চার বছর আগে স্বামীকে হারান রোজিনা বেগম। এরপর এক বছরের শিশু সন্তানসহ দুই ছেলেকে আঁকড়ে ধরে জীবন সংগ্রামে নামেন তিনি। বড় ছেলে রেজাউলের (২৩) রোজগারই জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস ছিল তাদের। ছেলে রেজাউল বৈধ পাসপোর্ট আর ভিসা নিয়ে ভারতে গিয়ে লকডাউনের গ্যাঁড়াকলে ‘নিয়ম ভাঙার’ অভিযোগে ভারতের কারাগারে দুই মাস থেকে অবস্থান করছেন। বিধবা রোজিনা বেগম সন্তানকে ফেরত চেয়ে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে বলেন, ‘আমার ছেলেটাক আনি দেও, আমার বাবাক ঘুরি (ফেরত) দেও।’
বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজে ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চিলমারী উপজেলা থেকে কুড়িগ্রাম জেলা শহরের কলেজ মোড়ে মানববন্ধন করেন ভারতে আটক ২৬ বাংলাদেশির পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। শুধু রোজিনা বেগম নয়, ভারতে আটক অপর ২৫ বাংলাদেশি পুরুষের কারও মা, কারও বাবা আবার কারও স্ত্রী-সন্তান মানববন্ধনে অংশ নেন।
গত ৩ মে সকালে ২৬ বাংলাদেশিকে আটক করে ভারতের আসামের ধুবড়ি জেলা পুলিশ। তারা সবাই কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ব্যাপারিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। আটক ২৬ জনের মধ্যে বকুল মিয়া (৫৭) নামে এক বাংলাদেশি কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে বুধবার (১ জুলাই) সকালে আসাম রাজ্যের ধুবড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুর খবরে আটক অপর বাংলাদেশিদের জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়েন তাদের স্বজনরা। তাদের মুক্তি ও দেশে ফেরত আনার দাবিতে আজ (বৃহস্পতিবার) তৃতীয়বারের মতো মানববন্ধন করেন তারা।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ‘আটক বাংলাদেশিরা বৈধ কাগজপত্র নিয়ে ভারতে গেলেও তাদের অন্যায় ও বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়েছে। এরইমধ্যে বকুল মিয়া সেই অন্যায়ের বলি হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়; হত্যাকাণ্ড। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। পাশাপাশি আটক অপর বাংলাদেশিদের মুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপ কামনা করি।’ মানববন্ধন শেষে তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বাংলাদেশির মরদেহ আনার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়াও আটক অন্যদের ব্যাপারেও আমরা নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছি। বিষয়টি আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও অবগত রয়েছে।’ আটক বাংলাদেশিদের পরিবারকে ইতোমধ্যে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের আরও সহায়তার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের ২৬ বাংলাদেশি ভারতে যান। বৈধ পাসপোর্ট ও ভ্রমণ ভিসা থাকলেও ভারতে দ্বিতীয় ধাপের লকডাউন চলার মধ্যে গত ২ মে ওই ২৬ জন বাংলাদেশি দু'টি মিনিবাসে আসামের জোরহাট জেলা থেকে দেশে ফেরার উদ্দেশে রওনা দেন। পশ্চিমবঙ্গের চেংরাবান্ধা চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টা ছিল তাদের। ভারতে জেলে ও খামারকর্মী হিসেবে কাজ করা এসব বাংলাদেশিকে পরদিন (৩ মে) সকালে বাহালপুর এলাকা থেকে আটক করে আসামের ধুবড়ি জেলা পুলিশ। করোনা পরীক্ষার পর তাদের পাঠানো হয় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে। গত ৫ মে ওই ২৬ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে জালিয়াতি এবং ফরেনার্স (সংশোধিত) অ্যাক্ট, ২০০৪ এবং পাসপোর্ট অ্যাক্ট, ১৯৬৭’র ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়ের করে দেশটির পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাসপোর্টধারী এসব বাংলাদেশি টি-ওয়ান ভিসা নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এই ভিসাধারীদের কাজের অনুমতি না থাকলেও আসাম পুলিশের অভিযোগ, এই বাংলাদেশিরা রাজ্যের জোরহাট, গোলাঘাট ও শিবসাগর এলাকায় কর্মসংস্থান কার্যক্রমে যুক্ত থেকে ভিসার শর্ত ভঙ্গ করেছেন। তাদের মুক্তির দাবিতে কুড়িগ্রামে একাধিকবার মানববন্ধন করেন আটক ব্যক্তিদের স্বজনরা।