কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে স্বেচ্ছায় রাজি ৩৯০ রোহিঙ্গা পরিবারের এক হাজার ৬৪২ জন সদস্য শুক্রবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুর ২টার দিকে নোয়াখালীর ভাসানচরে পৌঁছেছেন। চট্টগ্রামের বোটক্লাব এলাকায় কর্ণফুলী নদীপথ হয়ে বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সাতটি জাহাজে ভাসানচর পৌঁছান তারা। এর আগে বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) সকাল থেকে ‘চল চল ভাসানচর চল’ স্টিকার লাগানো ৪২টি বাসে করে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ভাসানচরের উদ্দেশে চট্টগ্রামে পৌঁছান তারা।
রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটির ভাসানচরে পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন ভাসানচর উপ-প্রকল্পের পরিচালক কমান্ডার এম আনোয়ারুল কবির।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দৌজা বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা ভাসানচরের ঘাটে পৌঁছান। তাদের সবাইকে আবাসন সেন্টারে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ৩৯০ পরিবারের এসব মানুষ ভাসানচরের আবাসন দেখে মুগ্ধ।'
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক (ডিসি) খোরশেদ আলম খান বলেন, ‘শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা জাহাজে করে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেন। দুপুর ২টার দিকে তারা ভাসানচরের ঘাটে পৌঁছান। এর আগে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির থেকে নিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রামে রাখা হয়েছিল। এখন পরবর্তী বিষয়টি আমাদের নৌবাহিনী দেখবেন।’
আরআরআরসি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সকাল ৬টার দিকে দুটি জাহাজে মোট এক হাজার ১৯টি লাগেজ পাঠানো হয়। এরপর সাড়ে ১০টার দিকে রোহিঙ্গাদের বহনকারী জাহাজগুলো রওনা হয়। এক হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গাদের বহনকারী জাহাজের ছয়টি নৌবাহিনীর ও একটি সেনাবাহিনীর। সেনাবাহিনীর জাহাজটির নাম ‘শক্তি সঞ্চার’। এরমধ্যে স্কট জাহাজও রয়েছে। এর আগের দিন স্বেচ্ছায় যেতে রাজি হওয়ায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এসব রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার উখিয়া থেকে সড়ক পথে নিয়ে আসা হয়েছিল চট্টগ্রামে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ঠিক ১১টা ২৫ মিনিটে কক্সবাজারের উখিয়া কলেজ গেট থেকে ‘চল চল ভাসানচর চল’ এই নামে স্টিকার লাগানো একে একে বেরিয়ে আসে রোহিঙ্গা বহরের ১০টি বাস। একইভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪২টি রোহিঙ্গাবাহী বাস রওনা করে চট্টগ্রামের দিকে। এর আগে তাদের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে নিয়ে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় উখিয়া ট্রানজিট পয়েন্ট এবং কলেজের অস্থায়ী ট্রানজিট ঘাটে রাখা হয়। পরে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করে ভাসানচরের উদ্দেশে পাঠানো হয়।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওমর হামজাসহ তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে শেষ বিদায় জানাতে আসেন তার মা রহিমা খাতুন (৬০)। এই বৃদ্ধা নারী বলেন, ‘ছেলে ভাসানচরে চলে যাচ্ছে, তাকে শেষ বিদায় জানাতে এসে খুব কষ্টে হচ্ছে। আসলে বিদায় যে এত কষ্টের আগে জানতাম না। জানি না ছেলেকে আবার দেখতে পারবো কিনা।’ তিনি বলেন, ‘তবে আশা করছি এখানকার থেকে তারা ভাসানচরে পরিবার নিয়ে সুখে থাকবে। বাকিটা সেখানে যাওয়ার পর বলতে পারবো।’
নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) দীপক জ্যোতি খীসা বলেন, ‘কক্সবাজারের শরাণার্থী শিবিরের একটি দল শুক্রবার দুপুরে ভাসানচরে পৌঁছেছে। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১২০টি ক্লাস্টার নিয়ে তৈরি ভাসানচর এক লাখ মানুষের আবাসনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। রোহিঙ্গা শরণার্থী ছাড়াও এখানে এনজিও কর্মকর্তা, দূতাবাসের কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য উন্নত ও আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।’
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলা, নিপীড়ন ও হত্যার কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এছাড়াও এর আগে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। বর্তমানে তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ১১ লাখ। এ পরিস্থিতির মধ্যেই রোহিঙ্গাদের উখিয়া ও টেকনাফের ঘিঞ্জি ক্যাম্পগুলো থেকে সরিয়ে আরও নিরাপদে রাখতে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নিজস্ব অর্থায়নে বিপুল ব্যয়ে এই আশ্রয় ক্যাম্প নির্মাণ করেছে সরকার। ভাসানচরের আশ্রয়ক্যাম্পে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করতে পারবে।
তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের এই দলটিই প্রথম আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছে না। এর আগে গত মে মাসে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দুই দফায় নারী-শিশুসহ মোট ৩০৬ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের কথা বলে সরকার তাদের ভাসানচরে নিয়ে রেখেছে।
দেখুন ভিডিও...