বলিউডের ছবিতে সাধারণত গ্ল্যামারাস, কেতাদুরস্ত বেষভূষা আর ঐতিহ্যবাহী নাচের বহুল উপস্থিতির জন্য নাম রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের আক্রমণাত্মক কিছু সিনেমায় আপত্তিকর বাদামি চেহারার (ব্রাউন ফেস) ব্যবহার শুরু করেছে।
‘এটা বর্ণবাদ’—এমনটাই বলছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত বলিউড নির্মাতা নীরাজ গায়ওয়ান।
আসুন বিষয়টির বিশদে যাওয়া যাক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডার্ক ফেস (কালো) ও ব্রাউন ফেসের (বাদামি, অর্থাৎ ঠিক কালো নয়, সাদাও নয়) ধারণা ছিল ১৯ শতকের আগে। তখন সাদা চামড়ার অভিনয়শিল্পীরা মেকআপের মাধ্যমে তাদের মুখ কালো করে নিতেন। কালো ও সংখ্যালঘুদের চরিত্রে অভিনয়ে এই মানসিকতা বর্ণবাদী ধ্যান-ধারণাকেই তুলে আনতো।
কালো চামড়ার পেশাদার শিল্পীরা যখন কাজে বাধা পাচ্ছিলেন সেই সময়টাতেই সাদা চামড়ার শিল্পীরা এটা করেছিলেন।
তবে এটা তখন নতুন কিছু ছিল না। এর আগেও এটা হয়েছে। এ ধরনের প্রচলন ইংল্যান্ডে আরও আগে অর্থাৎ রানী এলিজাবেথের যুগ থেকেই চলে আসছিল। তখন পরিচালকরা শেক্সপিয়রের নামে সংখ্যালঘু চরিত্রে সাদা চামড়ার অভিনয় শিল্পীদের ব্যবহার করতেন। এমনকি সাম্প্রতিক দশকগুলোতেও ‘ওথেলো’ নাটকে আফ্রিকান জেনারেলের ভূমিকায় সাদা চামড়ার অভিনেতারা কালো মেকআপ করে অভিনয় করতেন।
এবার যদি আধুনিক ছবির দিকে তাকানো হয়, এটার প্রচলন দেখা গেছে ১৯৮৩ সালে। ছবির নাম ছিল ‘ট্রেডিং প্লেস’। এর অভিনেতা ড্যান অ্যাক্রয়ের কালো চেহারা ব্যবহার করে অভিনয় করেন।
২০১২ সালে অভিনেতা বার্ট ডাউনি জুনিয়রকেও ‘ট্রপিক থান্ডার’-এর বেশ কয়েকটি ছবিতে কালোরূপে হাজির হতে দেখা গেছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের ছবিতে একজন ‘কালো’ ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে তিনি মুখের রং কালো করেছিলেন।
আমরা যদি বলিউডের দিকে তাকাই এই ইন্ডাস্ট্রির অনেক ছবিতেও একইভাবে বাদামি চেহারাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত চরিত্র হলেই
এ ধরনের চেহারা সামনে আনা হয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, হলিউডের প্রথমদিকের সিনেমার মতোই বলিউডে এ ধরনের চরিত্রে যারা প্রাকৃতিকভাবে বাদামি বা কালো তাদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। জনপ্রিয় অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা এটি করছেন। এতে এই শিল্পে বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে ২০১৯ সালের ‘বালা’ ছবির কথা বলা যায়। এতে গায়ের রঙের কারণে একজন নারীর বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে। এই চরিত্রে ভূমি পেডনেকার নামের যে অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন তাকে চরিত্রের জন্য ত্বক কালো করতে হয়। বিষয়টি নিয়ে ওই সময় ভারতীয় গণমাধ্যম, সামাজিকমাধ্যমে বেশ সমালোচনাও হয়েছে।
এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দর্শকরা বিষয়টি নিয়ে ভূমিকে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেন।
ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্য মতে, সেই সময় ভূমি ওই ছবির চরিত্র নিয়ে প্রথমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ভূমি বলেন, ‘পরিচালক মনে করেছেন এই চরিত্রে আমি বিশেষ কিছু দিতে পারব। সেকারণেই আমাকে রাখা।’
পরিচালক অমর কৌশিকের পরিকল্পনা প্রথমে ভিন্ন ছিল। বলেন, ‘চরিত্রটিতে কালো ত্বকের কাউকে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভূমি এতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন।’
