X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের দখলে ফেনীর সবজিবাজার

রফিকুল ইসলাম, ফেনী
২২ নভেম্বর ২০২০, ০৯:১০আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২০, ০৯:১০

ফেনীর সবজি বাজারের একটি খুচরা বিক্রেতার দোকান।  

মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের দখলে ফেনীর সবজিবাজার। প্রতিদিনই ঠকছেন চাষি ও খুচরা ক্রেতারা। অভিযোগ রয়েছে, সবজি চাষিরা সরাসরি খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন না। এ কারণে লাভের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে।

ফেনীর কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরেজমিনে ঘুরে কৃষক, খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ফেনীর শাকসবজির বাজার এতটাই চড়া, যার ফলে শুধু সবজি কিনতে হলেই কাড়ি কাড়ি টাকা গুণতে হচ্ছে ক্রেতাদের। দাম হু হু করে বেড়ে চলায় নাভিশ্বাস ওঠার দশা সীমিত আয়ের মানুষদের। মাছ-মাংস কেনা তো দূরে থাক, সবজি কিনতে গিয়ে পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে তাদের। বাজারভর্তি  শীতের শুরুতে সবজি থাকলেও তাতে হাত দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে গড়ে ৬০ টাকার নিচে কোনও সবজি নেই ফেনীর বাজারে।

শুক্রবার (২০ নভেম্বর) ফেনী শহরের বড় বাজার, সুলতান মাহমুদ পৌর হকার্স মার্কেট, মহিপাল, মুক্ত বাজার ও পাঁচগছিয়া বাজার গিয়ে দেখা যায়, আশেপাশের গ্রাম থেকে  চাষিরা এই সব হাটে বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে আসছেন বিক্রির জন্য।

পাঁচগছিয়া বাজারে লোকসানের ভারে হাটে আসা লাউ  চাষির মুখে কোনও হাসি নেই। প্রতিটি লাউ ২০/ ২৫ টাকাতেও কিনছেন না কোনও পাইকার। একই অবস্থা সব সবজির দামেও। তবে ফুরফুরে মেজাজে পান খেয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে ঘুরে ঘুরে সবজি কিনতে দেখা গেছে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া ও ব্যাপারীদের।  শুধু লাউ নয়, সব ধরনের সবজির দামই নিয়ন্ত্রণ করছেন ফড়িয়ারা।

পাশের গ্রাম বারাহী গোবিন্দ থেকে হাটে আসা চাষি জালাল আহমেদ অভিযোগ করেন, তার চাষের খরচের টাকাও উঠছে না। হাট নিয়ন্ত্রণকারী ফড়িয়াদের সিন্ডিকেটের কারণে তারা সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।

রতনপুর গ্রামের চাষি রবিউল ইসলাম জানালেন, তাকে প্রতিটি ভালো মানের জালি বা কচি চালকুমড়া বিক্রি করতে হয়েছে আট টাকায়। তিনি জানান, প্রতিটি জালি ১৪ টাকায় বিক্রি হলে লাভবান হতেন। আট টাকায় বিক্রি হওয়ায় তিনি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

দুমসদ্দা গ্রামের চাষি আকবর আলী ভালো মানের কাঁকরোল বিক্রি করেন ২৫ টাকা কেজি আর বরবটি বিক্রি করেন ৩০ টাকায়। এ দামে তার প্রচুর লোকসান হয়েছে। তিনি জানান, কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তবে কৃষক দাম না পেলেও খুচরা বাজারে অন্যচিত্র। সব সবজি পাইকারের কেনা দামের তুলনায় বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ কিংবা দ্বিগুণেরও বেশি দামে। সরেজমিন দেখা গেছে, খুচরা বাজারে লাউ বিক্রয় হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা,  টমেটো ৯০-১০০ টাকা, বেগুন ৫৫-৬০ টাকা, ঝিঙ্গা ৪৫-৫০ টাকা, মুলা ৪৫-৫০ টাকা, করলা ৫৫-৬০ টাকা, বরবটি ৭০-৭৫ টাকা, ফুলকপি ৮৫-৯০ টাকা, বাঁধাকপি ৫৫-৬০ টাকা, ঢেঁড়শ ৪৫-৫০ টাকা, শসিন্দা ৬০-৫৫, তরকারির শসা (বড়) ৫৫-৬০ টাকা, সালাদের শসা ৩০-৩৫ টাকা, পটল ৫৫-৬০ টাকা, গাজর ৬০-৫৫ টাকা, কাঁচামরিচ ২০০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া কেজি ৪৫-৫০ টাকা, প্রতি আঁটি পুঁইশাক ২৫ টাকা, কুমড়ার শাক ২৫ টাকা, লাল শাক ১৫ টাকা, পেঁপে ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে। এছাড়াও আলুর দর সরকার প্রথমে ৩০ টাকা ও পরে ৩৫ টাকা নির্ধারণ করলেও তা না মেনে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকার বেশি। লেবু প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৫-৬ টাকা।

কৃষক দাম পাচ্ছেন না কিন্তু, খুচরা বাজারে কেন এত বেশি দাম জানতে চাইলে শুরু হয় বরাবরের মতো খুচরা ব্যবসায়ী ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের চাপান-উতোড়। খুচরা ব্যবসায়ীরা এক সুরে দাবি করেন,  পাইকারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে রাখায় তাদের বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। এ কারণে বেশি দামে তাদের সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে।

মুক্ত বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াস জানান, আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে একই কাঁচামাল তিন ধরনের দামে বিক্রি করেন। ভোরবেলায় চড়া দাম থাকলেও সকাল ১০টার দিকে কেজিতে ৫-৭ টাকা কমে যায়। দুপুরে আরও ১০-১২ টাকা কমিয়ে বিক্রি করা হয়। সেই কারণে যেসব খুচরা ব্যবসায়ী ভোরবেলা আড়তদারের কাছ থেকে চড়া দামে কিনছেন তার আরও বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।

খুচরা ব্যবসায়ী মানিক মিয়া জানান, আড়তদাররা তিন রকম দামে কাঁচামাল বিক্রি করায় খুচরা বাজারে দাম ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। একই বাজারে পাইকারি দাম একই মালের ৭৫ টাকা আবার কোনও কোনও ব্যবসায়ী পরে তা ৭০ টাকা দিয়ে ক্রয় করেন। ফলে একই সবজি পরে যারা কম দামে কিনে আনছেন তারা যে দামে বিক্রি করছেন পাশের দোকান হিসেবে সেই দামে বিক্রি করতে গিয়ে ভোরে সবজি কেনা খুচরা ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

পৌর হকার্স মার্কেটে ব্যবসায়ী মিজান জানান, খুচরা ব্যবসায় এখন বোঝায় পরিণত হয়েছে। কাঁচামালের প্রতিটি ক্যারেটে দুই এক কেজি মাল পচা পড়ে। মালের ধরন অনুযায়ী ক্যারেটে ৪-৫ কেজিও পচা পড়ে। এতে লাভ তো দূরের কথা লোকসান গুনতে মাথায় হাত।

তবে এসব অভিযোগ শুনতে রাজি নন ফেনী কাঁচামাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। তিনি খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ অস্বীকার করে  জানান, যে সবজি তারা পাইকারি ৫০ টাকা দরে বিক্রি করেন তা কেন খুচরা বাজারে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়? খুচরা বিক্রেতাদের কেন প্রতি কেজিতে ২০ টাকাই লাভ করতে হবে? তারা তো কেজি প্রতি ৫-১০ টাকাও লাভ করতে পারেন।

তিন দামে সবজি বিক্রির বিষয়ে তিনি জানান, সবজি কাঁচামাল হওয়ায় রাখা যায় না। তাই সময়সাপেক্ষে কম-বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আগামী ১৫দিনের মধ্যে সবজির দাম অর্ধেকে নেমে আসবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে স্থানীয় এক বেসরকারি চাকরিজীবী নাম প্রকাশ না করে বলেন, আড়তদারদের সমিতি আছে। তাদের এখন এক ‘রা’। তারা কৃষকের কাছে কম দামে সবজি বা ফসল কিনবেন। সেটা আবার নিজেরা চোখের ইশারায় বেশি বাড়িয়ে এক দামে বেচবেন। ফলে কৃষকের কাছে কেনা দামের চেয়ে আড়তে তারা কেজি প্রতি ১০-১৫ টাকা মুনাফা করে পাইকারি দামে পণ্য বেচছেন। সেটাই কিনে আনছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা পাইকারদের কাছে জিম্মি দাবি করলেও নিজেদের লাভের অঙ্কের ব্যাপারে শতভাগ সজাগ। তারাও প্রতিটি সবজি কেজি প্রতি ২০টা লাভ না করে বিক্রি করছেন না। ফলে কৃষক পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেজি প্রতি ২০-২৫ টাকায়। সেটাই ক্রেতাকে কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। আড়তদার, পাইকার, খুচরা বিক্রেতারা সমিতি করে তাদের মুনাফা নিশ্চিত করলেও এবং তাদের ওপরে যারা ছড়ি ঘুরিয়ে চাঁদা আদায় করেন তারাও একজোট থাকায় কারও লাভে কমতি থাকে না। কেবল প্রান্তিক কৃষক পায় না ন্যায্যমূল্য আর বাজারে গিয়ে খাবি খাচ্ছে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের মানুষ।

তিনি বলেন, মূলত রাষ্ট্রে এসব দেখভাল করার কাজে নিয়োজিত মানুষদের দায়িত্বহীনতা কিংবা সামান্য উপরির আশায় চোখে ঠুলি পরে মুখে কুলুপ আঁটা,সাধারণ মানুষের একতা না থাকা, দাম বেশি বাড়ানা হলে পণ্য বর্জন করার প্রবণতা না দেখিয়ে বেশি দামি পণ্যের ওপরেই হামলে পড়া, কৃষকদের নিজেদের জোট না থাকা এভাবে দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী।  সাধারণ ক্রেতা ও প্রান্তিক কৃষকরা সব প্রতিকূলতা এড়িয়ে একজোট হয়ে নিজেদের দাবি প্রকাশ না করা পর্যন্ত এই সমস্যা দূর হওয়ার কোনও উপায় নেই। সেই দিন কবে আসবে কিংবা আদৌ আসবে কিনা তা কেউ জানে না।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
সর্বাধিক পঠিত
‘ভুয়া ৮ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে’
‘ভুয়া ৮ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে’
হজ নিয়ে শঙ্কা, ধর্ম মন্ত্রণালয়কে ‍দুষছে হাব
হজ নিয়ে শঙ্কা, ধর্ম মন্ত্রণালয়কে ‍দুষছে হাব
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
এবার নায়িকার দেশে ‘রাজকুমার’ 
এবার নায়িকার দেশে ‘রাজকুমার’ 
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