X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারারগজ সংরক্ষিত বনের জমি লিজ নিতে প্রভাবশালী মহলের তৎপরতা

সাইফুল ইসলাম, মৌলভীবাজার
২৪ নভেম্বর ২০২০, ১৩:৫৪আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২০, ২১:২০

হারারগজ সংরক্ষিত বন মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের সাগরনাল, পুটিজুড়ি, রাঘনা, গাজীপুর এলাকা জুড়ে হারারগজ সংরক্ষিত বনের অবস্থান। সংরক্ষিত এই বনে রয়েছে বাঁশমহাল। বনটি নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বর্তমানে একটি প্রভাবশালী মহল সংরক্ষিত এই বনের দুই হাজার ১৭৪ দশমিক ৩৫ একর জমি চা বাগানের জন্য লিজ নিতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

বনবিভাগ সূত্র জানায়, জুড়ী-১ রেঞ্জের আওতাধীন হারারগজ সংরক্ষিত বন জরিপের বাইরে ছিল। ২০১০ সালে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর ডিজিটাল পদ্ধতিতে বনটির জরিপ কাজ শেষ করে। জরিপ শেষে ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট হারারগজ বন মৌজায় (জেএল নং-৭৮) ডিসির নামে ২ হাজার ১৭৪ দশমিক ৩৫ একর জমি রেকর্ড হয়। একই মৌজায় বন বিভাগের নামে রেকর্ড হয় ১১ হাজার ৬৮ দশমিক ৮৯ একর। পরে ওই জমির গেজেটও সম্পন্ন হয়ে যায়।

অথচ ২০০১ সালে প্রণীত ভূমি রেকর্ড ও নকশাবিষয়ক নির্দেশাবলিতে বলা হয়, ১৯২৭ সালের বন আইনের ২০ ধারা বলে সংরক্ষিত বন হিসেবে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনের অন্তর্ভুক্ত সব জমি বন বিভাগের নামে রেকর্ড হবে। এছাড়া বন বিভাগ প্রত্যর্পণ না করলে রিজার্ভড, প্রটেক্টেড বা অ্যাকোয়ার্ড হিসেবে চিহ্নিত বনের কোনও জমি কারও নামে রেকর্ড করা যাবে না।

২০১৫ সালের ১৪ জুলাই তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে মৌলভীবাজারের ভূমি ট্রাইব্যুনাল আদালতে রেকর্ড সংশোধনের জন্য একটি মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নং-২৩৪/২০১৬৫। মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি।

সিলেট বিভাগের উপ-বন সংরক্ষক এসএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি বাণিজ্যিক চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ট্রাইব্যুনালে চলতে থাকা মামলার নিষ্পত্তি সাপেক্ষে ইজারাপ্রাপ্তির গ্রিন সিগন্যাল পায়।’

এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি চিঠি ভূমি মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখানে বন বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে নিজেদের জায়গা ফিরে পেতে কোনও চা বাগানকে তা লিজ দিতে আপত্তি জানানো হয়। এ ব্যাপারে মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মল্লিকা দে জানান, আদালতে মামলা চলমান। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনা চলছে। মূলত জমিটি আমাদের। এখন বনবিভাগ দাবি করছে ওই জমিটি তাদের।

জানা যায়, ১৯২১ সালের ২৪ অক্টোবর তৎকালীন আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার জরিপ না করা ১২ হাজার ১৯ একর বনভূমিকে ‘হারারগজ রিজার্ভ ফরেস্ট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আসাম ফরেস্ট রেগুলেশন ১৮৯১-এর অধীনে রিজার্ভ ফরেস্ট বা সংরক্ষিত বন ঘোষণার পর আরও কয়েকশ’ একর জায়গা এ বনভূমির অধীনে সংরক্ষিত ঘোষণা করার ফলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ এর জরিপ না করা মোট বনভূমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৭৬৮.৮০ একর। তবে ১৯৩৩ সালে পার্শ্ববর্তী পৃথিমপাশা এস্টেটের দায়ের করা একটি স্বত্ব মামলার রায়ে ১৯৩৭ সালে এক হাজার ৯৮৭.৮৫ একর বনভূমি এই সংরক্ষিত বন থেকে খারিজ করে এস্টেটকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনে জমিদারি প্রথা বাতিলের পর ১৯৫৬ সালে এস্টেটের সব ভূমি রাষ্ট্রায়ত্ত হয় এবং ১৯৬০ সালে এই এক হাজার ৯৮৭.৮৫ একর জায়গাসহ মোট পাঁচ হাজার ৩৩৭ একর ভূমি বন বিভাগকে হস্তান্তর করা হয়। তবে ১৯৩৮ সালে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে খারিজ হওয়া এক হাজার ৯৮৭.৮৫ একর বনভূমি সংরক্ষিত বনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এমন কোনও নথি পাওয়া যায়নি। তবে এই ভূমিসহ এই অঞ্চলের সব বনাঞ্চল বন হিসেবেই রক্ষণাবেক্ষণ করছে বন বিভাগ।

