X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দিনাজপুরে করোনা ওয়ার্ড ফাঁকা, কমেছে সচেতনতাও

বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর
২৫ অক্টোবর ২০২০, ১১:০৫আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২০, ১২:১৮

দিনাজপুরে করোনার প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে পূজা প্যান্ডেলে দেওয়া হচ্ছে মাস্ক।




দিনাজপুরে কমেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সংখ্যা। গত ৭ মাসের গড় সংক্রমণ হারের চেয়ে গত মাস ও চলতি মাসে সংক্রমণের হার কম। এদিকে আক্রান্তের হার কমার পাশাপাশি কমেছে মানুষের সচেতনতাও। অনেক লোকজনই মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা, কেনাকাটাসহ যাবতীয় কার্যক্রম করছেন। নিজের এবং অন্যের স্বাস্থ্য সচেতনতায় মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব এসবের কথা বলা হলেও কিছুই মানা হচ্ছে না।




























দিনাজপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত (২৩ অক্টোবর) জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৮৬ জন। যার মধ্যে মারা গেছেন ৭৬ জন। এখন পর্যন্ত চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৭১ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ৪৩৯ জন। জেলায় মোট নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ২১ হাজার ৬৮৫টি এবং পরীক্ষা হয়েছে ২১ হাজার ২৪৪টি। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১৭ জন আর হোম আইসোলেশনে রয়েছেন ৫৪ জন। জেলায় যত রোগী শনাক্ত হয়েছেন তার প্রায় অর্ধেকই সদর উপজেলায়। এই উপজেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭৫২ জন, আর বাকি ১২টি উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৮৩৪ জন। যা গড়ে প্রায় ১৫৩ জন।

এক দোকানে ৬ জন মানুষ, কেনাকাটা চললেও কারও মুখে নেই মাস্ক।

হিসাব অনুযায়ী, মার্চ মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত এই জেলায় মোট ১০ হাজার ৯৯৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করে ১ হাজার ৭২৫টি নমুনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। সেই হিসেবে ওই ৪ মাসের একটু বেশি সময়ে করোনা শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর বাকি ৩ মাসের মধ্যে গত আগস্ট মাসে এই জেলায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৫ হাজার ৩৬৪টি, আর শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৫২ জন। শনাক্তের হার প্রায় ২৫ দশমিক ২১ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বর মাসে এই আক্রান্তের হার কমে যায়। গত সেপ্টেম্বর মাসে এই জেলায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ২ হাজার ৯১৪টি এবং শনাক্ত হয়েছেন ৩১৬ জন। শনাক্তের হার প্রায় ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। চলতি অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত এই জেলায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ হাজার ৯৬৭টি এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৯৩ জন। শনাক্তের হারে যা প্রায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। এছাড়া গত ৭ মাসে এই জেলায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সেই হিসেবে গত দুই মাসের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে শনাক্তের হারে এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিম্নমুখী।
এদিকে করোনা শনাক্তের হার নিম্নমুখী হলেও কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় পর্যায় আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য ২য় পর্যায় মোকাবিলায় সাতটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে ১ম পদক্ষেপই হচ্ছে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ ও ‘সেবা পেতে মাস্ক পড়ুন’। বাকি ৬টিতেও সচেতনতা, মনিটরিংসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরও মানুষের মধ্যে কোনও ধরনের সচেতনতা নেই। জেলার দোকানপাট, হাট-বাজার, সভা-সমাবেশ, জনসমাগম স্থানসহ সব স্থানেই দেখা যাচ্ছে কমপক্ষে অর্ধেক মানুষই মাস্ক পরছেন না বা পরলেও সঠিক নিয়মে না।

পূজার কেনাকাটায় বের হওয়া এটি পরিবার। অর্ধেক সদস্যের মুখে মাস্ক আছে, অর্ধেকের নেই।
কারও কারও মুখে মাস্ক নেই আবার কারও মুখে রয়েছে থুতনির নিচে। মানুষজন চলাফেরা করছেন গা ঘেঁষেই। গত ২ মাস আগেও যেখানে মাস্ক পরা না থাকলে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান কিংবা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা করতে দেখা গেছে, সেখানে এখন এসবের কিছুই নেই।

তবে পাল্টে গেছে হাসপাতালের চিত্র। করোনার রোগী সন্দেহে সব ধরনের রোগীই ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। দিনাজপুরের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ৩য় তলায় করা হয়েছে করোনা রোগীদের ওয়ার্ড যেখানে এখন কোনও রোগীই নেই। আর বাকি যেসব ইউনিট রয়েছে সেসবে ঠিক আগের নিয়মেই রোগীদের দেখাশোনা হচ্ছে। দু’তিন মাস আগেও জ্বর, সর্দি বা অন্য কোনও উপসর্গের রোগীদেরকে একটু দূর থেকেই সেবা প্রদান করা হতো। তবে এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। চিকিৎসক কিংবা নার্সদের মধ্যে করোনা ভীতি কেটে গেছে।

