X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

‘মোদির ভারতে’ গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যা বন্ধ হবে কি?

আরশাদ আলী
৩০ জুন ২০১৭, ২০:৪৯আপডেট : ৩০ জুন ২০১৭, ২১:২৪

গরু ভক্তির নামে মানুষ হত্যা মেনে নেওয়া যায় না। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া অধিকার কারও নেই। কথিত গো-রক্ষার নামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ইস্যুতে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙ্গে এমন মন্তব্য করলেন ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গরু রক্ষার নামে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে ভারতজুড়ে বিক্ষোভের একদিনের মাথায় তিনি এ মন্তব্য করলেন। তার আপাতদৃষ্টিতে কঠোর এই মন্তব্যকে লোক দেখানো বলে আখ্যায়িত করেছে দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বামপন্থীরা।

নরেন্দ্র মোদি

গো-রক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদীদের হামলায় নিহত জুনায়েদের বাবা জানিয়েছেন, মোদি চাইলেই এমন নৃশংসতা বন্ধ করতে পারেন। তিনি মন থেকে চাইলেই সেটা সম্ভব।

মোদি’র ওই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঝাড়খণ্ডে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে খুন হন আরেক মুসলিম ব্যক্তি। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, মহাত্মা গান্ধীর ভারতে খুনোখুনি না করার আহ্বান জানিয়েছেন মোদি! কিন্তু আদতেই কি মোদির ভারতে বন্ধ হবে গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যা?

২৯ জুন বৃহস্পতিবার মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত গুজরাটের সাবরমতি আশ্রমে ভাষণ দেন ‘গুজরাটের কসাই’ খ্যাত নরেন্দ্র মোদি। ভাষণে তিনি গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি(!) জানালেও মুসলিম সম্প্রদায় বা সর্বশেষ গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে হত্যার শিকার কিশোর জুনায়েদের নাম উচ্চারণ করেননি।

নরেন্দ্র মোদি এমন সময়ে এ মন্তব্য করলেন যখন চলতি বছরের শেষদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে গুজরাট। অনেকেই মোদির এই মন্তব্যকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন। তাদের দাবি, ভোটে রাজ্যের দলিত সম্প্রদায়ের সমর্থন পেতেই মোদি এ সময়কে বেছে নিয়েছেন। এর আগে ২০১৬ সালের আগস্টে তিনি গুজরাটে এক দলিত ব্যক্তিকে হত্যার পর গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যার নিন্দা জানিয়েছিলেন। এ সময় তিনি এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সমাজবিরোধী হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। তবে সরাসরি তিনি গো-রক্ষকদের কথা উল্লেখ করেননি।

২০১৬ সালের আগস্টের পর অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফলে মোদির এবারের হুঁশিয়ারিতে গো-রক্ষকদের তাণ্ডব থামবে না বলে মনে করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

ভারতের রাস্তায় গো-রক্ষকদের তাণ্ডব

মোদি চাইলেই এটা থামাতে পারেন: নিহত জুনায়েদের বাবা

ফরিদাবাদে চলন্ত ট্রেনে গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে ছুরিকাঘাতে নিহত ১৫ বছরের কিশোর জুনায়েদের বাবা জালালুদ্দিন খান। তিনি গো-রক্ষকদের তাণ্ডবে মোদির হুঁশিয়ারিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলেছেন! কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড থামাবে কে? আমি চাই তিনি মন থেকে এসব কথা বলেন। প্রতিটি শহরে বলেন, প্রতিটি রাজ্যে বলেন, প্রত্যেক কর্মকর্তাকে বলেন। তিনি যদি হত্যাকাণ্ড থামাতে চান, তাহলে তিনি পারবেন।

চাপের মুখে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য লোক দেখানো

গো-রক্ষকদের প্রতি মোদির এ হুঁশিয়ারিকে জনগণের চাপের মুখে লোক দেখানো বলে অভিহিত করে প্রত্যাখ্যান করেছে কংগ্রেস ও দেশটির বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধীর মোদির ভাষণের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি মোদির মন্তব্যকে অনেক দেরির পর খুব সামান্য বলে অভিহিত করেছেন। মোদির কথা বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা রাখবে না।

দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ রাজ্যসভার বিরোধী দলীয় নেতা নবি আজাদ ও সিপিআই(এম)-এর জেনারেল সেক্রেটারি সিতারাম ইয়েচুরি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, জনগণের চাপের মুখেই এ বক্তব্য দিয়েছেন মোদি।

বিবৃতিতে নবি আজাদ বলেন, ‘এটা আরেকটি জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কৌশল। জনগণের চাপের মুখেই এই বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। কারণ গতকাল (বুধবার) পুরো দেশের মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন।’ নবি আজাদ বুধবার গো-রক্ষকদের তাণ্ডবের প্রতিবাদে নট ইন মাই নেম স্লোগানে প্রতিবাদের কথা এখানে ইঙ্গিত করেছেন।

নবি আজাদ আরও বলেন, তার (মোদি) বক্তব্যে আমাদের আস্থা নেই। যখন হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে আমরা তখনই তার কথা বিশ্বাস করব।

সিতারাম ইয়েচুরি বলেন, গণপিটুনির ঘটনায় জনগণের চাপের কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে তার নীরবতা ভাঙতে বাধ্য করেছে। বিজেপি সরকার যদি কোনও পদক্ষেপ না নেয় তাহলে এসব কথা অর্থহীন।

নরেন্দ্র মোদি

ইয়েচুরি আরও বলেন, আমরা সবাই জানি জাতির জনকের কাছে এটা অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের কাছে এটা কি অগ্রহণযোগ্য? যদি তাই হয় তাহলে এখন পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হলো না কেন? হত্যাকারীরা দেশের আইনে অপরাধী। কেন বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে না?

আরেক বামদল সিপিআই-এর জেনারেল সেক্রেটারি এস সুধাকর রেড্ডি মোদির প্রতি একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। তাতে মোদির বক্তব্যকে স্বাগত জানালেও কার্যকর পদক্ষেপের আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, আমার মনে এই নিয়ে চতুর্থবার বিষয়টি নিয়ে আপনি কথা বললেন। কিন্তু অতীতে কোনও পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গত বছরেই ২৮টি গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গণপিটুনিতে নিহতদের মধ্যে ২৪ জনই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের। আজ পর্যন্ত কোনও হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে কারও শাস্তি হয়নি। হোক তা গো-রক্ষক বা দলিতদের হত্যার ক্ষেত্রে।

গৃহকর্তা গরু জবাইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন-এমন সন্দেহে এক মুসলিম বাড়িতে অগ্নিসংযোগ

গো-রক্ষকরা মোদিকে ভয় পায় না: সাবেক অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম

শুক্রবার ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যেদিন এ হুঁশিয়ারি দিলেন সেদিনই গো-রক্ষকদের তাণ্ডবে প্রাণ হারিয়েছেন এক ব্যক্তি। এ ঘটনাই প্রমাণ করে গো-রক্ষক ও গণপিটুনিতে হত্যাকারীরা মোদিকে ভয় পায় না।

চিদাম্বরম এই বিষয়ে হুঁশিয়ারি জানানোকে ভালো হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মোদি নিজের কথামতো কাজ করবেন কিনা তা নিয়ে। চিদাম্বরম বলেন, গো-রক্ষক ও গণপিটুনিতে হত্যার বিষয়ে মোদি সতর্ক করেছেন, ভালো। এবার দেশবাসীকে বলা উচিত কিভাবে তিনি এটা বন্ধ করবেন।

উল্লেখ্য মোদি যখন আহমেদাবাদের সবরমতি আশ্রমে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তার কিছুক্ষণ পরেই ঝাড়খণ্ডের রাচিতে আলিমুদ্দিন আনসারি নামে এক ব্যক্তিকে গরুর মাংস বহনের অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

আখলাকের পুনরাবৃত্তি বা নতুন করে শুরু!: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসর সম্পাদকীয়

ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’র সম্পাদকীয়তে নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যকে স্বাগত জানানো হয়েছে। তবে বক্তব্যে মোদি গো-রক্ষকদের তাণ্ডবে নিহত মুসলিমদের নাম উল্লেখ না করার সমালোচনাও করেছে পত্রিকাটি।

‘মোদির ভারতে’ গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যা বন্ধ হবে কি?

সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী আরও বেশি বলতে পারতেন। যেযসব পরিবার গণপিটুনি ও গো-রক্ষা তাণ্ডবের শিকার হয়েছেন তারা যা শুনতে অপেক্ষায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী সেগুলোর কোনওটাই বলেননি। মানুষ প্রধানমন্ত্রী মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলেন, যে কোনও মূল্যে সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনের অধিকার, স্বাধীনতা ও সম্মান রক্ষা করতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী অপরাধীদের বৈশিষ্ট্যও তুলে ধরেছেন অসম্পূর্ণভাবে। তিনি বলেননি এসব বিদ্বেষমূলক অপরাধ একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে। হত্যার শিকার ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ না করায় তার এই হস্তক্ষেপ বা ঘৃণার প্রকাশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীদের উচিত মোহাম্মদ আখলাক, পেহলু খান ও জুনায়েদ খানের নাম উল্লেখ করে বক্তব্য দেওয়া।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আরও লিখেছে, কঠোর হস্তে কাজ করা ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত প্রধানমন্ত্রীর উচিত তার দল ও দলের মুখপাত্র যেনও এই বক্তব্যকে শ্রদ্ধা জানায় তা নিশ্চিত করা। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। কিন্তু কেন্দ্রের উচিত রাজ্যগুলোকে মোদির বক্তব্যের আলোকে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত পরামর্শ দেওয়া এবং খবর নেওয়া। কেন্দ্র-রাজ্য ফোরাগুলোকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় কাজে লাগানো এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।

পত্রিকাটি আশঙ্কা করছে সবরমতি আশ্রমে মোদির বক্তব্য গত বছর আগস্টের মতোই কথার কথা অথবা একটি নতুন শুরু হতে পারে। কিন্তু নতুন সূচনার জন্য মোদির বক্তব্য অনুসারে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোকে পরিচালিত হতে হবে। সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য হিন্দু।

/এমপি/

সম্পর্কিত
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
ভারতের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আ.লীগকে আমন্ত্রণ বিজেপির
লাইয়ের অভিষেক পরবর্তী চীনা সামরিক মহড়া নিয়ে সতর্ক অবস্থানে তাইওয়ান
সর্বশেষ খবর
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
১০ মাসে এলো রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স
১০ মাসে এলো রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
টেকনাফে অপহরণের শিকার একই পরিবারের ৩ জনকে উদ্ধার
টেকনাফে অপহরণের শিকার একই পরিবারের ৩ জনকে উদ্ধার
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে