X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

অবশেষে রফতানিযোগ্য রঙিন আম পেলো বাংলাদেশ

মো. আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
৩১ জুলাই ২০২০, ১০:০০আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২০, ১০:০০

দীর্ঘ গবেষণায় উদ্ভাবিত নাবী জাতের এই আমটিই দেশের প্রথম রঙিন আম যা বিদেশে রফতানির শর্ত পূরণ করবে।

বাংলাদেশে অসংখ্য জাতের আম আছে। এমনকি পাকলে লাল কিংবা সিঁদুর আভা হয় এমন আমও দুর্লভ নয়। কিন্তু, বিদেশে রফতানির জন্য রঙিন আমের যেসব শর্ত থাকে সেগুলো পূরণ করার মতো কোনও আম ছিল না দেশে। এই খরা অবশেষে কেটে গেছে। দীর্ঘ গবেষণা ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে অবশেষে রঙিন আমের নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের  আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।

এই আমের উদ্ভাবক বিজ্ঞানীরা বলছেন, নাবী জাতের এই আমের প্রধান বৈশিষ্ট্য দেশের অন্য জাতের আমগুলো শেষ হওয়ার পরে এই আম পাকবে। ফলে এর দাম পাওয়া বা রফতানি নিয়ে মোটেই চিন্তা করতে হবে না আমচাষিদের। তারা বলছেন,  বিদেশে রফতানিযোগ্য নতুন এই আমটিই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রথম এবং একমাত্র রঙিন সংকরজাত।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রশাসনিক ভবন থেকে ডানদিকে কিছুদুর যেতেই দেখা মিলবে এই আমের। কাছে যেতেই দেখা গেল একটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে রঙিন আম। সৌন্দর্য আর রঙ উভয় মিলিয়ে মনকাড়া।

নতুন জাতের রঙিন আম গাছে ধরে থোকায় থোকায়।

২০০৫ সালে বারি আম-৩ ও আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে সংগ্রহকৃত পালমারের (পালমার আমেরিকার একটি রঙিন জাত) সংকরায়নে  নতুন এই জাতটি উদ্ভাবন করেছেন জেলার আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর জমির উদ্দিন। দীর্ঘ গবেষণার পর আসে এই সাফল্য। যা এখন উন্মুক্তকরণের অপেক্ষায়।’ 

গাছের নিচেই আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ডক্টর জমির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের এ প্রতিনিধির । তিনি জানান,‘ দীর্ঘদিন ধরেই চাষিদের চাহিদা ছিল বিদেশে রফতানিযোগ্য রঙিন আমের। দীর্ঘ ১৪ বছরের গবেষণার পর আমরা সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পেরেছি। পেরেছি চাষীদের চাহিদা পূরণ করতে।’ তিনি বলেন,‘ আগস্ট মাসের শুরুতে যখন বাজারে ভালো জাতের আমের সংকট দেখা দেয়; তখন বাজারে পাওয়া যাবে এই আম।’

বাজারের সব আম ফুরানোর পর আশ্বিনা ফজলির পাশাপাশি আগস্ট থেকে পাওয়া যাবে এই আম।

এই আম গবেষকের দাবি, লম্বাটে ও মাঝারি আকৃতির এই আমটি উচ্চ ফলনশীল। নিয়মিত ফলদানকারী আমটির গড় ওজন ২২০ গ্রাম। মিষ্টতা ২১ শতাংশ এবং ভক্ষণযোগ্য অংশ ৭৪.৬৭ শতাংশ। পাকা ফলের ত্বকের রঙ হতে পারে লাল অথবা মেরুন। শাঁস গাঢ় কমলা রঙয়ের, রসালো এবং আশঁবিহীন। রোগ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব তেমন নেই এবং এর সংরক্ষণকাল আটদিন।

ড. জমির উদ্দিন জানান, নতুন এই আমের নামকরণ হয়নি এখনও। তবে তিনি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানান, রঙিন এই জাত অবমুক্ত হলে সুযোগ তৈরি হবে বিদেশে রফতানিরও। এই তথ্য এরইমধ্যে কৃষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি নাবী জাত হওয়ায়, এই আমের স্থানীয় বাজারমূল্য নিয়েও আশাবাদী এই আম গবেষক।

এই গাছটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় নতুন জাতের রঙিন আমটির ফলন কেমন হতে পারে।

বিজ্ঞানী ড. জমির উদ্দিন আরও জানান,‘ দেশীয় বাণিজ্যিক জাত গোপালভোগ, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি অত্যন্ত সুস্বাদু হলেও এই জাতগুলি পোকামাকড়ের প্রতি সংবেদনশীল এবং রঙ বিহীন। এই কারণেই বিদেশের বাজারে এই জাতগুলোর তেমন চাহিদা নেই। তাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আমে ন্যাচারালি রঙ নিয়ে আসা। ২০০৫ সালের আগেও বহু গবেষণা চালানো হয়েছে কিন্তু, রঙ পাওয়া যায়নি। অবশেষে ২০০৫ সালে আমরা সংকরায়নের মাধ্যমে এই পদ্ধতিতে সফল হই। পরে এর বৈশিষ্ট্য নিয়মিত ফল ধরা এবং রঙ আসা ও দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করি। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের গবেষণার পর আমরা  সফলতা পেয়েছি এবং কৃষক পর্যায়ে এটিকে নিয়ে যেতে এখন আমরা অপেক্ষা করছি এর নামকরণ ও রিলিজের।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা জানান, ‘এরইমধ্যে ‘বারি-১৩’ নামে নামকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে এই জাতটির। আগামী দুই তিন মাসের মধ্যেই জাতটি রিলিজ হলে, এ বছরই শুরু হবে এর বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে চারা তৈরির কাজ।’

আমটির পরিচয় ও উদ্ভাবন সম্পর্কে জানাচ্ছেন ড. জমির উদ্দিন (ছবিতে ডানে)

দেশে অন্য যেসব লাল ও সিঁদুরে বর্ণের আম দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো কেন রফতানিযোগ্য নয় এমন প্রশ্নের জবাবে এই উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা জানান, দেশে এসব জাতের আম মূলত গুটি জাতের। এগুলো টক ধরনের, পাকলেও পুরো মিষ্টতা থাকে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এছাড়াও মাংসল অংশ তুলনামূলকভাবে কম, আঁশযুক্ত, আকারে ছোট ও ওজন কম হয়ে থাকে। ফলে এমন কিছু জাতের রঙ থাকলেও সেগুলো দেশি বাজারেই সেরা আমের তালিকায় আসতে পারে না। রফতানির সম্ভাবনা তো নেই-ই। তবে এ ধরনের আমের মানোন্নয়নে আরও অনেক কাজ করার আছে বলেও অভিমত দেন তারা। এদিক থেকে দীর্ঘ গবেষণায় উদ্ভাবিত রঙিন আমটি পুরোই ব্যতিক্রম।

নতুন জাতের রফতানিযোগ্য আম

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান,‘ আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত বহু জাতের সুস্বাদু আমের মধ্যে এটি হতে যাচ্ছে নতুন সংযোজন।’

তিনি বলেন,‘ এই আম চাষে চাষিরা ব্যাপক লাভবান হবেন এবং নাবী জাত হওয়ায় এর ভালো দাম পাবেন বলেই আমরা আশা করছি। জাতটি রিলিজ হলেই সারাদেশে চাষি পর্যায়ে এটিকে ছড়িয়ে দিতে প্রদর্শনী, চারা বিতরণ এবং নির্দেশনার আলোকে এই আমের সম্প্রসারণে দেশব্যাপী উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এখন আমটি রিলিজের অপেক্ষায় অতি উৎসাহী হয়ে তাকিয়ে আছে।’

দেশে বারি উদ্ভাবিত আমের ১২টি জাতের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত ৯টি নতুন জাতের আম উদ্ভাবন করেছেন এখানকার বিজ্ঞানীরা। সে হিসেবে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের তালিকায় এটি হবে ১০ম সংযোজন। দেশের খাতাতেও যোগ হচ্ছে আরেকটি নতুন জাত। বিদেশে রফতানিযোগ্য নতুন এই রঙিন আমটি দেশের আম বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে এটাই প্রত্যাশা করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘সাংগ্রাই জলোৎসব’ যেন পাহাড়ে এক মিলন মেলা
‘সাংগ্রাই জলোৎসব’ যেন পাহাড়ে এক মিলন মেলা
পাঁচ উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
বাজেট ২০২৪-২৫পাঁচ উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কাউন্সিলর-যুবলীগ নেতার সংঘর্ষে যুবক নিহত
টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কাউন্সিলর-যুবলীগ নেতার সংঘর্ষে যুবক নিহত
অনিবন্ধিত ও অবৈধ নিউজ পোর্টাল বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
অনিবন্ধিত ও অবৈধ নিউজ পোর্টাল বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’