২০১৯ সালে বলিউডের বক্স অফিসে সাড়া ফেলা দুই ছবি ‘সুপার ৩০’ এবং ‘গালি বয়’ ছবি দুটিকে অনেকেই বর্ণবাদী ও আপত্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন।
বলিউডের সবচেয়ে গ্লামারস নায়ক হৃতিক ‘সুপার ৩০’-এ তার ত্বকে রং ব্যবহার করেন। অপর দিকে রণবীর সিংও ‘গালি বয়’ ছবিতে একই কাজ করে চামড়া কালো করেছেন।
দশ বছর আগে ‘ওমেন অব ওর্থ’ নামের একটি এনজিও ‘কালো হলো সুন্দর’ নামের ক্যাম্পেইন শুরু করে। যা স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজ করেছে।
এই ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র হিসেবে আছেন ভারতের অন্যতম অভিনেত্রী-নির্মাতা নন্দিতা দাস। তার মতে, ‘এই ক্যাম্পেইন বর্ণবাদের শিকার হওয়া নারীদের উৎসাহিত করেছে। তারা তাদের গল্পগুলো সবার সামনে তুলে ধরেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি (বর্ণবাদ) আলোচ্য হচ্ছে। তবে এটি অনেক পুরনো বৈষম্য। বিয়ের প্রচারণায়, প্রসাধন সামগ্রীতে কালো-সাদার ফারাক বহুবার এসেছে। ক্যাম্পেইনে কাজ করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি। মনে হয়েছে যে, এ বিষয়ে আরও আগে কেন মুখ খুলিনি।’
চলচ্চিত্রে নিজের কাজ প্রসঙ্গে এই তারকা আরও বলেন, ‘‘আমার চেহারাটি সাধারণত নিম্ন শ্রেণির চরিত্রে দেওয়া হয়। যদি কখনও আমি শিক্ষিত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত ভূমিকায় নির্বাচিত হই, ছবির পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার এমনকি মেকআপম্যানকে বলতে শুনেছি, ‘চিন্তা করো না, তোমার রং উজ্জ্বল করে দেব’।’’
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে সৌন্দর্যকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাদের বিভিন্ন আচারেও তা উঠে এসেছে। ভারতের দিল্লির ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক গ্রোথের সমাজবিজ্ঞানী সঞ্জয় শ্রীবাস্তব বলেন, ‘এ ধরনের মানসিকতা উপনিবেশ যুগের। এটা অবশ্যই বর্ণ প্রথার সাথে যুক্ত। হিন্দু ধর্মে বর্ণের প্রভাব বেশ স্পষ্ট। সেখানে নিম্নবর্ণের মানুষেরা কালো এবং কুশ্রী হয়। আবার ফর্সারা অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।’
অস্ট্রেলিয়ার মারডোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও লেখক বিজয় মিশ্র বলেছেন, ‘বলিউডের সিনেমায় ধর্মীয় আইকোনাগ্রাফ্রি এবং পার্সি থিয়েটারের প্রভাব দেখা যায়। এই দুটিতেই ফর্সা রঙের প্রাধান্য আছে। তিনি বলেন, শিব, রাম ও কৃষ্ণ ছাড়া হিন্দু দেবদেবীরা অবিশ্বাস্য রকমভাবে ফর্সা।’
এছাড়া যে তিনটি ছবির কথা বলা হলো সেগুলো বণিজ্যিকভাবে সফল ও আলোচিত।
Looking for Assistant Directors and Assistant Writers from DBA backgrounds. Please share it to help friends. pic.twitter.com/dqL1Orq5I4
— Neeraj Ghaywan (@ghaywan) September 11, 2019
বাণিজ্যিকভাবে সফলতার জন্যও এমন শিল্পী যুক্ত করা হচ্ছে বলে মনে করেন পরিচালক নীরাজ। তার মতে, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিখ্যাত শিল্পীকে নেওয়ার। যারা বাণিজ্যিক সফলতা আনতে পারবে। শুধু এখন নয় এটি পঞ্চাশের দশকেও হয়েছে।’
অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানী শ্রীবাস্তব বলেন, ‘১৯৪৭ সালে ভারতে সংবিধানের মাধ্যমে বন্ধ করা হয় বর্ণ প্রথা। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন স্থানে এখনও এটি বিদ্যমান। যার প্রভাব বলিউডের সিনেমাতে দেখা যায়। কালো চরিত্রে অভিনয়ের জন্যও এ কারণে গ্লামারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ তারা দর্শকদের বোঝাতে চান, কালো মুখটির পেছনে গ্ল্যামার রয়েছে। আছে ব্যবসায়িক লাভের হিসাবও।’
সূত্র: সিএনএন