হারারগজ সংরক্ষিত বনের জমি লিজ নিতে প্রভাবশালী মহলের তৎপরতা উপ-বন সংরক্ষক এসএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘এই ডিজিটাল জরিপে অনেক ভুল হয়েছে। বনের সীমা অজরিপকৃত হলেও এর চৌহদ্দি নির্ধারিত ছিল, কিন্তু তারা তা বিবেচনা করেনি। বনের ওপর অসৎ উদ্দেশ্যে বনের মধ্যবর্তী ভূমিকে খাস ভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং সেই ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে টিলার মতো ভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে যেকেউ ইজারা পায়।’

বিষয়টি সুরাহা করতে ২০১৪ সালে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক মো. আব্দুল মান্নান এই সংরক্ষিত বন পরিদর্শন করেন। তিনি একটি প্রতিবেদন বন বিভাগের দাবির পক্ষে সম্মতি জানিয়ে উল্লেখ করেন যে, জরিপে বনের জমির শ্রেণি ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই বনাঞ্চলে ১৯৩৩ সালের পৃথিমপাশা এস্টেটের মামলায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করা এক হাজার ৯৮৭.৮৫ একর ভূমিই কেবলমাত্র খাস ভূমি হিসেবে নথিভুক্ত করা যেতে পারে, বনের মধ্যবর্তী অংশ থেকে নয়। তবে এই বনাঞ্চলের কোনও ভূমিই ইজারা দেওয়া যাবে না বলেও প্রতিবেদনে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসকে এই ইচ্ছাকৃত ভুলের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন। বরং এর মধ্যেই তড়িঘড়ি করে এই ভূমি ‘খাস’ হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে এই রেকর্ড সংশোধনের জন্য মৌলভীবাজার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে জেলা প্রশাসন, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর ও জুড়ী উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে বন বিভাগ।

তিনি বলেন, ‘বনের অংশ যদি চা-বাগান সম্প্রসারণ বা অন্য যেকোনও উদ্দেশ্যে ইজারা দেওয়া হয়, তাহলে তা এক সময় এই সংরক্ষিত বন এবং এর আশপাশের বনভূমিকে ধ্বংস করে দেবে।’

জুড়ী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোস্তাফিজুর রহমান রহমান জানান, এ পর্যন্ত ১০-১২টি আবেদন জমা পড়েছে ইজারা নিতে। তার আগে একটি চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এই ভূমি দীর্ঘমেয়াদে ইজারা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে চলতি বছর জানুয়ারির ২৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি পাঠায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি ভূমি সচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-১৪ জসীম উদ্দীন হায়দার। এ চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, যেহেতু এ জমি নিয়ে একটি মামলা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল মৌলভীবাজারে চলমান, তাই মামলা নিষ্পত্তি সাপেক্ষে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জুড়ী উপজেলার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) এই ভূমি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে তিনি ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে এই ভূমি পতিত, জনবসতিহীন এবং অনাবাদি হিসেবে উল্লেখ করে দাখিল করা হয়।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় গত ৯ সেপ্টেম্বর এবং ২৩ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে নিয়ে দুটি বৈঠকে বসে। তবে সে বৈঠকের রেজুলেশন প্রকাশ না করায় তার সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। বৈঠকে বনের গুরুত্বপূর্ণ এই জমি লিজ না দিতে এবং বনের জায়গা বনকে ফিরিয়ে দিতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি উত্থাপন করা হয়। বন বিভাগের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মল্লিকা দে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেট বিভাগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘হারারগজ সংরক্ষিত বনের যে অংশ জমি নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে তা ওই বনের প্রাণকেন্দ্র। কোনোভাবেই বনের এই অংশ লিজ নিতে দেওয়া যায় না। যারা এই বনের ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করেছেন তাদের সবাইকে তদন্তের মাধ্যমে শনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। এই বন রক্ষায় আন্দোলনে যেতে হয়, তাহলে যাবো। তবে কোনোভাবেই বনের জমি লিজ দিতে দেওয়া হবে না।’

এ ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান বলেন, ‘বনের জমি খাস খতিয়ানভুক্ত করা নিয়ে এ ধরনের বিরোধ সারাদেশেই লেগে আছে। হারারগজ সংরক্ষিত বনের এই ভূমি সংক্রান্ত মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু জানা নেই। বনের জমি ইজারা দেওয়ার কোনও উদ্যোগের বিষয়েও আমি আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত না।’

 

/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
বিতর্কের মুখে গাজায় ইসরায়েলি কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়েছেন মালালা
বিতর্কের মুখে গাজায় ইসরায়েলি কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়েছেন মালালা
‘পাতানো ম্যাচ’ নয়, মাঠে খেলেই এগিয়ে যেতে চায় স্বাধীনতা
‘পাতানো ম্যাচ’ নয়, মাঠে খেলেই এগিয়ে যেতে চায় স্বাধীনতা
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না