X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
সংগীতাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৫ প্রস্তাবনা

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর আহ্বানে বৃহত্তর ঐক্যের পথে সংগীতের তিন সংগঠন

সুধাময় সরকার
০৪ অক্টোবর ২০২০, ২২:৪৬আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২০, ১৩:১৩

সভা শেষে যৌথ ফটো সেশন

সাম্প্রতিক সময়ে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বেশ সোচ্চার ও সচেতন হয়ে উঠেছেন সংগীত সংশ্লিষ্টরা। গেল ৪৯ বছরেও যে ইন্ডাস্ট্রিতে গীতিকবি, কণ্ঠশিল্পী আর সুরকারদের কোনও সংগঠন তৈরি হয়নি, চলমান মহামারিতে সেটিই হয়েছে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছে গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পীরা। সৃষ্টি হয়েছে যথাক্রমে গীতিকবি সংঘ বাংলাদেশ, মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটি বাংলাদেশ ও সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নামের তিনটি সংগঠন।  
আশার কথা হলো, এই তিন সংগঠন মিলে এবার হতে যাচ্ছে বৃহত্তর ঐক্য। আর সেটি বাস্তবায়নের জন্য তিন সংগঠনকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি।
রবিবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বাংলাদেশ আর্কাইভ মিলনায়তনে রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস দফতরের উদ্যোগে প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সঙ্গে এই সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর আহ্বায়ক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। গীতিকবি আসিফ ইকবালের সঞ্চালনায় সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন গীতিকবি সংঘের প্রধান সমন্বয়ক শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটি বাংলাদেশ-এর সভাপতি নকীব খান এবং সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর যুগ্ম আহ্বায়ক কুমার বিশ্বজিৎ।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সংগীত পরিচালক মানাম আহমেদ ও শওকত আলী ইমন, শিল্পী ও সুরকার বাপ্পা মজুমদার, গীতিকবি জুলফিকার রাসেল এবং বাংলাদেশ আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতরের মহাপরিচালক ফরিদ আহমদ ভুঁইয়া।

সভায় তিন সংগঠনের সম্মিলিত ১৫টি প্রস্তাবনা পাঠ করেন যথাক্রমে গীতিকবি সংঘের জ্যেষ্ঠ সদস্য কবির বকুল, মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ এবং সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য জয় শাহরিয়ার।







প্রস্তাবনাগুলো এমন—
১. বর্তমানে প্রচলিত কপিরাইট আইনে চলচ্চিত্রের সংগীতের কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী চলচ্চিত্রের প্রযোজক। কিন্তু বর্তমানে চলচ্চিত্রের জন্য সৃষ্টি করা সেইসব সংগীতকর্ম চলচ্চিত্রের জন্য সম্পাদিত চুক্তির বাইরেও বিভিন্ন অ্যানালগ ও ডিজিটাল মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার কপিরাইট ও বাণিজ্যিক স্বত্ব সংগীতকর্ম সৃষ্টিকারীদের প্রাপ্য বলে আমরা মনে করি। এ বিষয়ে ভারতের জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক ইলিয়া রাজার একটি কপিরাইট সংক্রান্ত মামলার রায়ের কপি উদাহরণ হিসাবে আমলে নেওয়া যেতে পারে, যার একটি কপি কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরীর কাছে জমা দেওয়া আছে।
২. ২০১৪ সালে সংগীত সংশ্লিষ্ট কোনও বৈধ সাংগঠনিক প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই বিএলসিপিএস নামে একটি সংগঠন কপিরাইট সমিতির লাইসেন্স পায়। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছরেও তারা কোনও কার্যক্রম শুরু করেনি। কপিরাইট আইনের ৮ম অধ্যায়ের ধারা ৪৫ অনুযায়ী সরকারকে কোনও রিটার্ন দাখিল করেনি। ধারা ৪৬ অনুযায়ী সরকারও কোনও হিসাব ও নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারেননি। এ সংগঠনটি দীর্ঘদিন কার্যকর না থাকার ফলে সংগীত সংশ্লিষ্টরাও বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে এ সংগঠনটির বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ ও ক্ষোভ সংশ্লিষ্ট মহলে বিরাজমান। কপিরাইট সমিতির অকার্যকর এ লাইসেন্স কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি। এ কারণে বর্তমান লাইসেন্সপ্রাপ্তদের বদলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যোগ্য প্রতিনিধি, গীতিকবি সংঘ, মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটি (এমসিএসবি) ও সিঙ্গার্স অ্যাসোসিয়েশন মনোনীত যোগ্য প্রতিনিধি এবং একজন কপিরাইট আইন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে কপিরাইট সমিতি পুনর্গঠন/লাইসেন্স বাতিলের আবেদন জানাই। আমাদের অনুরোধ পূর্বের লাইসেন্সপ্রাপ্তদের অতীতের দায় ও অমীমাংসিত লেনদেনের বোঝা থেকে তিন সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী বা পুনর্গঠিত কপিরাইট সমিতিকে যেন সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা হয়।
৩. গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পীদের সংগঠনের জন্য পৃথক অফিস বরাদ্দ ও মিউজিক ক্লাবের জন্য স্থান বরাদ্দ ও নির্মাণ প্রকল্প নেওয়ার অনুরোধ জানাই।
৪. দেশের সংগীতে বিশেষ অবদান বিবেচনা করে এই তিন সংগঠনের সুপারিশক্রমে প্রতি বছর এমআইপি (মিউজিক্যালি ইম্পরট্যান্ট পারসন) ঘোষণা ও প্রচলনের অনুরোধ করি, যাতে তারা দেশের সকল স্থানে ভিআইপি মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন।
৫. সরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলে গীতিকবি, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের সম্মানী বৃদ্ধি, গীতিকবি, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের রয়্যালটি প্রদান, এফএম রেডিও এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলসহ সকল সম্প্রচার মাধ্যমে ফ্রি গান চালানো নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং গীতিকবি, সুরকার ও শিল্পীদের জন্য একটি সম্মানী ও রয়্যালটি নীতিমালা তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাই।
৬. সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতি বছর শুধু সংগীতের সকল শাখায় গুণী ব্যক্তিদের সম্মান জানানোর লক্ষ্যে জাতীয় পদক/পুরস্কার প্রচলনের অনুরোধ জানাই।
৭. সংগীত সংশ্লিষ্টদের জন্য আবাসন প্রকল্প গ্রহণ এবং বর্তমান বিরাজমান শিল্পী কোটা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের তিন সংগঠনের যেকোনও একটি সংগঠনের প্রত্যয়নপত্র গ্রহণের বিধান রাখার আবেদন জানাই।
সভায় কথা বলছেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি ৮. সরকারি হাসপাতালসমূহে সংগীত সংশ্লিষ্টদের জন্য বিশেষ মর্যাদায় এবং বিশেষ ছাড়কৃত ফি-তে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার বিধান রাখার অনুরোধ জানাই।
৯. গবেষণা, চর্চা ও উৎকর্ষের লক্ষ্যে শুধুমাত্র সংগীতের জন্য পূর্ণাঙ্গ অডিটোরিয়ামসহ একটি জাতীয় সংগীত অ্যাকাডেমি গঠন করার আবেদন জানাই।
১০. ছাব্বিশ কোটিরও বেশি মানুষের ভাষা বাংলা, পৃথিবীতে যা সপ্তম জনপ্রিয় ভাষা। বাংলার চেয়ে কম জনপ্রিয় ভাষার গানের জন্য ক্যাটালগ থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন জনপ্রিয় ডিজিটাল ও আধুনিক মাধ্যমে বাংলা গানের জন্য আলাদা ক্যাটালগ নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ওয়াইপোর সহযোগিতায় সকল বিদেশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলা সংগীতের জন্যে আলাদা ক্যাটালগের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করি।
১১. গুণী গীতিকবি, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের সম্মানে সারা দেশের সব শিল্পকলা একাডেমি ও অন্যান্য স্থানে অবস্থিত মঞ্চের নামকরণ, খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞদের নিজ জেলা বা বিভাগের সড়ক ও চত্বরের নামকরণের আবেদন জানাই।
১২. সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমিসহ অন্যান্য সকল সরকারি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পীদের সম্মানজনকভাবে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাই।
১৩. বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে তুলে ধরার স্বার্থে কণ্ঠশিল্পী এবং যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের সমন্বয় সাধনের জন্য সকল ধরনের জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলে সংগীত পরিচালকের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গীতিকবিদের অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানাই।
১৪. আন্তর্জাতিকভাবে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদেশ থেকে আসা সকল সাংস্কৃতিক দলের সাথে প্রয়োজন মতো সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকারদের মিলিত হওয়ার ও সম্মিলিতভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টির আবেদন জানাই।
১৫. সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সংগীতের সাথে জড়িত সকল প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানাই।
সভায় স্বাগত বক্তব্যে শহীদ মাহমুদ জঙ্গী অনাগত গীতিকবিদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার স্বার্থে কপিরাইট আইন সংশোধনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এ আইন বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ করেন। সুরস্রষ্টাদের পক্ষ থেকে নকীব খান কপিরাইট রেজিস্ট্রারের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে সংগীত সংশ্লিষ্টদের স্বার্থসংরক্ষণে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
সংগীত সংশ্লিষ্টদের গত ঊনপঞ্চাশ বছরের অপ্রাপ্তির অবসানের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন কুমার বিশ্বজিৎ। যাতে সংগীত সংশ্লিষ্টরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্তিতে স্বাবলম্বী হতে পারেন।
এদিকে উক্ত সভায় রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস (যুগ্ম সচিব) জাফর রাজা চৌধুরী উপস্থিত সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে কপিরাইট আইন সংশোধনে তিন সংগঠনের ভূমিকার প্রশংসা করেন।
শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি বলেন, ‘আজ এক ঐতিহাসিক দিন। সংগীতের মূল তিনটি শাখার শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এই প্রথম কোনও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হলো, যা অভূতপূর্ব।’
সভায় উপস্থিত তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তিন সংগঠনের ১৫টি প্রস্তাবনাকে যৌক্তিক হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় এগুলো কার্যকর করার জন্যে শিগগিরই একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করবে এবং সংস্কৃতি নীতিমালা গঠনে এ তিন সংগঠনের পরামর্শ ও প্রস্তাবনা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি অনুমোদন ব্যতিরেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ শুনেছি। এ কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্যেই রামের কপিরাইট যাতে রহিম নিয়ে যেতে না পারে, সেদিকে সম্মিলিতভাবে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখতে হবে আমাদের। এর জন্য এই তিনটি সংগঠনকে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’
এদিকে সভাপতির বক্তব্যে কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা সংগীত সংশ্লিষ্ট সকল গীতিকবি, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের তালিকা প্রণয়নের জন্যে কপিরাইট অফিসের প্রতি অনুরোধ জানান।
সবার শেষে, রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস জাফর রাজা চৌধুরী সকলকে এ মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
বোনকে নিয়ে সনু নিগমের প্রথম গান!
বোনকে নিয়ে সনু নিগমের প্রথম গান!
বলিউডে কোণঠাসা প্রিয়াঙ্কা!
বলিউডে কোণঠাসা প্রিয়াঙ্কা!
একসঙ্গে এই অভিনেতারা...
একসঙ্গে এই অভিনেতারা...
শিল্পীদের সমস্যাগুলো সংসদে চিহ্নিত করতে চাই: ফেরদৌস
শিল্পীদের সমস্যাগুলো সংসদে চিহ্নিত করতে চাই: ফেরদৌস
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…