দোকানে ক্রেতার অপেক্ষায় থাকা দোকানিদের মুখে মাস্ক নেই।
করোনার প্রকোপ কমেছে এমন ধারণায় হাসপাতালের চিকিৎসক নার্সদেরও অনেকে শরীরে পিপিই পরছেন না। এটা যেমন দেখা গেছে চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনিভাবে সেবক-সেবিকাসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদেরও। এমন চিত্র দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালসহ সব হাসপাতাল-ক্লিনিকে। তবে সেবিকাদের মধ্যে শঙ্কা না থাকলেও কিছু কিছু চিকিৎসকের মধ্যে এখনও রোগীদের দূর থেকে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। যদিও তারা বলছেন যে, এই দূরত্ব বজায় রাখা শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষেত্রেই নয়, রোগীদের জন্য ভালো।
একটি বেসরকারি ক্লিনিকে এমনিভাবে চিকিৎসা প্রদান করতে দেখা যায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে। নাম না প্রকাশের শর্তে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘আসলে এই দূরত্ব বজায় রাখা শুধু আমাদের জন্যই নয় বরং রোগীদের জন্যও ভালো। কারণ, একজন চিকিৎসক প্রতিদিন অর্ধ শতাধিক রোগী দেখেন। অনেকের শরীরেই জীবাণু থাকতে পারে যা ওই চিকিৎসকের সংস্পর্শে আসতে পারে। আবার তা চিকিৎসকের শরীর থেকে ছড়াতে পারে নতুন কোনও রোগীর শরীরে। এটিও এক ধরনের সচেতনতা বা স্বাস্থ্য সুরক্ষার পন্থা।
দিনাজপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা এই হাসপাতালের সঙ্গে যারা জড়িত প্রথমে তারা পিপিই পরিধান করতাম। কিন্তু এই কাপড়টি পরিধান করে কাজ করা খুবই কষ্টকর। তাছাড়া প্রথমদিকে করোনা যতটা ভয়াবহ ছিল এখন তা নেই। সচেতন থাকতে হবে, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং সবসময় মাস্ক পরিধান করতে হবে তাহলেই এই রোগের সংক্রমণ থেকে দূরে থাকা যাবে।

ফল বাজারেও বিক্রেতাদের মুখে নেই মাস্ক


এদিকে যেসব রোগী করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের যেমন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার মন-মানসিকতা নেই, তেমনিভাবে করোনার উপসর্গ যাদের মধ্যে রয়েছে তাদের অনেকেই নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। জ্বর, সর্দি, কাশিসহ যাবতীয় উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। অবশ্য করোনার নমুনা পরীক্ষা না করা নিয়ে অনেকের অনীহার নানান কারণও আছে। এর মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে এখন অর্থ দিয়ে করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে হয় আর দ্বিতীয় কারণ যে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে নমুনা দেওয়া হচ্ছে সেখানেই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। আর তৃতীয় কারণ, অনেকেই ভুক্তভোগী হয়েছেন করোনার নমুনা পরীক্ষার ফল দেরিতে আসার জন্য।

এমন একজন ভুক্তভোগী দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার সাংবাদিক ধীমান চন্দ্র দাস, তিনি নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন ১৩ জুন তারিখে আর তার রিপোর্ট পেয়েছেন ১৫ দিন পর ২৮ জুন তারিখে, ততদিনে তিনি এই রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর ইউপি চেয়ারম্যান এএইচ নুর ইসলাম শাহ ১৩ জুন তারিখে নমুনা দিয়েছিলেন, তিনিও রিপোর্ট পান ১৬ দিন পর। এসব তথ্য জানার পর খুব মারাত্মক অসুস্থবোধ না করলে বেশিরভাগ মানুষই আর নমুনা দিতে আসছেন না। দিনাজপুরের রাজবাটী এলাকার সুশীল অধিকারী। জ্বর, সর্দি ও কাশি থাকলেও তিনি নমুনা দেননি। উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ খেয়েই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তার বক্তব্য যে যদি নমুনা দিতে যাই তাহলে সেখানে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় থাকবে, কারণ এখন কেউই সচেতন না।

করোনাকালে দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতার মাস্ক না পরার এ অভ্যাস বদলানো উভয়পক্ষের স্বাস্থ্যের জন্যই জরুরি।
দিনাজপুর জেলা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব ও জেলা সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমরা সবসময়ই মানুষজনকে সচেতন করছি। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং বাড়ির বাইরে সবসময় মাস্ক পরিধান করার কথা বলা হচ্ছে। এখন অনেকেই বিষয়টি মানছেন না। জেলার সর্বত্র করোনার বিষয়ে সচেতন করতে পোস্টার, ব্যানার ও স্টিকার সাঁটানো হয়েছে। মাইকিং করা হয়েছে, কিন্তু মানুষজন এখনও সচেতন হচ্ছে না। আসলে সচেতন হতে হবে নিজ ঘর থেকে তাহলেই এই রোগটিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
দিনাজপুর জেলা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শরিফুল ইসলাম জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য জেলার ১৪টি সরকারি হাসপাতালে ১৫০টি এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালে ১০, সর্বমোট ১৬০টি বেড প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে জরুরি চিকিৎসায় স্থানান্তরের জন্য একটি পৃথক বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা ও সরকারিভাবে জারিকৃত বিভিন্ন আদেশ অনুসরণে বাধ্য করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মাস্কবিরোধী অভিযান বন্ধ হয়নি, শুরু থেকে যেমন ছিল এখনও সেভাবেই চলছে।

আরও পড়ুন:

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোটি টাকা জরিমানা আদায়, তবুও মাস্ক ব্যবহারে বাড়ছে না সচেতনতা

শেরপুরে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই 

পিরোজপুরে কমেছে মাস্কের ব্যবহার

‘হাসপাতালে করোনার নমুনা আসছে কম’ 
স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই

/টিএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা