কুড়িগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গবাদিপশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে লাম্পি স্কিন রোগ (এলএসডি)। ভাইরাসজনিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গত দুই সপ্তাহে অন্তত সাতটি গরু মারা যাওয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষক ও গৃহস্থরা। কোরবানি ঈদের আগে গবাদিপশুতে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা বলছেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এ বছর বর্ষা মৌসুমের আগেই লাম্পি স্কিনের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। তবে তা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়াচ্ছে।
সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়ন, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ও সাহেবের আলগা ইউনিয়নে গত কয়েকদিনে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে সাতটি গরু মারা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু উলিপুর নয়, জেলা সদর, রৌমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলাতেও এই রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন আক্রান্ত পশুর সংখ্যা
বাড়ছে। সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক না থাকায় সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রাণী চিকিৎসকরা।
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও আক্রান্ত পশু ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই। আক্রান্ত পশু অনেক সময় ভুল চিকিৎসার কারণে মারা যেতে পারে।
লাম্পি স্কিন রোগ কী
এটি ভাইরাসজনিত রোগ। মশা, মাছি ও খাবারের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে এই রোগ ছড়ায়। এর কারণে গরুর শরীরজুড়ে ছোট ছোট মাংসপিণ্ডের মতো ফুলে ওঠে। গত কয়েক বছর ধরে দেশের গবাদিপশুতে এই রোগ দেখা যাচ্ছে।
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, মূলত একপ্রকার পক্স ভাইরাস বা এলএসডি ভাইরাসের সংক্রমণে গবাদিপশুতে এই রোগ দেখা দেয়। এটি এক গরু থেকে আরেক গরুতে ছড়ায়। গরুর চামড়ার ওপরের অংশে গোটা সৃষ্টি হয়। সাধারণত বর্ষার শেষে, শরতের শুরুতে অথবা বসন্তের শুরুতে মশা-মাছির মাধ্যমে এই রোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। দুধ ও লালার মাধ্যমেও এটি আক্রান্ত গরু বা মহিষ থেকে বাছুরে ছড়াতে পারে। একেক এলাকায় একেক ধরনের বাহকের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়।
চিকিৎসা
লাম্পি স্কিনের সরাসরি কোনও চিকিৎসা নেই। সরকারিভাবে এর কোনও টিকা দেশে নেই। বেসরকারিভাবে কিছু টিকা পাওয়া গেলেও তা ব্যয়বহুল। তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধের জন্য লক্ষণ দেখে চিকিৎসা প্রয়োগ করতে হয়। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে এই রোগে মানুষ আক্রান্ত হয় না।
কুড়িগ্রামে প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা
উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র ও ধরলাবেষ্টিত বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের কৃষক বাবুল বলেন, ‘কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য কয়েকটি গরু পালন করেছি। কিন্তু চারটি গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে, এর মধ্যে একটি মারা গেছে।’
বাবুল বলেন, ‘যে গরুটি মারা গেছে, সেটির দাম লাখ টাকার ওপরে হবে। চামড়ায় ঘা থাকায় বাকিগুলো বিক্রি করা যাবে না। গ্রামের অনেকের গরু একই রোগে আক্রান্ত।’
কোরবানির ঈদে বিক্রি করে কিছু টাকা আয়ের আশায় কালো রঙের একটি ষাঁড় পালন করছেন ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কানাপাড়ার কৃষক মান্নান মিয়া। কিন্তু লাম্পি স্কিন রোগে সে আশায় গুঁড়েবালি। মোটাতাজা গরুটি এখন হাড্ডিসার। চামড়ায় শত শত ঘা।
মান্নান বলেন, ‘প্রায় একমাস ধরে গরুর চিকিৎসা করাইলাম। কিন্তু অহনও ভালো হয় নাই। হাটে তোলার অবস্থা নাই।’
একই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন স্থানীয় কৃষক আব্দুল মজিদ। তার আক্রান্ত দুটি গরুর মধ্যে একটি মারা গেছে।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও পল্লী চিকিৎসক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এলাকায় অনেক গরুর মধ্যে লাম্পি স্কিন রোগ দেখা দিয়েছে। গত কয়েকদিনে তিন-চারটি মারা গেছে। প্রতিদিন আক্রান্ত গরুর সংখ্যা বাড়ছে।’
তবে আক্রান্ত পশু ও মৃত্যুর কোনও তথ্য জানাতে পারেননি উলিপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা চিকিৎসক মো. রেজওয়ানুর হক।
বিরূপ আবহাওয়ায় এ বছর বর্ষার আগেই এই রোগ ছড়াচ্ছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তবে সেটি বিক্ষিপ্তভাবে ছড়াচ্ছে। এই রোগে সাধারণত পশু মারা যায় না। অনেক সময় ভুল চিকিৎসায় মারা যায়। আমরা কৃষক ও খামারিদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।’
রৌমারী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। গরুর মৃত্যুর খবরও পেয়েছি। তবে তা কম।’
গরুর মৃত্যু হলেও রোগ ছড়ানোর খবর জানেন না প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা
লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত হয়ে গরুর মৃত্যু শুরু হলেও এই রোগ ছড়ানোর খবর জানেন না জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) চিকিৎসক মো. ইউনুছ আলী।
এ বছর কুড়িগ্রামে লাম্পি স্কিন এখনও সেভাবে দেখা যায়নি দাবি করে এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, ‘এই রোগ প্রতিরোধে আমরা গোট পক্স টিকা দিয়ে থাকি। আক্রান্ত পশুর লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এতে আক্রান্ত পশুর সুস্থ হওয়ার হার প্রায় ৮০ শতাংশ।’
