এখন হয়তো তাদের থাকার কথা ছিল বাড়িতে অথবা কর্মস্থলে। গন্তব্যে পৌঁছে ফোন করে জানানোর কথা ছিল আপনজনদের। কিন্তু সেই ফোন আর কখনোই আসবে না। কারণ, ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে ১৬ জন এখন লাশ। তাদের রাখা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগ রেলস্টেশনের অদূরেই বায়েক শিক্ষা সদন উচ্চবিদ্যালয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পে। লাশ নিতে কারও আত্মীয়, কারও পরিচিতজনেরা গেছেন সেখানে। আর নিহত সবার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্য রয়েছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার গাজীপুর গ্রামের মৃত মুসলিম মিয়ার স্ত্রী জাহেদা খাতুন হয়েছেন (৫০)। এ সময় আহত হয়েছেন জাহেদা খাতুনের ছেলে সুমন মিয়া, ইমন মিয়া ও মেয়ে সুমি বেগম, মিমি বেগম। এছাড়া জাহেদা খাতুনের মা সুরাইয়া আক্তার (৭৫)। গুরুতর আহত হয়ছেন। সুরাইয়া আক্তারের দুই পা কাটা গেছে।
তাদের বাড়িতে গেলে কথা হয় জাহেদার ভাই হেলাল মিয়া ও তার ভাসুরের মেয়ে আফরোজা আক্তারের সঙ্গে। তারা জানালেন, জাহেদার স্বামী চট্টগ্রামে পুরাতন জাহাজ কাটার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সাত দিন আগে দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। স্বামীর লাশ চট্টগ্রাম থেকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করে পাঁচ দিনের শিরনি ও মিলাদ শেষে চট্টগ্রাম ফিরে যাচ্ছিলেন জাহেদা ও অন্যরা। পথে তার মৃত্যু হয় এবং পরিবারের অন্যরা আহত হন। পরপর দুটি মৃত্যুর শোক স্বজনরা কীভাবে সইবেন বুঝে পাচ্ছেন না এলাকার কেউই।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলায় নিজের বাড়িতে ফেরার কথা ছিল মজিবুর রহমান (৫০) ও তার স্ত্রী কুলসুম বেগম (৪২) দম্পতির। এ জন্য সোমবার (১১ নভেম্বর) রাতে ট্রেনে করে চাঁদপুরে আসছিলেন। কিন্তু পথে দুর্ঘটনায় মারা যান দুই জনেই।
নিহত মজিবুর রহমান স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে সিলেটের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বসবাস করতেন। সেখানে কসমেটিক পণ্যের ব্যবসা করতেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি হাজীগঞ্জ উপজেলার ১নং রাজারগাঁও ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের বেপারি বাড়ি।
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) দুপুরে হাজীগঞ্জ উপজেলায় মজিবুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সবাই মরদেহের জন্য অপেক্ষা করছেন। এ ঘটনায় আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে চলছে শোকের মাতম।
পারিবারিক সূত্র জানায়, মজিবুর রহমান ও তার স্ত্রী সোমবার (১১ নভেম্বর) রাতে সিলেট থেকে আন্তনগর উদয়ন এক্সপ্রেসে করে লাকসামে আসছিলেন। সেখান থেকে ভিন্ন রুটে চাঁদপুরে আসার কথা ছিল তাদের। কিন্তু পথে ভোররাত ৩টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে উদয়ন এক্সপ্রেসের সঙ্গে ঢাকাগামী তূর্ণা-নিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। এতে ওই দম্পতি মারা যান।
রাজারগাঁও উত্তর ইউপি চেয়ারম্যন মো. আব্দুল হাদি মিয়া বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে তাদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এরপর তাদের লাশ আনার জন্য লোকও পাঠানো হয়েছে। লাশ এলে তাদের পরিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।’
চট্টগ্রামে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চেয়েছিলন হবিগঞ্জ পৌর শহরের আনোয়ারপুর এলাকার আলী মো. ইউসুফ (৩৫)। কিন্তু আর কখনোই দেখা হবে না তারা। কসবার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনি। ইউসুফ জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ও স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্টেনের প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইউসুফের শ্বশুর আব্দুল জলিল।
মঙ্গলবার দুপুরে ইউসুফের বাড়িতে গেলে তার শ্বশুর আব্দুল জলিল জানান, তার কন্যা চিশতিয়া বেগম চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে চাকরি করেন। সেখানে ইউসুফের দেড় বছরের কন্যা ইশাও থাকে। মাঝে মধ্যে ইউসুফ স্ত্রী-সন্তানকে দেখতে এবং তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে চট্টগ্রাম যান। সোমবার রাতেও ইউসুফ তার স্ত্রীকে জানান, উদয়নে করে চট্টগ্রামে আসছেন। রাতে বেশ কয়েকবার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। দুর্ঘটনার পর তারা ইউসুফের মৃত্যুর সংবাদ পান। তিন ভাইয়ের মধ্যে ইউসুফ সবার ছোট ছিলেন।
আরও পড়ুন-
বাতাসে লাশের গন্ধ
কসবায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১৬
দুর্ঘটনায় নিহত ১৬ জনের পরিচয় মিলেছে
ইটের কারণে সিগন্যাল দেখতে পায়নি তূর্ণা!
ছবিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রেন দুর্ঘটনা
নিহতদের পরিবার এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবে: রেলমন্ত্রী
দুর্ঘটনাস্থলে রিলিফ ট্রেন, উদ্ধার কাজ চলছে
ট্রেন দুর্ঘটনা: ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন