X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে তিস্তা-ধরলার সুস্বাদু বৈরালি মাছ

মোয়াজ্জেম হোসেন, লালমনিরহাট
২০ জুলাই ২০১৮, ০৭:৫৩আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৮, ১৪:১০

 বৈরালি মাছ লালমনিরহাটের তিস্তা ও ধরলা নদীতে পানি সংকটে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বৈরালি মাছ। ব্যাপক চাহিদা থাকলেও সুস্বাদু এই মাছটি জেলেদের জালে আর আগের মতো ধরা পড়ে না। যেটুকু পাওয়া যায় বাজারে তা বিক্রি হয় অত্যধিক চড়া মূল্যে। উত্তরাঞ্চলে অসম্ভব জনপ্রিয় এই মাছের সংকট স্থানীয়দের মধ্যে গভীর হতাশার জন্ম দিয়েছে। এলাকাবাসীসহ বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, উজানে ভারতের একাধিক জায়গায় ও বাংলাদেশের হাতিবান্ধায় সেচের জন্য বাঁধ দেওয়ার ফলে তিস্তা নদীতে স্রোত কমে চর পড়ে যাওয়ায় এবং ধরলা নদীর বাংলাদেশ অংশে পানি কম প্রবাহিত হওয়ায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে বৈরালি মাছ। একই কারণে নদীর দেশি প্রজাতি মাছের সংখ্যাও কমে গেছে মারাত্মকভাবে। হারিয়ে গেছে শুশুক, ঘড়িয়াল, মিঠা পানির কচ্ছপসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী।

স্থানীয়ভাবে বৈরালি বা বৈরালী নামে পরিচিত এই মাছটিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ডাকা হয় বোরালি নামে। বই-পত্রেও এটি বোরালি নামে চিহ্নিত। বোরালি মাছের বৈজ্ঞানিক নাম-বারিলিয়াস বারিলা (Barilius Barila)। এটি মূলত স্বচ্ছ পানির মাছ। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা নদী তিস্তা-ধরলায় এই মাছ পাওয়া যায়। তিস্তা-ধরলার ধারা নামায় ব্রহ্মপুত্র নদীতেও এই মাছ কিছু পরিমাণে মেলে। বাংলাদেশে কেবল উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামেই এই মাছ পাওয়া গেলেও বৈরালি বা বোরালি মাছের বিস্তার ভারত, নেপাল, মিয়ানমারের পাহাড়ি নদীগুলো জুড়েই।

বোরালি মাছ সর্বোচ্চ ৬-৭ ইঞ্চি বা ১০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং প্রস্থে প্রায় ১ ইঞ্চি আকারের হয়ে থাকে। রূপালী রঙের মাছটির গায়ে ছোট ছোট আঁশ, পিঠের রং হালকা মেটে। পেটের নিচে হলুদ দাগ থাকে। মাছটির পুঁটি মাছের মতো কাঁটা থাকলেও তা খুবই নরম। বৈরালি মাছ গ্রীষ্মকালীন সময়ে বংশ বিস্তার করে থাকে।

বাজারে বিক্রি হচ্ছে বৈরালি মাছ (সাদা) দ্রুতগতির এই মাছটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা ইলিশ মাছের মতোই। তীব্র স্রোতে উজানের দিকে ছুটে চলে বোরালির ঝাঁক। দিনের বেলা গভীর পানিতে সরে গেলেও সাধারণত বিকাল থেকে রাতের দিকে মাছটি নদীর কিনারের দিকে পানির ওপরের স্তরে ঝাঁক বেঁধে চলে আসে। জেলেরা ছোট ছোট ‘চটকা জাল’ (হাতে টানা জাল) দিয়ে বৈরালি শিকারও করেন বিকাল থেকে রাতের মধ্যেই।

জেলেরা জানিয়েছেন, ইলিশ মাছের মতোই বৈরালি মাছ জালে ধরার পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। আবার দ্রুত বরফ দিতে না পারলে বেশিক্ষণ সংরক্ষণও করা যায় না।

স্থানীয় একজন গৃহিণী তহুরা ইসলাম জানান, বৈরালি খুবই সুস্বাদু মাছ। সাধারণত বৈরালি মাছ ভুনা করে রান্না করা হয়। এছাড়াও কেউ কেউ আলু, পটল, ঝিঁঙ্গার মিশেল দিয়ে হালকা ভাজি করে। এছাড়াও আলুর ডালের মধ্যেও বৈরালি মাছ দিয়ে রান্না করেন অনেকে। এর স্বাদের তুলনা হয় না।

এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহবুব রানা ও মাহমুদুন্নবী পামেল জানান, বৈরালি মাছ এমনই সুস্বাদু যে রংপুর এলাকার বাইরের কোনও অতিথি বাসায় এলে এই মাছটি খাওয়ার জন্য আবদার করে থাকেন। আমরাও তাকে আপ্যায়ন করার জন্য চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় দিনের পর দিন বাজারে ঘুরেও বৈরালি মাছের দেখা মেলে না।

বৈরালি মাছ তারা জানান, বাজারে খুব সামান্য পরিমাণে বৈরালি মাছ ওঠায় এর দামও অনেক বেশি। মাঝারি আকৃতির মাছ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বড় আকৃতির (৬ থেকে ৮ ইঞ্চি) বৈরালি দুষ্প্রাপ্য। কখনও পাওয়া গেলে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি দাম ওঠে।

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, তিস্তা ও ধরলা নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করে সেচ কাজের জন্য এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভাটিতে তথা বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ও ধরলায় প্রকট আকারে পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই দুই নদী থেকে বৈরালি মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণির বিলুপ্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

তিস্তা ব্যারাজের কাছে অবস্থিত গড্ডিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার রহমান বলেন, ‘আশি বা নব্বইয়ের দশকে তিস্তা ও ধরলায় শুশুক, ডলফিন, ঘড়িয়াল প্রায়ই দেখা যেত। বোরালি মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু, বর্তমানে তিস্তা ও ধরলায় পানি সংকটের কারণে বাংলাদেশ অংশে এসব মাছ ও প্রাণি চোখে পড়ে না। তবে এই দুই নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে হওয়ায় এখনও এসব প্রাণি ও মাছ দেখা যায়। এসব জলজ প্রাণি ও দেশি মাছের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

বৈরালি মাছ হাতে নিয়ে দেখাচ্ছেন বিক্রেতা এদিকে, বর্তমানে সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে মাছটির বংশ বিস্তার এবং পুকুরে চাষযোগ্য কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খোন্দকার রশীদুল হাসান বলেন, ‘তিস্তা ও ধরলা নদীতে বোরালি মাছটি মূলত পাওয়া যায়। পানি সংকটের কারণে বিলুপ্তির পথে উচ্চতর স্বাদের মাছটি। এটি সংরক্ষণ এবং বিস্তার করতে ইতোমধ্যে গবেষণার জন্য স্কিম প্রস্তাব আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে আমরা কিছু মাছ তিস্তা নদী থেকে সংগ্রহ করেছি। কৃত্রিম প্রজননসহ যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজও শুরু হয়ে গেছে। স্কিমটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে আনুষ্ঠানিকভাবে গবেষণার কাজ শুরু হবে।’

জানতে চাইলে লালমনিরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সবেমাত্র লালমনিরহাটে নতুন যোগদান করেছি। শুনেছি তিস্তা ও ধরলায় বোরালি নামে একটি উচ্চ স্বাদের সুস্বাদু মাছ পাওয়া যায়। এখনও মাছটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারিনি। তিনি আরও জানান, ‘লালমনিরহাট জেলায় প্রাকৃতিক উৎসের দেশি মাছের পাশাপাশি চাষের মাছও চাহিদার তুলনায় সংকট রয়েছে। এই জেলায় প্রতিদিন প্রতিজন মানুষের জন্য ৬০ গ্রাম মাছ প্রয়োজন। সেই হিসেবে বাৎসরিক মাছের চাহিদা ২৮ হাজার ৫৮৪ দশমিক ৯৩ মেট্রিক টন কিন্তু উৎপাদনে ১০ হাজার ১২৪ দশমিক ৯৩ মেট্রিক টনই ঘাটতি রয়েছে।’

বৈরালিসহ (সাদা) বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিক্রি করছেন বিক্রেতা লালমনিরহাট জেলা মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় তিস্তা, ধরলা, সানিয়াজানসহ মোট ১৩টি নদী রয়েছে। এসব নদী মোট ১৯৬১ হেক্টর জমির মধ্যে রয়েছে। তাছাড়াও জলাশয়ের মধ্যে বিল ১ হাজার ১৯৬ হেক্টর, পুকুর ২ হাজার ৫৩৩ দশমিক ৪২ হেক্টর, ধান ক্ষেত ১ হাজার ৬৩৪ হেক্টর, বোরোপিট ১১৩ দশমিক ৮০ হেক্টর, পেন কালচার ১৫০ দশমিক ৫০ হেক্টর, প্লাবন ভূমি ২ হাজার ২১০ দশমিক ৪০ হেক্টর ও খাল ২৮৬ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ ও উৎপাদন থাকে। এসব উৎস থেকে সারাবছর ১৮ হাজার ৪৬০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে জেলাবাসীর সারা বছরের মোট চাহিদা থেকে এই উৎপাদন ১০ হাজার ১২৪ দশমিক ৯৩ মেট্রিক টন কম।

লালমনিরহাট সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তারিফুর রহমান সরকার বলেন, ‘লালমনিরহাটে বাৎসরিক রেণু পোনার চাহিদা ৯ হাজার ৫৪৮ কেজি। ৬৪৮টি নার্সারের ৭৩৭টি পুকুরে ৫২শ ৬০ কেজি রেণু পোনা উৎপাদন করা হয়। এখনও ৪২শ ৮৮ কেজি রেণু পোনা উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। যা বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া ৫-৬ ইঞ্চি পোনার চাহিদা ১৬শ ৩০ মেট্রিক টন। ৩৫০ জন পোনা চাষী ৬৪৩টি পুকুরে ১৫শ ১৩ দশমিক ১৩ মেট্রিক টন উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও ১শ ১৬ দশমিক ৮৭ মেট্রিক টন উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। মৎস্য বিভাগ চেষ্টা করছে এসব ঘাটতি মোকাবিলা করার।



/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৮ এপ্রিল, ২০২৪)
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
সর্বাধিক পঠিত
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই