মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় (এসএসসি) পাঁচ বছর ধরেই ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। শুধু মাধ্যমিক নয়, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায়ও অংশগ্রহণ বাড়ছে ও ভালো ফলাফল করছে মেয়েরা। অন্যদিকে, ছেলেদের অংশগ্রহণ কমছে এবং ফলাফলেও তারা ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থসামাজিক কারণে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অংশগ্রহণ কমছে। নানা কারণে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। এছাড়া ছেলে শিক্ষার্থীদের একাংশ চলে যাচ্ছে কওমি মাদ্রাসায়, ফলে তাদের হিসাবটা এসএসসিতে আসছে না।
এসএসসিতে ছেলেদের রেজাল্ট খারাপের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, মোবাইলে আসক্তি, কিশোর গ্যাংয়ে সংশ্লিষ্ট হওয়াসহ নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে ছেলেরা। এছাড়া দারিদ্র্যের কারণে অর্থ উপার্জনে যুক্ত হওয়ার কারণেও ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষাবিদরা জানান, সরকারের উপবৃত্তির কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি। ছেলেদের তুলনায় তাদের অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ার হারও কম।
২০২৪ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত ১২ মে। এবার পরীক্ষায় সারা দেশে ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। মোট পাসের হার ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।
এবার অংশগ্রহণকারী মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৭৯৪ জন এবং ছাত্রী ১০ লাখ ২৪ হাজার ৮০৩ জন। ছাত্র পাস করে ৮ লাখ ৬ হাজার ৫৫৩ জন, পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৭। আর ছাত্রী পাস করে ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ জন, পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭। আর ছাত্রদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন এবং ছাত্রীদের মধ্যে ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পরীক্ষায় ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছাত্রদের তুলনায় ৩৬ হাজার ৯ জন বেশি। মোট ছাত্রের চেয়ে ছাত্রী বেশি উত্তীর্ণ হয়েছে ৫৯ হাজার ৪৭ জন। আর ছাত্রীরা জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে ১৫ হাজার ৪২৩ জন। তাছাড়া পাসের হারেও এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা, ফলে অবস্থানে পিছিয়ে রয়েছে ছেলেরা।
একইভাবে ২০২৩, ২০২২, ২০২১ ও ২০২০ সালেও মেয়েরা এগিয়ে ছিল এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায়।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় বা মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়ায় ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংসারের হাল ধরতে ছেলেরা লেখাপড়া ছাড়ছে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা না দিয়েই। এটা শহর ও গ্রামে দুই জায়গায়ই ঘটছে। রাজধানীতে পরিবারহীন পথশিশুদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যাই বেশি। রাজধানীসহ সারা দেশে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাং তৈরি হওয়ায় ছাত্ররা লেখাপড়া ছাড়ছে।
এছাড়া মাদকসহ সামাজিক নানা কারণেও ছাত্রদের লেখাপড়ার পাঠ চুকে যাচ্ছে। উপকূল এলাকায় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছেলেদের লেখাপড়া ছাড়তে হচ্ছে পরিবারকে অর্থের জোগান দিতে গিয়ে। তবে ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম একটি কারণ মোবাইলসহ ডিভাইসে আক্রান্ত হওয়া।
গণসাক্ষরতা অভিযানের বাংলাদেশে বিদ্যালয়-বহির্ভূত শিশু-কিশোরদের পরিসংখ্যানে (গত ৯ মে প্রকাশিত) বলা হয়, ২০২২ সালে মাধ্যমিক ঝরে পড়েছে ৩৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ২০২১ সালে যা ছিল ৩৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০২২ সালে মাধ্যমিক শেষ করতে পারেনি ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান সম্পর্কে গণসাক্ষরতা অভিযান জানায়, ঝরে পড়াদের মধ্যে ছেলেরা বেশি। তবে বাল্যবিয়ের কারণে মেয়েরাও ঝরে পড়ছে মাধ্যমিক পর্যায়ে।
২০১৯ সালে সেভ দ্য চিলড্রেনসহ শিশুদের নিয়ে কাজ করা ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থা রাজধানীতে শিশু অধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, আর্থিক অভাব-অনটন এবং নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে মাধ্যমিক পর্যায়েই ৩৩ ভাগ ছেলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে শেষ না করেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালে সেই হার এসে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশে। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন কারণে তিন গুণের বেশি শিক্ষার্থী শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পরিসংখ্যানে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের ঝরে পড়া তুলনামূলক বেশি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘ছেলেরা এনরোলমেন্ট ও ফলাফলে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। গত চার থেকে পাঁচ বছর ধরে লক্ষ করছি ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো করছে। করোনার সময় মেয়েরা ঘরে বসে পড়েছে, ছেলেরা কাজে যুক্ত হয়েছে। আমরা অনুমানের ওপর ভিত্তি বলতে পারি, কিন্তু এর কারণটা খুঁজে বের করা দরকার। অভিভাবকরা বলেছেন সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ছেলেদের সামাল দেওয়া যায় না। মোবাইলসহ নানা ধরনের আসক্তি, গ্যাংবাজি, পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে কাজে যুক্ত হওয়ার মতো ঘটনা বাড়ছে। তবে আরও একটি বড় কারণ, মেয়েদের জন্য রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি। উপবৃত্তি, অবৈতনিক শিক্ষা। এর প্রতিকার করতে গেলে সর্বজনীন একটি বিনিয়োগ প্রয়োজন। যেহেতু সর্বজনীন করা সমস্যা, তাই জেলাভিত্তিক বাজেট প্রয়োজন। রাজধানীতে দামি স্কুলে বিনিয়োগ না করে উপকূল ও প্রান্তিক জেলায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে পড়ছে আমাদের এ সংক্রান্ত জরিপ নেই। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছেন। আমরা এখন একটি জরিপ করবো। তবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি অংশের ছেলেরা লেখাপড়া শেষ না করে কাজে যোগ দিচ্ছে, এটি একটি কারণ। অনেক অভিভাবক থাকা-খাওয়া ফ্রি পেয়ে কওমি মাদ্রাসায় পড়াচ্ছে, সেটি আরেকটি কারণ। অন্যদিকে উপবৃত্তির কারণে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। ছেলেরা বহির্মুখী, সে কারণে ফলাফল তুলনামূলক মেয়েদের চেয়ে সামান্য খারাপ করছে। তবে চাকরির পরীক্ষায় ছেলেরা ভালো ফল করছে। মেয়েরা বহির্মুখী না হওয়ায় তাদের ঘরে বসে পড়া ছাড়া আর অন্য কিছু করার থাকে না। সে কারণে মেয়েদের ফলাফল ছেলেদের তুলনায় ভালো। ছেলেরা পিছিয়ে গেছে তা নয়, বরং মেয়েরা এগিয়ে গেছে।’
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘আমাদের এ সংক্রান্ত কোনও জরিপ নেই। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে মেয়েরা এগিয়েছে, তাই ছেলেদের অবস্থান পিছিয়ে রয়েছে। পরিবারে অর্থের জোগান দিতে ছেলেরা খারাপ করছে। কিন্তু জরিপ ছাড়া সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না।’
রাজধানীর কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ্ বলেন, ‘উপবৃত্তির কারণে মেয়েদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ বেড়েছে। অন্যদিকে আর্থিক কারণে ছেলেদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বাড়েনি। এছাড়া শহরে টেম্পুতে, দোকানে, হোটেলে এবং আরও অনেক জায়গায় মাধ্যমিকে পড়ার বয়সী বাচ্চাদের কাজ করতে দেখা যায়। গ্রামে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেরা মাধ্যমিক শেষ করার আগেই মাঠে কাজ করছে। শহরে পথশিশুদের মধ্যে ছেলে বেশি, যারা লেখাপড়া করছে না। ফলে ছেলেদের অংশগ্রহণ কম। থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় কিছু অসচ্ছল পরিবারের ছেলেরা কওমিতে পড়ছে। মেয়েদের জন্য কওমি মাদ্রাসা কম। এসব কারণে ছেলেদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। আর ফলাফলে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে, কারণ ছেলেরা ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটাচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের সংস্পর্শে ছেলেদের লেখাপড়া বন্ধ হচ্ছে। আবার অনেক সময় অনেকে কোনোরকমে লেখাপড়া চালিয়ে নিলেও ফলাফল খারাপ করছে।’
বিবিএস-এর পরিসংখ্যানেও বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক কারণে লেখাপড়া করা অবস্থায় ছেলেরা কাজে যোগ দিচ্ছে। শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই অনেক ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ উইংয়ের উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমি এবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি অনেক মানুষ তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের এখন অন্য কাজে লাগাচ্ছেন। বাবা তামাক চাষ করছেন, সেই তামাক চাষের জমিতে ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য যেসব গৃহস্থালি কাজ আছে বা চায়ের দোকান আছে, সেসব কাজে সন্তানদের লাগাচ্ছেন।’
আরও পড়ুন-