কাপ্তাই হ্রদের আয়তন ৭২৫ বর্গকিলোমিটার। তবে বই-পুস্তক আর সরকারি নথিতে লেখা এই আয়তন বাস্তবে এখন আছে কিনা সন্দেহ। এ প্রশ্নর উত্তরও এই এলাকার সবার জানা। প্রভাবশালী দখলদারের আধিপত্যে নিত্যদিন জায়গা হারাচ্ছে এই হ্রদ। প্রতিনিয়ত চলছে অবৈধ দখল। এসব দখলদারদের সঙ্গে এখন সরকারি অন্য সংস্থাগুলোর দখলও শুরু হয়েছে। বর্তমানে সরকারি অর্থায়নেও কাপ্তাই হ্রদে অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে।
তবে জেলা প্রশাসনের দাবি কাপ্তাই হ্রদে অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ বন্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পাশাপাশি অনেক ভবনের কাজও বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, রাঙামাটিতে গত আড়াই বছরে প্রায় ৬০ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও কঠোরতা না থাকায় প্রশাসনের নির্দেশ খুব একটা মানছেন না প্রভাবশালী দখলদাররা।
অভিযোগ রয়েছে, রাঙামাটিতে পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে কাপ্তাই হ্রদ দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব’ নামে একটি বনেদি ক্লাব। পাশেই নিজেদের জায়গা থাকলেও সেখানে ভবন না বানিয়ে হ্রদেই ভবন নির্মাণ করছে ক্লাবটি। এদিকে হ্রদের ভেতর নির্মাণ করা এই ভবনটি অপসারণে জাতীয় নদী কমিশন ও ভূমি অফিস থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধু ফ্রেন্ডস ক্লাবই নয়, এভাবেই কাপ্তাই হ্রদে বিভিন্ন জায়গায় চলছে হ্রদ দখলের মহোৎসব। এছাড়াও জেলা পরিষদের অর্থায়নে হ্রদ দখল করে শহরে নির্মাণ হচ্ছে আরও একটি ভবন। অথচ আইনে, ১২০ ফুটের মধ্যে স্থাপনা তৈরির নিয়ম নেই। কিন্তু মানছেন কেউ। এভাবে একের পর এক গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা।
এদিকে হ্রদ দখল করে ফ্রেন্ডস ক্লাবের অবৈধ স্থাপনা অপসারণের পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় নদী কমিশন। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক বরাবরে সংস্থাটির পক্ষে সহকারী পরিচালক (গবেষণা ও পরিকল্পনা) মো. আশরাফুল হক একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘জরুরিভিত্তিতে রাঙামাটির ফ্রেন্ডস ক্লাব ভবন নির্মাণ বন্ধকরণ এবং অবৈধদখল উচ্ছেদসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধযোগ্য মামলা রুজুসহ আইনি ব্যবস্থাগ্রহণপূর্বক প্রতিবেদন সাত দিনের মধ্যে কমিশনে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ জাতীয় নদী কমিশনের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফ্রেন্ডস ক্লাবের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান চিংকিউ রোয়াজা বলেন, এসিল্যান্ড থেকে চিঠি পাওয়ার পর আপাতত কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা ভূমি অফিসের সাথে যোগাযোগ রেখেছি।
কাজটির দায়িত্বে থাকা জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী এরশাদুল হক বলেন, যে টাকা টেন্ডার হয়েছে তা দিয়ে ক্লাবের পুরো নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব নয়। আরও বরাদ্দ প্রয়োজন হবে। এই অর্থবছরে যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তা দিয়ে খুব বেশি কাজ এগোনো যাবে না। আবার হ্রদের পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে কাজও দ্রুত করতে হয়েছে। পাশাপাশি তার মন্তব্য, হ্রদের ওপর নির্মিত হওয়ায় খুব একটা সমস্যা হবে না।
শুধু ফ্রেন্ডস ক্লাব নয়, শহর প্রান্তে কাপ্তাই হ্রদের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে আরও অনেক ভবন ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। দখলদার হিসেব যারা অভিযুক্ত তাদের অনেকের রয়েছে নানারকম দাবি ও অভিযোগ। হ্রদপাড়ের এমনই একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে হোটেল সুফিয়া। জেলা প্রশাসনের হিসেবে এটি অবৈধ স্থাপনা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেল সুফিয়ার মালিক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার হোটেল করার অনুমতি পৌরসভা দিয়েছে ৯৪ সালে আর আমি হোটেল করেছি ৮৪/৮৫ সালে। যদি আমি অবৈধভাবে হোটেল করি থাকি তখন কেন আমাকে অনুমতি দিলো?’
তিনি আরও বলেন, ‘শহরের প্রান্তে হ্রদের তীরবর্তী স্থান দখল করে প্রতিনিয়ত বসতি স্থাপন হচ্ছে। সবার যা হবে আমরাও তাই হবে।’
রাঙামাটি পৌরসভার শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা ও সাবেক ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রবিউল আলম (রবি) অবৈধভাবে বসবাসের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, হেডম্যান কার্বারী মাধ্যমে কিছু মানুষ একশোনা বন্দোবস্তী নিয়ে আছেন আবার কেউ দীর্ঘদিন ধরে ক্রয়সূত্রে এখানে বসবাস করছে।
রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হ্রদের চারপাশে দরিদ্র মানুষের বসবাস গড়ে ওঠে। তখন মানবতার অজুহাতে কিছু বলা হয়নি। এখন প্রভাবশালীরাই ইচ্ছেমতো হ্রদের জায়গা দখল করছে। অথচ তখন যদি কঠোর হওয়া যেত, দখল ও বসবাস বন্ধ করা যেত তাহলে আজ বিষয়টি এই পর্যায়ে যেত না। কাপ্তাই হ্রদের তীরবর্তী স্থানে বসবাসরতদের উপশহরে স্থানান্তরের মাধ্যমে এর সমাধান ভাবছেন পৌরসভা মেয়র।
রাঙামাটি সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফাতিমা সুলতানা বলেন, পার্বত্য এলাকায় ভূমি বিষয়ে কিছু জটিলতার কারণে জরিপ কাজ এখনও শুরু হয়নি। কেউ নতুন বসতি তৈরির খবর পেলে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করে থাকি। বর্তমান ডিসি স্যারের নেতৃত্বে তিনি দায়িত্বে থাকালীন নতুন করে কোনও অবৈধ স্থাপনা তৈরি হতে দেননি। তবে সমস্যা হচ্ছে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে নোটিশ করলে তারা উল্টো আদালতে মামলা করে দেয়। মামলার জটিলতার কারণে অনেক সময় উচ্ছেদ কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
তিনি আরও বলেন, হ্রদ দখল করে ফ্রেন্ডস ক্লাবের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ ও কাজ বন্ধ রাখার জন্য চিঠি পাঠিয়েছি। এর জবাবে তারাও তাদের জমিতেই স্থাপনা করছে বলে আমাদের কাছে চিঠি দিয়েছে। ফলে তাদের চিঠি অনুযায়ী তাদের জায়গাটি আসলেই হ্রদের জায়গার ভেতরে পড়েছে কিনা তা যাচাই বাছাইয়ের কাজ চলছে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক ও কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি একেএম মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, হ্রদ দখল করে স্থাপনার বিষয়টি আমার নজরে আসার পর এসিল্যান্ডের মাধ্যমে তাদেরকে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়া ফ্রেন্ডস ক্লাবের ভবনটি নির্মাণে যেহেতু জেলা পরিষদ অর্থায়ন করছে, তাই তাদেরকেও বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। এছাড়া নদী কমিশনও এই বিষয়ে চিঠি দিয়েছে জেলা পরিষদকে।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষ কৃত চাকমা বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পে জেলা পরিষদ অর্থায়ন করে। হ্রদ দখলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে। তারা যেখানে জায়গা দিয়েছে সেখানে কাজ শুরু হয়েছে।