। তাদের দাবি, এই ধরনের কর্মকাণ্ড দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। ইচ্ছে করলেই এই প্রথা বন্ধ করা যাবে না বলেও তারা দাবি করেন।

অভিযোগ উঠেছে, দুর্গাপূজার জন্য বরাদ্দ প্রতি কেজি চাল ১৫-১৮ টাকা দরে সিন্ডিকেট সদস্যরা কিনে তা বিক্রি করছেন ৩৫-৪০ টাকা দরে। আর পূজা মণ্ডপের দায়িত্বশীলরা চাল নিতে চাইলে খাদ্য গুদাম থেকে নিম্নমানের চাল দেওয়া হচ্ছে। যা দিয়ে আপ্যায়নের জন্য খিচুড়িও রান্না করা যায় না। বিক্রি করতে গেলে সেই চাল কেউ কিনতেও চান না। এতে পূজামণ্ডপ সংশ্লিষ্টরা চাল না নিয়ে টাকা নিতে উৎসাহী হন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা পূজামণ্ডপ সংশ্লিষ্টদের টাকা দিয়ে খাদ্য গুদাম থেকে ওইসব চাল নিয়ে নেন। তখন ভালো মানের চাল সরবরাহ করা হয়।

বাজারে মোটা চাল প্রতি কেজির দাম ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা হলেও সিন্ডিকেট পূজামণ্ডপের জন্য বরাদ্দ চাল কেজিপ্রতি ১৫-১৮ টাকা দরে হিসাব করে পূজা কমিটিকে টাকা বুঝিয়ে দিচ্ছে।

শিবালয় উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রথিন কুমার সাহা বলেন, রমেন্দ্র নাথ সাহা মণ্ডপের জন্য বরাদ্দ ৫শ কেজি চাল তিনি নেননি। এর পরিবর্তে তিনি নিয়েছেন ৮ হাজার টাকা। যার প্রতি কেজির দর পড়েছে ১৬ টাকা!

চাল না নিয়ে টাকা কেন নিলেন, জানতে চাইলে রথিন কুমার সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিম্নমানের চাল দেয়, যা দিয়ে আপ্যায়ন করানোর জন্য খিচুড়ি রান্না করা যেতো না। তাই টাকা নিয়েছি।’

খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা তো টাকা নয়, চাল দেওয়ার কথা। তাহলে কার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, জানতে চাইলে রথিন কুমার সাহা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

সিন্ডিকেটের বিষয় স্বীকার করে মানিকগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অসীম বিশ্বাস বলেন, ‘পূজামণ্ডপের কমিটির লোকজন চাল কেনা-বেচা সিন্ডিকেট সদস্যদের হাতে জিম্মি হতে হয়। কারণ, তারা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী।’

অসীম বিশ্বাস ও পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ জেলায় ৫১১টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সরকারিভাবে প্রতি মণ্ডপে দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের জন্য জিআর খাত থেকে (খয়রাতি) পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি বা সেক্রেটারির নামে মণ্ডপের জন্য ৫০০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডিওয়ের মাধ্যমে চাল উত্তোলন করতে হয় সরকারি গুদাম থেকে। নিয়ম অনুযায়ী পূজা কমিটি তাদের পছন্দ অনুযায়ী দামে বাজারে বিক্রি অথবা পূজারি ও ভক্তদের  আপ্যায়নের জন্য পূজামণ্ডপেও নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু, পূজামণ্ডপ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটির সবার সম্মতিতে তারা এসব চাল না এনে তা বিক্রি করে দেন। আর এই সুযোগে উপজেলার প্রভাবশালীদের অনুসারীদের সিন্ডিকেট এই চাল বাইরে বিক্রি করতে নিরুসাৎহিত করে তাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। এই ক্ষেত্রে প্রতি কেজি চালের দর ১৫-১৮ টাকা পড়ে। প্রতি টন চালের দাম পড়ে ১৪-১৫ হাজার টাকা। অথচ বাজারে প্রতি কেজি চাল সর্বনিম্ন ৩২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি মণ্ডপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চালের ডিও দেওয়া হয় উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার অফিস থেকে। কিন্তু, পূজামণ্ডপ সংশ্লিষ্টদের ডিও দেওয়া হয় না। শুধু স্বাক্ষর নিয়ে সিন্ডিকেটের লোকজন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজস করে নিজেরাই নিয়ে নেন। চালের দাম দেওয়া হয় সিন্ডিকেটের ইচ্ছা মাফিক। তারা জানান, এবার সর্বোচ্চ দাম দেওয়া হয়েছে ১৫ টাকা কেজি দরে। এদিকে, এই সিন্ডিকেট খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে গুদামের সর্বোচ্চ মানের চাল ডেলিভারি নেয়। যা বাজারে বিক্রি হয় কমপক্ষে ৪০ টাকা কেজি দরে।

গোডাউনের ভেতর চাল বদলানোর কারসাজির বিষয়টি অকপটেই স্বীকার করলেন সিন্ডিকেটের এক সদস্য আবদুস সালাম। তিনি বলেন, ‘চালের মান খারাপ হওয়ার কারণে ১৪-১৫ টাকার বেশি দাম দেওয়া যায় না। কেবল ঘিওরেই নয় পুরো মানিকগঞ্জ এমনকি বাংলাদেশের সব জেলাতেই এই সিন্ডিকেট ব্যবসা চলছে।’ ব্যবসা করতে হলে জায়গায়-জায়গায় টাকা পয়সা গুণতে হয় বলেও তিনি স্বীকার করেন।

শিবালয় উপজেলার আরেক চাল ক্রেতা বিশ্বনাথ বিশু বলেন, ‘পূজামণ্ডপের চাল ১৭ টাকা দরে কিনছি। কাউকে ১৮ টাকা কেজি দরেও দিতে হয়েছে। এই উপজেলায় আরও ৪-৫ জন এই চাল কেনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।’

শিবালয় উপজেলা খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিতীশ বলেন, ‘এই ধরনের কর্মকাণ্ড দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। ইচ্ছে করলেই এই প্রথা বন্ধ করা যাবে না।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘিওর উপজেলায় আবদুস সালাম, মুন্নাফ ও গৌরাঙ্গ ঘোষ তিন জনের সিন্ডিকেট এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঘিওর উপজেলায় এবার মোট ৬৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে।

অভিযোগের বিষয়ে ঘিওর উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা শামসুন নাহার এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

ঘিওর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রানাউল করিম সিন্ডিকেট ব্যবসার কথা স্বীকার করলেও এর সঙ্গে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে শনাক্ত করার পর নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে ডিও দেওয়া হয়। অন্য কারও হাতে ডিও দেওয়ার নিয়ম নেই। সরকারি খাদ্য গুদামের চালের মান ভালো। বাইরের বাজারে খুচরা মুল্য কমপক্ষে ৩৫ টাকা পাওয়া যায়।’

অভিযোগের বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) দিলদার হোসেন বলেন, ‘মন্দিরভিত্তিক সরকারি বরাদ্ধের চাল সংশ্লিষ্টরা গোডাউন থেকে উত্তোলন করলো কি বাইরে বিক্রি করে টাকা নিলো, এটা সম্পূর্ণ তাদের ব্যাপার। কোনও অফিসার যদি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করে থাকেন, এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’ তবে, সিন্ডিকেট বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।

মো. দিলদার হোসেন বলেন, ‘সাত উপজেলায় জিআর খাত থেকে পূজামণ্ডপের চালে ডিও হয়ে গেছে। শুধু মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা এলাকায় হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন উপস্থিত থেকে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।’ সদর উপজেলায় ৫৪ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ হয়েছে বলেও তিনি জানান।

 

 

/এনআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী